কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিতর্ক: ‘তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’। ছবি: সংগৃহীত

ঢাবির ছাত্র বনাম শিক্ষকদের ‘ঐতিহাসিক সেই বিতর্কে’ কী ঘটেছিল?

প্রিয় ডেস্ক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ২০:১২
আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ২০:১২

(প্রিয়.কম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ১৯৮১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার)  বেলা ১১টায় এক ঐতিহাসিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই বিতর্কের বিষয় ছিল: ‘তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’। বিতর্কের প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন শিক্ষার্থীরা, যাদের বয়স ত্রিশের কম, আর বিপক্ষে ছিলেন শিক্ষকেরা, যারা ছিলেন ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের।

সেই বিতর্কের প্রস্তাবের পক্ষের তিন শিক্ষার্থী হলেন—মাহমুদুর রহমান মান্না, এম এম আকাশআলী রীয়াজ। আর বিপক্ষ দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান তিন শিক্ষক ছিলেন। তারা হলেন—অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তাফা কামাল ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বিতর্ক সংঘের উদ্যোগে অভাবনীয় সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই বিতর্ক আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিতর্ক সংঘের’ সভাপতি কাওসার চৌধুরী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী সেই বিতর্ক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন। বিতর্ক অনুষ্ঠানে ড. আহমদ শরীফ, ড. আনিসুজ্জামান, ড. রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আজিজুর রহমান, আহমদ ছফা, ড. আবদুল আলীমসহ আরও প্রায় ১৫/২০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সবাই ঐতিহাসিক সেই বিতর্ক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে এসেছিলেন।

বিতর্ক অনুষ্ঠান নিয়ে সেই সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর আলোচনা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ,  সাপ্তাহিক বিচিত্রা, হলিডে এবং ডেইলি অবজারভার পত্রিকায় ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। সাপ্তাহিক বিচিত্রা ওই বিতর্ক অনুষ্ঠান নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল। হলিডে আর অবজারভার লিখেছিল প্রধান সম্পাদকীয়।

সেই বিতর্ক অনুষ্ঠানের ৩৭ বছর পর সম্প্রতি কাওসার চৌধুরী এবং আলী রীয়াজ ‘ঐতিহাসিক সেই বিতর্ক’ প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপট এবং বিতর্কের ফলাফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্মৃতিচারণা করেছেন। তাদের সেই স্মৃতিচারণা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

আলী রীয়াজ সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতা নিয়ে ফেসবুকে যা বলেন 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থী-জীবনের যেসব অবিস্মরণীয় স্মৃতি আছে তার একটি হচ্ছে বিতর্ক অনুষ্ঠান। ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালের একটি বিতর্ক অনুষ্ঠান। আজকে অকস্মাৎ সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছে টরেন্টো প্রবাসী বন্ধু আব্দুল হালিম মিয়া। সেই স্মৃতির পেছনে আছে আরও অনেক কিছু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থী জীবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি। পরের বছরগুলোতে ক্লাসরুমের শিক্ষার পাশাপাশি রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম প্রতিটি মুহূর্ত; আমার শিক্ষালয় কেবল ক্লাসরুম ছিল না, লাইব্রেরি ছিল না—ছিল বটতলা, মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি; ছিল রাজপথ, বন্ধুদের আড্ডা, গফুর মিয়ার ক্যান্টিন। সেই জীবনের একটি বিশেষ দিক ছিল বিতর্ক চর্চা। এখনকার মতো বিতর্ক চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। দেশের একমাত্র টেলিভিশন হচ্ছে বাংলাদেশ টিভি, তার আকর্ষণীয় এবং দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা’। সন্ধ্যাবেলা প্রচারিত হয়, তার প্রযোজক নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।

সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের হয়ে আমরা যারা বিতর্কে অংশ নিয়েছি তার মধ্যে ছিলেন এম এম আকাশ, শাহ আলম সারওয়ার, কবির মোহাম্মদ আশরাফ আলম, সিনহা এম এ সাঈদ। ফজলুল হক হলের দলে আমরা তিনজন ছিলাম—এসএম সোলায়মান, কামাল চৌধুরী এবং আমি। দলনেতার দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য বর্তায় আমার ওপরে। টেলিভিশনের বাইরে বিতর্ক চর্চা সীমিত বললেও বাড়িয়েই বলা হয়। সেই সময়ে কাওসার চৌধুরী গড়ে তুলল ‘বিতর্ক সংঘ’। একেবারে অবিশ্বাস্য এবং অসাধ্য সাধনের চেষ্টা। ক্যামেরা-পাগল কাওসার চৌধুরী নিজেও বিতার্কিক, কিন্ত সংঘের এই কর্মকাণ্ডে তার সহযোগী হাতে গোনা। এতে উৎসাহ জোগান টিএসসির পরিচালক জামান স্যার। হঠাৎ করেই বিতর্ক সংঘের উদ্যোগে, বলা যায় কাওসারের উৎসাহে ও ছোটাছুটিতে, আয়োজিত হলো একটি বিতর্ক। স্থান টিএসসি মিলনায়তন। সময় সকাল এগারোটা, তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১। মঙ্গলবার। বিষয়—“তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়”। এক পক্ষে শিক্ষক, অন্য পক্ষে শিক্ষার্থী। প্রস্তাবের পক্ষে শিক্ষার্থীরা, বিপক্ষে শিক্ষকেরা।

কানাডা প্রবাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুল হালিম মিয়া। তার সে দিনের ডায়েরি পাতা ফেসবুকে পোস্ট করেন 

এমন একটা বিতর্কের কথা কেন ওর মাথায় এসেছিল কাওসারই তা বলতে পারবে। সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ডাকসুর সহসভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না শিক্ষার্থীদের একজন, দলনেতা। আকাশ ভাই তখন বিতার্কিক হিসেবেই কেবল পরিচিত নয়, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ও প্রিয়। আমার সৌভাগ্য শিক্ষার্থী দলের একজন হিসেবে অংশ নেয়ার। শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ হচ্ছি সেটা ভেবেই মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা। নাম শুনে ভিমরি খাওয়ার জোগাড়—অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। টিএসসির মিলনায়তন কানায় কানায় ভরে উঠল, যতদূর মনে পড়ে অনুষ্ঠান শুরুর আগেই বারান্দায় মাইকের ব্যবস্থা করতে হলো উদ্যোক্তাদের।

বিতর্কের শেষে অসংখ্য দর্শকের ভিড় ঠেলে কলা ভবনে ফিরে শুনলাম, কোনো কোনো ক্লাস বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা গিয়েছিলেন বিতর্ক অনুষ্ঠানের শ্রোতা হতে। কতটা সময় চলে গেছে তারপরে। আজ হঠাৎ করে হালিম তার দেয়ালে সেঁটে দিলো তার সে দিনের ডায়েরির পাতা–“দারুণ জমেছিল এবং খুব উপভোগ্য হয়। অত্যন্ত গরম সহ্য করেও অনেক ছাত্র সমাগম ছিল।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি এইভাবেই জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। অনেক কথাই বলা হয় না, অন্যদের স্মৃতির পাতা মেলে ধরলে টের পাই–‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার।’

      ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)

আলী রিয়াজের স্মৃতিচারণার দুদিন পর বিতর্ক সংঘের সভাপতি ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী কাওসার চৌধুরী তার ফেসবুকে এক দীর্ঘ স্মৃতিচারণামূলক লেখা পোস্ট করেন। পাঠকদের জন্য সেটিও ‍তুলে দেওয়া হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিতর্ক...

দীর্ঘদিন পরে হঠাৎ করেই রীয়াজ ভাইয়ের (অধ্যাপক আলী রীয়াজ) লেখায় আমার প্রসঙ্গ দেখে সত্যিই আপ্লুত হয়েছি। সুদীর্ঘ ৩৭ বছর আগের একটি প্রসঙ্গ আজ অনেকটা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসলো যেন!

রীয়াজ ভাই তার লেখায় (ফেসবুক-এ) উল্লেখ করেছেন এইভাবে—
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থী-জীবনের যেসব অবিস্মরণীয় স্মৃতি আছে তার একটি হচ্ছে বিতর্ক অনুষ্ঠান। ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালের একটি বিতর্ক অনুষ্ঠান। আজকে অকস্মাৎ সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছে টরেন্টো প্রবাসী বন্ধু আব্দুল হালিম মিয়া। সেই স্মৃতির পেছনে আছে আরও অনেক কিছু...।’

উনার বন্ধু আব্দুল হালিম মিয়ার হাতে লেখা ডায়েরির একটি পাতার স্ক্যানকপিও সংযুক্ত করেছেন লেখার সাথে। যেই পাতায় লেখা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ বিতর্ক অনুষ্ঠানের কথা, যার সূত্র ধরে রিয়াজ ভাইয়ের কলম দিয়ে বেরিয়ে এলো ৩৭ বছরের পুরনো ইতিহাসের একটি অধ্যায়!

এই লেখায় রীয়াজ ভাই তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে—শিক্ষাজীবন, রাজনীতি, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চাসহ লিখেছেন তার্কিক হিসেবে উনার ‘স্বর্ণ সময়’ নিয়ে।

এই পর্যায়ে এসে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংঘ’-এর কথা এবং তার পাশে আমার নামটি এসে পড়েছে। উনি লিখেছেন—‘...সেই জীবনের একটি বিশেষ দিক ছিল বিতর্ক চর্চা। এখনকার মতো বিতর্ক চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। দেশের একমাত্র টেলিভিশন হচ্ছে বাংলাদেশ টিভি, তার আকর্ষণীয় এবং দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা’।

‘...টেলিভিশনের বাইরে বিতর্কচর্চা সীমিত বললেও বাড়িয়েই বলা হয়। সেই সময়ে কাওসার চৌধুরী গড়ে তুলল বিতর্ক সংঘ। একেবারে অবিশ্বাস্য এবং অসাধ্য সাধনের চেষ্টা। ক্যামেরা-পাগল কাওসার চৌধুরী নিজেও বিতার্কিক, কিন্ত সংঘের এই কর্মকাণ্ডে তার সহযোগী হাতে গোনা।’

কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক স্টেটাস

‘এতে উৎসাহ জোগান টিএসসির পরিচালক জামান স্যার। হঠাৎ করেই বিতর্ক সংঘের উদ্যোগে, বলা যায় কাওসারের উৎসাহে ও ছোটাছুটিতে, আয়োজিত হলো একটি বিতর্ক। স্থান টিএসসি মিলনায়তন। সময় সকাল ১১টা, তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮১।—“তিরিশোর্ধ বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়”। একপক্ষে শিক্ষক, অন্যপক্ষে শিক্ষার্থী। প্রস্তাবের পক্ষে শিক্ষার্থীরা, বিপক্ষে শিক্ষকেরা। এমন একটা বিতর্কের কথা কেন ওর মাথায় এসেছিলো কাওসারই তা বলতে পারবে...’

এরপরে আগে-পরে অনেক কথা লিখেছেন রীয়াজ ভাই।

“এমন একটা বিতর্কের কথা” কেন এবং কীভাবে আমার মাথায় এলো সেটা বলার আগে একটু বলে নিতে চাই এই ‘ঐতিহাসিক বিতর্ক অনুষ্ঠানের’ পক্ষে বিপক্ষে যারা ছিলেন তাদের নাম! রীয়াজ ভাই উনার লেখায় উল্লেখ করেছেন- বিতর্কের বিষয় - “তিরিশোর্ধ {প্রকৃতপক্ষে ‘তিরিশোত্তর’} বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়”। এক পক্ষে শিক্ষক, অন্য পক্ষে শিক্ষার্থী। প্রস্তাবের পক্ষে শিক্ষার্থীরা, বিপক্ষে শিক্ষকেরা।

শিক্ষকদের দলে অংশ নিয়েছিলেন—অধ্যাপক কবির চৌধুরী, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আর শিক্ষার্থীদের দলে ছিলেন—মাহমুদুর রহমান মান্না, মাহবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ (এম এম আকাশ) এবং আলী রীয়াজ।

এই বিতর্ক অনুষ্ঠানটি একদিন ইতিহাস হয়ে যেতে পারে—সেটা কিন্তু সেই সময়ে মাথায় আসেনি। নিতান্ত জেদের বশে, অনেকটা আবেগাক্রান্ত হয়ে এবং বিতর্ককে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার প্রত্যয়েই এই চ্যালেঞ্জটি হাতে নেই! বিতর্ককে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কী করা যায় সেটা ভাবছিলাম অহরাত্রদিন!

হঠাৎ মনে হল—
বিতর্ক দিয়ে একটা ঝাঁকি দিতে হবে শিক্ষার্থীদের মাঝে! নইলে বিতর্ক সর্বজনপ্রিয় হয়ে উঠবে না! সে আশায় বিতর্কে ‘তার্কিক’ হিসেবে শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থীর বিষয়টি মাথায় আসে। সাথে সাথে আমাদের ‘বিতর্ক সংঘের’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বিতর্ক সংঘ) সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে সেই অনুষ্ঠানের বিষয় এবং অংশগ্রহণকারীদের বিষয়টিতে অনুমোদন নিয়ে নেই।

বলে রাখা ভালো—
সেই সময়ে আমাদের বিতর্ক সংঘের বিভিন্ন পদে এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন—শাহ আলম সারওয়ার, আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী, কাজী জেবুন্নাহার দিলা, কবির মোহাম্মদ আশরাফ আলম, সিনহা এম এ সাঈদসহ আরও অনেকেই। আমি ছিলাম সভাপতি এবং কাজী জেবুন্নাহার দিলা (তখন টেবিল টেনিসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন) ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

    কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক স্ট্যাটাস

ওই সময়ে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার্কিক ছিলেন আরও কজন। রীয়াজ ভাই ছাড়াও এম এম আকাশ (ঢাবির অর্থনীতির অধ্যাপক), কামাল চৌধুরী (কবি এবং অবসরে যাওয়া সচিব) প্রয়াত এস এম সোলায়মান (নাট্যকার, পরিচালক-অভিনেতা), রুবানা হক (বিজিইএমইএর বর্তমান সভাপতি), নাশিদ কামাল (শিল্পী), মেজবাহ কামাল (বর্তমানে ঢাবির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক) কামরুন্নাহার ডানা (তৎকালীন ব্যাডমিন্টনে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন)-সহ অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে বীরুপাক্ষ পাল (বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ), হোসেইন আখতার (বর্তমানে কী করেন জানা নেই), তারেক (বিটিভির তৎকালীন ইংরেজি খবর পাঠক)—এরা অনেকেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো তার্কিক ছিলেন। এ কজন বাদেও আরও অনেক তার্কিক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের প্রত্যেকের নাম এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না বলে ক্ষমা চাইছি।

ফিরে আসছি সেই ঐতিহাসিক বিতর্ক অনুষ্ঠানে!
১৯৮১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) যে অনুষ্ঠানটি আমরা আয়োজন করেছিলাম—সেটা দুটো দিক আজ আমি খুঁজে পাই। একটি দিক হলো—অত্যন্ত সুখকর এবং আনন্দময় দিক, অন্যটি—একটু ধূসর এবং মন খারাপের দিক। প্রথম দিকটি নিয়ে নতুন করে আলোচনার আর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

এবারে দ্বিতীয় দিকটি নিয়ে কিছু কথা!

আজ থেকে ৩৭ বছর আগে আমরা যে ধরনটি দিয়ে বিতর্ককে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম—সেই ‘বলয়’ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান তার্কিকরা কিন্তু বের হয়ে আসতে পারছেন না! সেই যে আমরা শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থীদের বিতর্ক দিয়ে শুরু করেছিলাম—আজও কিন্তু ওই ধরনটিই চালু রয়েছে। ‘ধরন’টি থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু বিতর্কের সেই বিষয়টিও (তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়) কিন্তু আজ অব্দি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার্কিকরা চালিয়ে যাচ্ছেন! এটা হতাশাব্যঞ্জক!

কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গিয়েছিলাম—কী কারণে জানি! টিএসসিতে দেখা হলো বর্তমান সময়ের কয়েকজন বিতার্কিকের সাথে। তারা হঠাৎ করেই জানাল তাদের ‘ছাত্র বনাম শিক্ষক বিতর্কের’ কথা—যেখানে তর্কের বিষয়টিও কিন্তু সেই ৩৭ বছর আগের দেওয়া (তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়)!

শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতর্ককে জনপ্রিয় করবার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম—তাতে এক ধরনের ‘চমক’ (নাকি গ্ল্যামার) দেয়ার ব্যাপার ছিল পরোক্ষভাবে! তাই বলে ৩৭ বছর পরেও কি সেই একই চমক কিংবা গ্ল্যামারের অনুকরণ থাকতে হবে? এখন আরও আকর্ষণীয় কোনো বিষয় নিয়ে কি বিতর্ক করা যায় না?

বিতর্ককে জনপ্রিয় করতে গিয়ে আমরা বোধহয় সেদিন মনের অজান্তে কিছু ক্ষতিও করে গিয়েছিলাম! ব্যাপারটা একটি গল্প দিয়ে বলি।

এক মা কিছুতেই তার তিন বছর বয়েসি বাচ্চাকে ওষুধ গেলাতে পারেন না! তাই একদিন বুদ্ধি করে একটি রসগোল্লার মাঝখানে ছোট্ট ট্যাবলেটটি এমনভাবে ভরে দিলেন যাতে বাচ্চাটি দেখতে না পায়। তারপরে প্লেটে করে রসগোল্লাটি বাচ্চার সামনে দিয়ে বললেন—বাবু রসগোল্লাটি খেয়ে নাও, আমি রান্নাঘর থেকে আসছি। মিনিট দশেক পরে মা রান্না ঘর থেকে ফিরে এসে বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করলেন—বাবু, রসগোল্লাটা খেয়েছো? বাচ্চার উত্তর: হ্যাঁ আম্মু, রসগোল্লাটি খেয়েছি, কিন্তু ওটার ভেতরে যে ‘বিচি’টা (ছোট্ট ট্যাবলেট) ছিল ওটা ফেলে দিয়েছি!

কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট

আমার মনে হয়—
আমরা কোনো কিছুকে জনপ্রিয় করবার জন্য যে মজাদার উপকরণগুলো ব্যবহার করে থাকি সেখানে অধিকাংশ সময় ‘মজাদার উপকরণগুলো’ হয়ে যায় মুখ্য আর মূল বিষয়টি যায় তলিয়ে! এ ব্যাপারটি বর্তমান সময়ের তার্কিকরা বিবেচনায় রাখলে খুশি হবো।

আবারো ফিরে যাই ৩৭ বছর আগে!
শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থীদের বিতর্কের ধারণাটি যখন রীয়াজ ভাইকে জানালাম—তখন উনি চমকে তাকালেন আমার দিকে! বললেন—এটা তোমার মাথায় এলো কী করে! আর বিষয়টিও তো চমৎকার! আমি রাজি।

আমি তখন হাতে চাঁদ পেয়ে যাই।
আমি রীয়াজ ভাইকে ধরে বসি। বলি—আপনি তাহলে আকাশ ভাই আর মান্না ভাইকে একটু রাজি করান এই বিতর্কে অংশ নিতে। উনি বললেন—আমাকে লাগবে না, তুমি সরাসরি গিয়ে বললে উনারা রাজি হয়ে যাবেন।

উনার পরামর্শমতো প্রথমেই গেলাম অর্থনীতি বিভাগের সেমিনারে। কপালগুণে আকাশ ভাইকে পেয়ে যাই ওখানেই। আর মান্না ভাইকে পেলাম ডাকসুর অফিসে। তখনো ডাকসু ভবন নির্মিত হয়নি। কলা ভবনের বাম পাশে দুই কী তিনটি কামরা নিয়ে পরিচালিত হতো ডাকসুর সকল কার্যক্রম। মান্না ভাই আর আকাশ ভাইও রাজি হয়ে গেলেন এক কথাতেই!

এবার শিক্ষকদের রাজি করাবার পালা।
প্রথমেই গেলাম অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায়। উনি অবশ্য ইংরেজি বিভাগের হলেও আমাকে আগে থেকেই চিনতেন ভালো! নাটক আর বিতর্ক দিয়ে আমি এর মাঝেই বেশ পরিচিত-মুখ হয়ে উঠেছিলাম। স্যারকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম আমাদের বিতর্ক অনুষ্ঠানের কথা। উনি স্বভাবসুলভ হেসে বললেন—বাহ বেশ তো! চমৎকার আইডিয়া। অন্য দুজন শিক্ষক যদি যান তাহলে আমিও যাবো তোমাদের বিতর্কে অংশ নিতে।

খুশিতে আমি দৌড়ে বেরিয়ে যাই উনার বাসা থেকে।
তখন ফুলার রোডে একটি শিক্ষক কোয়ার্টারে থাকতেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। দরজায় গিয়ে কলিং বেল টিপে দেখি কোনো শব্দ হচ্ছে না! আরও দুতিনবার কলিং বেল টেপাটিপি করে এবার কড়া নেড়ে দেই উনার বাসার দরজায়। কবির স্যার বারান্দাতেই ছিলেন বোধহয়। ভেতর থেকে গলার স্বর উঁচু করে জিজ্ঞেস করেন—কে? একটু ভড়কে গিয়ে আমি বলি—স্যার আমার নাম কাওসার, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিতর্ক সংঘ’ থেকে এসেছি আপনার সাথে একটু কথা বলতে। কয়েক সেকেন্ড পরে দরজা খুলে দিলো বাসার কাজের ছেলে।

বাসার ভেতরে ঢুকেই দেখি—
বারান্দায় একটি চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে উনি লেখালেখি করছিলেন। টেবিলে অনেকগুলো বই-খাতা-নোটবুক। আমি সালাম দিয়ে আমাদের (আমি আর শাহীনূর আলম) আসার কারণটি উপস্থাপন করলাম। উনি সাথে সাথেই বললেন—with pleasure! আমি কথাটি বিশ্বাস করতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করি—স্যার...? কবির স্যার এবারে একটু টেনে টেনে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন—I will go with my full pleasure! আনন্দে আমার তো তখন হার্ট ফেল করার দশা!

কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট

ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল তখন মোহসীন হলের প্রভোস্ট। থাকতেন ইন্টারন্যাশনাল হলের পেছনে বাংলোতে। উনার সাথে অবশ্য আবৃত্তি আর নাটকের কারণে বেশ খাতির ছিল আমার ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। উনাকে যখন বিষয়টি জানালাম—তখন উনি চিবিয়ে চিবিয়ে (উনি ওভাবেই কথা বলতেন) বললেন—বাহ বেশ তো! এমন একটি চমৎকার অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি বরং আনন্দিতই হবো নিশ্চয়! ...আচ্ছা কাওসার, আপনি আমার হলে (মোহসীন হল) এই ধরনের কিছু বিতর্ক আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের সাথে মিলেমিশে কিছু কাজ করুন না! আমি তো হতবাক—স্যারের কথা শুনে!

যাই হোক। শেষমেশ এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, মঙ্গলবার।
সকাল ১১টায় ছিল সেই বিতর্ক অনুষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি মিলনায়তনে ছিল সেই অনুষ্ঠান। সকাল সোয়া ১০টার মাঝেই টিএসসি মিলনায়তন কানায় কানায় ভরে গেল ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে। শিক্ষকদের জন্য দুটি সারি খালি রেখেছিলাম সামনের দিকে। সেখান থেকে একটি সারিতে প্রায় জোর করেই বসে গেল অতি-আগ্রহী ছাত্রছাত্রীরা!

এত শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখে আমি আমাদের বিতর্ক সংঘের একজনকে পাঠিয়ে নীলক্ষেত থেকে অতিরিক্ত কটি মাইকের হর্ন নিয়ে এসে বেঁধে দেই মিলনায়তনের বাইরে টিএসসির বারান্দায়। এরপরে ওখানেও দেখি ‘ঠাঁই নেই’ অবস্থা!

সকাল পৌনে ১১টায় বিতর্ক অনুষ্ঠানের দুদলই মিলনায়তনে উপস্থিত। শিক্ষার্থীরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়!

এর মাঝেই ঘটল দুর্ঘটনাটি!
টিএসসি মিলনায়তনে চেয়ারে জায়গা না পেয়ে অনেকেই তখন ফ্লোরে বসে আগেভাগেই পজিশন নিয়ে বসেছিল মঞ্চের খুব কাছাকাছি। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের গরমে এর মাঝেই একজন ছাত্রী হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল ফ্লোরেই! আমার কাছে সংবাদটি আসার সাথে সাথেই দৌড়ালাম মেয়েটির কাছে। জগে করে পানি এনে মেয়েটির মুখে পানির ছিটা দেয়ার পরে মেয়েটি চোখ খুলে তাকাল! আমি তার দুজন সঙ্গীকে সাথে দিয়ে বলি—আপনি রিকশায় করে মেডিক্যালে চলে যান। ওখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে যান। মেয়েটি বসল বেঁকে! ও বলল—আমি একদম ঠিক আছি, আমি অনুষ্ঠান দেখেই হলে ফিরব। আমি রোকেয়া হলে থাকি। কথা শুনে আমি বেকুব বনে গেলাম!

এর মাঝেই চলে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী। উনিই এই বিতর্ক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। সামনের সারিতে এসে বসলেন ড. আহমদ শরীফ, ড. আনিসুজ্জামান, ড. রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আজিজুর রহমান, আহমদ ছফা, ড. আব্দুল আলীমসহ আরও প্রায় ১৫/২০ জন ডাকসাইটে শিক্ষক। সবাই এসেছেন বিতর্ক উপভোগ করতে!

মিলনায়তনে তখন টানটান উত্তেজনা।
কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ১১টায় মঞ্চের পর্দা খুলে দেয়া হল। বিতর্ক সংঘের পক্ষ থেকে আমিই অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলাম।

     কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট

আমার স্বাগত বক্তব্যের পরে মঞ্চে আহ্বান জানানো হলো দুপক্ষের বিতার্কিকদের। বাঁ দিক থেকে মঞ্চে উঠে এলেন—অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ডান দিক থেকে মঞ্চে এলেন—মাহমুদুর রহমান মান্না, মাহবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ এবং আলী রীয়াজ। সবশেষে মঞ্চে আহ্বান জানানো হলো উপাচার্য ডক্টর ফজলুল হালিম চৌধুরীকে। বেশ রাশভারী মানুষ ছিলেন ফজলুল হালিম চৌধুরী। বেশ শীতল একটি মুড নিয়ে তিনি এসে বসলেন অনুষ্ঠানের সভাপতির আসনে।

মিলনায়তনে তখন মুহুর্মুহু করতালি আর আনন্দ-উল্লাসের চিৎকার!
আমি এবারে পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব ভিসি স্যারের কাছে হস্তান্তর করে উনার কাছাকাছি একটি চেয়ারে বসে পড়ি! ফজলুল হালিম চৌধুরীর কণ্ঠটাও ছিল বেশ ভারী! উনি ভারী গলায় মিলনায়তনের ছাত্রছাত্রীদের শান্ত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। পাঁচ সেকেন্ডের মাঝে মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো।

উপাচার্য ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংঘকে ধন্যবাদ জানালেন—এমন একটি অভিনব বিতর্ক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য। ধন্যবাদ জানালেন বিতর্ক অনুষ্ঠানের দুপক্ষকে। ধন্যবাদ জানালেন মিলনায়তনে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীকে।

এরপরে তিনি আহ্বান জানালেন বিতর্কের ‘পক্ষ’ অবলম্বনকারী দলের প্রথম বক্তাকে—প্রস্তাবের পক্ষে আলোচনা শুরু করবার জন্যে। শিক্ষার্থী দলের পক্ষ থেকে পোর্ডিয়ামে গেলেন আলী রীয়াজ। কোনো বক্তব্য রাখার আগেই মিলনায়তন ফেটে পড়ল করতালিতে! বোঝা গেল—পুরো মিলনায়তন ‘শিক্ষার্থী দলের’ পক্ষে।

বলে নেওয়া ভালো—বিতর্কের বিষয়—‘তিরিশোত্তর বয়সই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’-এর পক্ষে বলছেন শিক্ষার্থীরা আর বিপক্ষ দলে রয়েছেন শিক্ষক-দল! বিষয়ের পক্ষে প্রথম বক্তা আলী রীয়াজ খুব শীতল মেজাজে শাণিত যুক্তি দিয়ে উনার বক্তব্য রেখে চলেছেন। শিক্ষার্থীরা কানফাটা করতালি দিয়ে আলী রীয়াজের কথায়/যুক্তিতে সমর্থন দিয়ে চলেছে। আট মিনিটের মাথায় আলী রীয়াজ বক্তব্য শেষে ফিরে গেলেন আসনে।

এরপরে বিরোধী-দলের বক্তব্য রাখতে এবং আলী রীয়াজের যুক্তি খণ্ডন করতে এলেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমি ভেবেছিলাম মিলনায়তনে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বুঝিবা শিক্ষকদের সমর্থন দেবে না! কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার—শিক্ষার্থীরা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে করতালি দিয়ে স্বাগত জানাল ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। এরপরে দেখি—কথায় কথায় শিক্ষার্থীরা ‘সিক-স্যারকে’ও করতালি দিয়ে সমর্থন জানাল।

      কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট

ভিসি স্যার স্বরটা নামিয়ে আমাকে বললেন—ছাত্রদের সমর্থনটা কাদের দিকে বেশি—বুঝতে পারছো? ঠিক এই সময়ে এলো ‘ভগ্নদূত’! রেজিস্ট্রার অফিসে কী একটা জরুরি বিষয় দেখবার জন্যে ভিসি স্যারকে নাকি তখনই যেতে হবে তার অফিসে—জানাল ভগ্নদূত! ভিসি স্যার কিছুক্ষণের জন্য থামালেন অনুষ্ঠান। তিনি উপস্থিত সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে উঠে পড়লেন উনার অফিসের উদ্দেশে। যাবার আগে ড. আহমদ শরীফকে অনুরোধ জানালেন উনার স্থলে সভাপতির দায়িত্ব পালনের জন্য। সবাই করতালি দিয়ে সমর্থন জানালে শরীফ স্যার মঞ্চে সভাপতির আসনে গিয়ে বসলেন।

উনার পরিচালনায় শুরু হল বাকি অনুষ্ঠান 
শিক্ষার্থীদের পক্ষে এবারে পোর্ডিয়ামে এলেন এম এম আকাশ। বলে নেওয়া ভালো—এর মাঝেই আকাশ ভাই টেলিভিশন বিতর্কে শ্রেষ্ঠ তার্কিকের সম্মান লাভ করেছেন। তার ওপরে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত। উনি বলে গেলেন চমৎকার যুক্তি আর উপস্থাপনা দিয়ে।

এম এম আকাশের যুক্তি খণ্ডন এবং সেই পর্যায়ে নিজেদের বক্তব্য রাখতে পোর্ডিয়ামে এলেন ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। উনি তো বরাবরই কথার রাজা! নানান বিষয়ে উনার পাণ্ডিত্যের কথা সবাই জানেন। হেনা স্যার তার নিজের মতো করে উপস্থাপন করলেন তার বক্তব্য।

সবশেষে দুপক্ষের দলনেতাদের বক্তব্যের পালা
শিক্ষার্থীদের পক্ষে মাহমুদুর রহমান মান্না, আর শিক্ষকদের পক্ষে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। উনারা আট মিনিট করে বলার পরেও দুমিনিট করে সময় পেলেন দলনেতা হিসেবে অতিরিক্ত বক্তব্য এবং যুক্তি খণ্ডনের জন্য।

সবার বক্তব্য শেষে শরীফ স্যার ঝানু কূটনীতিকের মতো একটি কাজ করে বসলেন। যেহেতু এই বিতর্কে কোনো বিচারকের বিষয় ছিল না, সেহেতু শরীফ স্যার উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের ভোটাভুটি দিয়ে দুপক্ষকেই জিতিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন—দুপক্ষই আজ বিজয়ী!

এই বিতর্ক অনুষ্ঠানে কে কী বক্তব্য রেখেছিলেন সেটা আজ পুরোপুরি আমার মনে নেই। তবে আমরা ক্যাসেটে ধারণ করে রেখেছিলাম পুরো অনুষ্ঠানের বক্তব্য। কিন্তু দীর্ঘ এতগুলো বছরে কয়েকবার বাসা বদলাতে গিয়ে সেই ক্যাসেট যে কোথায় রেখেছি—এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না!

এই অনুষ্ঠান নিয়ে সেই সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর আলোচনা এসেছিল নানান ফর্মে! সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ইত্তেফাক, সংবাদ, হলিডে আর অবজারভার পত্রিকায় বিশাল আলোচনা এসেছিল। বিচিত্রা এই অনুষ্ঠান নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল। হলিডে আর অবজারভার লিখেছিল প্রধান সম্পাদকীয়। সবগুলো পত্রিকাই আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল। সে কারণেই গতকাল বলেছিলাম—বেশ কিছু দলিলাদি উপস্থাপন করেই এই লেখাটি সম্পন্ন করব। কিন্তু দুঃখের বিষয়—একটি পত্রিকাও এখন খুঁজে পাচ্ছি না! আমি লজ্জিত!

তবে, সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, রীয়াজ ভাইয়ের বন্ধু—টরেন্টো প্রবাসী বন্ধু আব্দুল হালিম মিয়ার হাতে লেখা ডায়েরির পাতাটি একটি বড় দলিল হিসেবে এখানে জ্বলজ্বল করছে! আর খোদ রীয়াজ ভাইয়ের আবেগমিশ্রিত স্মৃতিকথা আমাদের টেনে নিয়ে যায় আজ থেকে ৩৭ বছর আগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে!

       কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট

রীয়াজ ভাই এবং আব্দুল হালিম মিয়া ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের অসাধারণ কর্মের জন্য। শুধুমাত্র উনাদের দুজনের কারণেই এই অসাধারণ বিষয়টি উঠে এলো এতগুলো বছর পরেও!

শিক্ষক দলের দুজন শিক্ষক আজ আর নেই
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আর ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। উনাদের আত্মার প্রতি সম্মান জানাই। উনাদের আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।

শিক্ষার্থী-দলের সদস্যদের মাঝে রীয়াজ ভাই সুদূর আমেরিকায় বসবাস করছেন শিক্ষকতা নিয়ে। মান্না ভাই ভিন্নতর রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশেই আছেন। আকাশ ভাই শিক্ষকতা করছেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই।

বিতার্কিক রুবানা হক এখন ব্যবসা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শাহ আলম সারওয়ার এফবিসিসিআই ব্যাংকের এমডি। নাশিদ কামাল একজন বড় মাপের শিল্পী। বীরুপাক্ষ পাল একজন নামকরা অর্থনীতিবিদ। কামাল চৌধুরী এখন ডাকসাইটে আমলা-কবি! মেজবাহ কামাল ডাকসাইটে অধ্যাপক। কাজী জেবুন্নাহার দিলা, হোসেন আখতার, তারেক, সিনহা—এরা কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না! জানি না কামরুন্নাহার ডানা কোথায় আছেন! আমাদের সময়ের আরও অনেক বিতার্কিকরা সারা দেশে হয়তো ছড়িয়ে আছেন, কিংবা দেশের বাইরে কোথাও!

আসলে সময়গুলো খুব দ্রুত চলে যায় 
চলে যায় আমাদের জীবন। কেবল স্মৃতিগুলো পড়ে থাকে কারো ডায়রির পাতায় কিংবা হৃদয়ের মধ্যিখানে!

টরেন্টো প্রবাসী আব্দুল হালিম মিয়া ভাই এই পোস্টটি না দিলে হয়তো আমাদের সেই সোনালি সময়টি হারিয়ে যেত নীরবে, কালের গর্ভে!

হায়...,
জীবন আসলে ও রকমই! মান্না দে’র গাওয়া সেই গানটির মতো—‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই! একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালী নেই! কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়। কতজনই এলোগেলো কতজনই আসবে কফি হাউজটাই শুধু থেকে যায়...!’

রীয়াজ ভাই, হালিম ভাই কিংবা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার—সবাই একসময় হারিয়ে যাবেন, বিদায় নেবেন পৃথিবী থেকে! আমরা, আমাদের সেই সব বিতার্কিকদেরও রেহায় নেই মৃত্যুর হাত থেকে। কিন্তু থেকে যাবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! থেকে যাবে কিছু স্মৃতি, কিছু গান, কিছু মান-অভিমান, লড়াই-সংগ্রামের কিছু কথা! এই নিয়েই তো আমাদের জীবন!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বিতার্কিকদের জয় হোক।
জয় হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

প্রিয় সংবাদ/কামরুল/আজাদ চৌধুরী