কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

প্রতীকী ছবি

ধর্ম এবং উৎসব, ‘মি টু’ আর ‘হিম টু’

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০১
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০১

এক.

দুর্গাপূজা শেষ হলো। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব এটি। অবাঙালিদের ক্ষেত্রে দেয়ালি, গণেশ পূজা বা অন্যান্য উৎসব প্রধান হলেও বাঙালি হিন্দু বলতেই দুর্গোৎসব। মুসলমানদের যেমন ঈদ। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে এ দুটিই প্রধানতম উৎসব। এ দুটিতে ‘কমন’ হলো ‘উৎসব’ বিষয়টি। ‘ঈদ’ আর ‘দুর্গা’ হলো ধর্ম। আমাদের দেশের সর্বসাধারণ ধর্মটা ঠিক রেখেই উৎসবে শরিক হন, পশ্চিমবঙ্গেও হয়তো তাই। এ নিয়ে সর্বসাধারণের মধ্যে কোনো ধর্মীয় ‘অহং’ কাজ করে না, শুভেচ্ছা বিনিময়েও কোনো কার্পণ্য থাকে না।

তবে গণ্ডগোলটা ‘অসাধারণ’দের বেলায়। ‘নিও-সেক্যুলার’ ও ‘নিও-ফান্ডামেন্টালিস্ট’ নামক এই অসাধারণরা ঝামেলা বাধাতে মাহের। এনারা উভয়েই উৎসবের সাথে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেন। এক দল আছেন দুর্গার ছবিসহ অন্যধর্মের মানুষকে শুভেচ্ছা পাঠান, অন্য দল আরবি শব্দে বা মিনারের ছবিতে ঈদের। ইসলামে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ। সুতরাং একজন মুসলমানকে দুর্গার ছবি দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠানোটা কতটা উচিত, তা একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন হয় না ‘নিও-সেক্যুলার’দের। আবার অন্যরাও ভেবে দেখেন না, মিনারের ছবি হিন্দুদের মনেও আঘাত দিতে পারে। এই দুই ‘নিও’র ছবি কাণ্ডে বিভ্রান্ত হন অনেক সর্বসাধারণও। তারাও না বুঝেই ফলো করতে থাকেন ‘নিও’দের। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই শুভেচ্ছার গণেশটা উল্টে যায়, শুভর আকাঙ্খা পরিণত হয় বিরক্তিতে।

ধর্ম আর উৎসব যদি আলাদা হয়, তবে শুভেচ্ছাতে দুর্গা বা মিনারের ছবি পাঠানোটা কী খুব জরুরি? শুভেচ্ছা কি ছবিতে থাকে? ছবি পাঠানোসহ এমনসব অদ্ভুত কসরতেই ‘নিও-সেক্যুলার’ আর ‘নিও-ফান্ডামেন্টাল’দের মিল। সেক্যুলাররা মনে করে দুর্গার ছবি পাঠানো মানেই নিজের সেক্যুলারিত্বের প্রমাণ, অন্যপক্ষ মনে করে মিনার পাঠানো মানেই নিজ ধর্ম-সত্তার নিদর্শন। তাদের এমন উদ্ভট চিন্তার কারণেই প্রতিবার উৎসব খানিকটা হলেও ম্লান হয়, ধর্মের মূল চিন্তাটাও সাথে হোঁচট খায়। দুয়ের মাঝে জেগে থাকে ‘নিও-সেক্যুলার’ আর ‘নিও-ফান্ডামেন্টাল’দের যন্ত্রণাময় অহংবোধ।

দুই.

‘মি টু’র পর শুরু হয়ে গেছে ‘হিম টু’। এদিকে ‘মি টু’র ধাক্কায় হলিউডের পর বলিউড লণ্ডভণ্ড। অভিযোগের পর অভিযোগ উঠছে। বেশিরভাগই বিগত যৌবনাদের যৌনতার স্মৃতি বা ক্যারিয়ারে উঠতি ও পড়তিদের যৌন হেনস্তার গল্প। অনেকে বলেন, এগুলো আসলে এক ধরনের প্রচার কৌশল। বিগত যৌবনা, পড়তি আর উঠতি ক্যারিয়ারদের নিজকে বিস্মৃত হতে না দেওয়ার প্রাণপন প্রচেষ্টা। এমন প্রচেষ্টাকে ‘অ্যাটেনশন সিকিং’ এবং প্রচেষ্টারতদের ‘অ্যাটেনশন সিকার’ বলছেন তারা। এমন বলাকে ‘কথার কথা’ হিসেবে উড়িয়ে দেওয়াও কী খুব সহজ?

নিজ স্বার্থে শরীর ব্যবহারের গল্প অতীত থেকে হাল জামানায় নেহাতই কম নয়। অনেকের মতে, কারো কারো ‘মি টু’ও শরীরের দ্বিতীয় ব্যবহার। একবার উঠতে গিয়ে, আবার পতন ঠেকাতে। আইটেম গানে অভিনয়ের চেয়ে শরীরী গল্পটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এদের ‘মি টু’তেও তাই। বলিউড থেকে হলিউড সব জায়গাতেই চান্স বাগানোর এমনই বহু গল্প ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। সাথে রয়েছে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’য়ের কাহিনিও।

‘মি টু’র সফলতায় কিংবা প্রতিরোধে এখন ‘হিম টু’র আবির্ভাব ঘটেছে। এখানেও হয়তো নারী সেলিব্রেটিদের বিরুদ্ধে উঠে আসবে হেনস্তার গল্পগাথা। ‘খ্যাতিমতি’রা বিব্রত হবেন। বিপরীতে অভিযোগকারীরা হবেন আলোচিত। সাথে একই মুদ্রার উল্টোপিঠের দর্শন পাবেন আমাদের মতন সর্বসাধারণ। তবে ‘হিম টু’র সাফল্য নিয়ে একটু সংশয় রয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা নিজেদের বীর ভাবেন। তাই অনেকের অত্যাচারী পরিচিতি পেতে আপত্তি না থাকলেও অত্যাচারিত বলে বিচারপ্রার্থী হতে পৌরুষে বাধার কথা।

উদাহরণ দিই। ‘হিম টু’র আবির্ভাবের কথা জানিয়ে বিবিসি এক তরুণের মাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘আমার ছেলে এখন ডেট করতেও ভয় পায়, যদি সেও যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত হয়, এমনটা ভেবে।’ কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ওই তরুণ কিন্তু মায়ের অমন কথায় সায় দেননি। ওই যে বললাম, পৌরুষে বাধার কথা, তার হয়তো পৌরুষে বেধেছে।

ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালত পরকীয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ অন্যের স্ত্রীকে যে কেউ তার নিজ ইচ্ছার কথা জানাতে পারবেন। স্ত্রীও অন্যের সাথে গড়তে পারবেন মানসিক ও শারীরিক সম্পর্ক। এখন গল্পটা যদি এমন হয়, একজন স্ত্রী তার স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে তৃপ্ত নন, এক্ষেত্রে তার অপশন কী? শরীরের জন্য প্রেমিক দরকার আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য স্বামী, এমনটাই নয় কী। দু’দিক বজায় রাখতে গিয়ে যদি বিষয়টি ধরা খেয়ে যায় তখন কী হবে? কী আর হবে, শরীরের চাহিদার চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজনটাই বেশি। এমন সূত্রে নিশ্চিত বলির পাঠা হবেন প্রেমিকটি, হবেন ‘মি টু’তে বধ। অথবা প্রেমিকটির যদি পৌরুষে না বাধে তাহলে হয়তো বলবেন, বিত্তশালীনির চাপে পড়ে উল্টো তিনিই ‘হিম টু’র শিকার।

তিন.

অনেকে বলবেন, ধর্ম আর উৎসবের সাথে ‘মি টু’ আর ‘হিম টু’র আলাপটা যায় কী করে। সত্যিই যায় না, যাওয়া উচিতও নয়, তবে একটা জায়গা বাদে। জায়গাটা হলো ‘অ্যাটেনশন সিকিং’য়ের। অনেক ‘মি টু’ আর ‘হিম টু’দের মতন ‘নিও-সেক্যুলার’ আর ‘নিও-ফান্ডামেন্টাল’রাও ‘অ্যাটেনশন সিকার’। তারাও চায় ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে নিজেরা আলোচনায় থাকতে, আলাপের জায়গা আর তাদের মিলটা এইখানেই।

পুনশ্চ: লক্ষ্য করবেন ‘মি টু’ ও ‘হিম টু’র আলোচনার ক্ষেত্রে আমি ‘অনেকে’, ‘কারো’ এমন শব্দ ব্যবহার করেছি। সুতরাং গড়ে সবাইকে বলা হয়েছে এমনটা ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। আর ‘মি টু’ আর ‘হিম টু’র সব কাহিনীই যে ‘অ্যাটেশন সিকিং’ তা কিন্তু নয়, এরমধ্যে পথ ভুলে ঢুকে পড়েছে অনেক সত্যিও। যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে অনেকে না বুঝেই ‘নিও-সেক্যুলার’ আর ‘নিও-ফান্ডামেন্টালিস্ট’দের ফলো করেন, তেমনই আর কী।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]