কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

হাসান ইমাম, মামুনুর রশীদ, মুশফিকুর রহমান গুলজার, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আব্দুল আজিজ ও চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

‘সংকটে’ চলচ্চিত্র, মুক্তি কোন পথে?

মিঠু হালদার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২৩:১৮
আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২৩:১৮

(প্রিয়.কম) চলতি বছরে ঈদুল আজহা পর্যন্ত দেশীয়, যৌথ প্রযোজনা ও আমদানি-রফতানি মিলিয়ে ৩৩টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এর বেশির ভাগ দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করেনি বলে অভিযোগ বিভিন্ন মহলের। গেল ঈদুল আজহার পর ছবি মুক্তি পেয়েছে মাত্র একটি। যদিও গত বছর এ সময়ে ছিল ভিন্ন চিত্র। কিন্তু চলচ্চিত্র অঙ্গনে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং চলছে আগের মতোই। দৃশ্যত অন্য সব বিষয় ঠিকঠাক থাকলেও ঠিক নেই শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ।

১৭, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয় প্রিয়.কমের। এই তিন দিনের আলাপে উঠে এসেছে সংকটের বহুমাত্রিক চিত্র; মিলেছে সমাধানের পথও।    

বাংলাদেশের নামী অভিনেতা, আবৃত্তিকার, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। চলচ্চিত্র বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয়ে তার মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। যৌথ প্রযোজনা নিয়ে শুরুতে যে নীতিমালা হয়, সেটি তার হাত ধরেই তৈরি। 

চলচ্চিত্রের বর্তমান সংকট নিয়ে হাসান ইমাম বলেন, ‘এখন সিনেমায় একটা ক্রাইসিস মোমেন্ট (সংকটকালীন মুহূর্ত) চলছে। আর কবে যে স্বস্তিটা ফিরে আসবে, সেটা বলা মুশকিল। তবে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে আলাপ-আলোচনা সবই হচ্ছে। কিন্তু সিনেমা নির্মাণের যে কাজটা, সেটাতে ঘাটতি আছে। আমরা যখন এই জায়গাটাতে বেশি ফোকাস করতে পারব, তখন আর এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হব না।’

বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রে যে কয়েকটি ইস্যু ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে, তার মধ্যে একটি যৌথ প্রযোজনায় আইন না মেনে সিনেমা নির্মাণের অভিযোগ। এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ এ অভিনেতার ভাষ্য, ‘যৌথ প্রযোজনার নীতিমালাটা আমার প্রণয়ন করা। যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো যদি মানা হয়, তাহলে আমাদের দেশের কোনো ক্ষতি হবে না।’

‘যদিও সেগুলো পুরোপুরিভাবে মানা হয় না। যে আইনগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য দিয়ে মেনে চললে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের লোকজনই ফাঁক-ফোকর খুঁজে। আসল জায়গা ঠিক না করে ভিন্ন জায়গা নিয়ে মাতামাতি করলে তো হবে না।’

চলচ্চিত্র অভিনেতা, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক মামুনুর রশীদ এ সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন হল কমে যাওয়া ও ‘চলচ্চিত্রের সংস্কৃতি’তে এক ধরনের বিপর্যয় ঘটে যাওয়াকে।

‘আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সিনেমা হলগুলোতে; ১৪০০ থেকে ২৫০-এ নেমে এসেছে। এখন বেশির ভাগ সিনেমা হলে গিয়ে বসে সিনেমা দেখার পরিবেশ নাই। যারা লগ্নিকারক কিংবা মালিক; তারা এটাকে এখন আর ইন্ডাস্ট্রি ভাবছে না। শুধু সিনেপ্লেক্সে মেনটেইন করলে তো আর ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াবে না। আর মানসম্পন্ন কাজ করার কিন্তু এখন একটা সময় এসেছে’, বলেন মামুনুর রশীদ।

‘অনেক তরুণ চলচ্চিত্র বানাচ্ছে। আমাদের এখানে সিনেমার কালচারটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সিনেমা তো একটা সময় ছিল ডোমেস্টিক সেলিব্রেশন। সেই কালচারটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে একটা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আমার মনে হয়, এটা আস্তে আস্তে মিটবে। যতদিন না সিনেমা হলের দুর্দিন কাটবে, ততদিন সিনেমার এ সংকটও কাটবে না’, যোগ করেন গুণী এই অভিনেতা।

চলচ্চিত্র নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে এই অভিনেতা বলেন, ‘সিনেমার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর একটা ব্যক্তিগত উৎসাহ আছে। কিন্তু এ ছাড়া অন্য যারা আছেন, তাদের সহযোগিতা তেমন পাওয়া যায় না। মন্ত্রী লেভেলের যারা আছেন, তাদের ফিল্মের কী হলো, তা নিয়ে ভাবনার সময় নাই। এ সমস্যার সমাধান হয়তো একটা বের হবে। আমরা ওয়েট করে দেখি কী হয়।’

দীর্ঘদিন ধরেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত মুশফিকুর রহমান গুলজার। সরকারিভাবে সিনেমার নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তার উপস্থিতি রয়েছে। বর্তমানে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নির্বাচিত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

গুলজার মনে করেন, সিনেমার এই সংকটের জন্য দায়ী আমদানি করা চলচ্চিত্রগুলো। তার ভাষ্য, ‘এই ছবিগুলো আমাদের ভালো ছবিগুলো যখন মুক্তি পায়, তখন তাদের ঘাড়ের উপর উঠে বসে। এটার সাথে যোগ হয় এখানকার একটি প্রতিষ্ঠান, যারা হলের মেশিন নিয়ন্ত্রণ করে।’

‘আমাদের যারা প্রযোজক, তারা অনেক সময় ছবি রিলিজ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে সে একটা বিশাল লোকেশনের মুখে পড়ে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নেয়। এখন তো প্রযোজকরা ছবি বানাতে ভয় পায়। এরা তো বাংলা ছবিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার একটি নীলনকশা করেছে।’

চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মনে করেন বর্তমানে চলচ্চিত্রের এ সংকট দূর করার জন্য ‘আমাদের দর্শকটা কারা, তাদের জন্য কেমন জায়গা দরকার, তারা কোন ধরনের গল্প চায়’-এই তিনটা বিষয় বুঝতে হবে। তিনি বলেন,‘আমরা যদি এখনো সেই পুরনো মডেলে পড়ে থাকি, মানে সিনেমা নির্মাণ ও মুক্তির প্রসেসের কথা বলছি, তাহলে ভুল হবে। মূল কথা হলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।’

‘ডুব’ ছবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রশংসিত হওয়া এই নির্মাতা বলেন, ‘এখনকার সিনেমার বাণিজ্য বেশির ভাগ সময় শাকিব খানের ওপর নির্ধারণ করে। কিন্তু সে তো বছরে ৫২টা ছবি করতে পারবে না। তাই শাকিব খানের বাইরে গিয়েও ছবি বানাতে হবে। কারণ সে ছবিরও আলাদা দর্শক আছে। তখন ইন্ডাস্ট্রিটাতে এ প্রবলেমগুলো থাকবে না। আর এ দর্শকরা ছবি দেখতে চায় মাল্টিপ্লেক্সে, আরামদায়ক পরিবেশে। কিন্তু তাদের ধরে রাখার জন্য আমরা কিন্তু প্রপার মাল্টিপ্লেক্স বানাই নাই। আর এখন পাইপলাইনে যে তরুণ মেকাররা আছে, তারা নানানভাবে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ওয়েতে গল্প বলছে।’

‘এই যে যারা গল্প বলছে, তারা যখন সিনেমা বানাবে, তখন তাদের কাজগুলো ত্বরান্বিত হবে যখন ঢাকা শহরের চার কর্নারে আরও চারটা মাল্টিপ্লেক্স থাকবে। বড় বড় শহরগুলো মিনিমাম দুটি করে মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণ হবে। আমি বলে দিতে পারি, তখন প্রতি সপ্তাহে রিলিজ দেওয়ার মতো এক ধরনের ছবিও রেডি থাকবে।’

তরুণদের চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ না থাকার বিষয়ে ফারুকী বলেন, ‘এ তরুণরা এখন বানাচ্ছে না, কারণ তারা এখন নানান আয়-ব্যয়ের হিসাব করছে। ভালো ছবির সংখ্যা যদি বাড়াতে হয়, সহজ সমাধান হচ্ছে ঢাকায় মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মানে বাকি সময়গুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্যরকম গল্পের ছবি দরকার।’

বাংলাদেশে এখন যে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত ছবি প্রযোজনা করছে, তার একটি হলো জাজ মাল্টিমিডিয়া। তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম ভাঙার বিভিন্ন অভিযোগ নানান সময়ে শোনা গিয়েছে।

চলচ্চিত্রের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আবদুল আজিজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সামনে ছবি নির্মাণ আরও কমে যাবে। অনেকদিন ধরেই কিন্তু সেন্সর বোর্ডে প্রদর্শনের জন্য কোনো ছবি নাই। গত কয়েক মাসে বেশ কিছু সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে গেছে। আমার হলগুলোতে মেশিন আছে, যার কারণে এখনো চলছে। একটি পক্ষ আছে, যারা শাকিব খান আর জাজের ছবি হলেই অ্যানি হাউ তারা বাধা দিবেই।’

‘পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি-এরা তো ক্ষমতায়; এরা নানানভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় লগ্নি করবে কারা? ভালো সিনেমা বানাতে হলে ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও ভালো থাকতে হবে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের বছর আর সিনেমা বানাব না।’

প্রভাবশালী এই প্রযোজক মনে করেন, ‘এখন যে অবস্থা দাঁড়াইছে, এখন আমদানি করা ছবি লাগবে; না হলে হল বাঁচবে না। যারা বেকার সমিতি, এরা চায় যারা সিনেমা বানাবে, তাদের সিনেমা কীভাবে বন্ধ করা যায়।’

আজিজের ভাষ্য, ‘পৃথিবীতে কেউ মেধা আলাদা করে ক্রিয়েট করতে পারে না। কিছু বিষয় আছে, যেটা ভেতরে থাকে। গভর্নমেন্ট টাকা দিয়ে মেধা ক্রিয়েট করতে পারবে না। তারা মেধা কাজে লাগানোর জন্য অর্থ দিতে পারবে। তাই আগে মেধা তৈরি করতে হবে। সরকার যতই হল বানাক না কেন, সিনেমা না থাকলে কী হবে?’

‘এখন যারা নেতৃত্বে আছে, মানে শিল্পী ও পরিচালক সমিতি, এরা যদি চেঞ্জ না হয়, তাইলে ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে। এরাই তো সমস্যার মূলে। এরাই ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করতেছে।’

‘মনপুরা’ ও ‘আয়নাবাজি’র মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। চলচ্চিত্রের সংকট ও উত্তরণের পথ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন সিনেমার একটা ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। আমি জানি না এখান থেকে রিকভার কতদিনে হবে, কেমনভাবে হবে। কিন্তু একটু একটু করে চেঞ্জ হচ্ছে। মাঝখানে আরও খারাপ অবস্থা ছিল। আমাদের যারা ডিরেক্টর, তাদের ভাবনাটাই জানি কেমন। একটা ইন্ডাস্ট্রি যখন দাঁড় করাইতে হয়, তখনকার অ্যাটিটিউড আর চলমান ইন্ডাস্ট্রির অ্যাটিটিউড কিন্তু এক নয়।’

‘আমাদের দেশে দর্শক তৈরির বিষয়টা মিক্সড। যদি কলকাতার ডিরেক্টরদের কথা বলি, তারা যে প্রফেশনাল ওয়েতে কাজ করছে, আমাদের এখানে সে বিষয়টা আসেনি। আমাদের কাজ করতে হবে ওটা ভেবে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা যাতে ভালোভাবে দাঁড়ায়।’

চলচ্চিত্রের মানের ওপর জোর দিয়ে এই অভিনেতা বলেন, ‘গত কয়েক বছরে দর্শকদের ওপর চাপাইয়া দিয়া তাদের রুচির দোষ দিচ্ছি। এটা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব প্রবলেম। দর্শক এত স্থুল রুচির কাজ দেখতে চায় না। এটা তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে দেখতে আমরা বাধ্য করেছি অথবা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতেছি, এটাই তোমাদের রুচি।’

‘আমরা যেন বছরে ১০-২০টা ভালো ছবি মুক্তি দিতে পারি। ভালো ছবি দেখে দর্শক যেন আবার হলে আসে, সে চিন্তা মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। দর্শককে টানে ও আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কথা মাথায় রেখেই সামনে এগোনো উচিত।’

বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা তুলে ধরে চঞ্চল বলেন, ‘আমাদের দেশে ভালো ডিরেক্টর, ভালো শিল্পী, সিনেমাটোগ্রাফারসহ সবই আছে। কিন্তু শুধু আন্তরিকতার কাজ করলেই সমস্যার সমাধান অনেকটা পাওয়া যাবে।’

‘মানে সিঙ্কটা করতে হবে। এভাবে যদি ধীরে ধীরে আগানো যায়, তখনই বাংলাদেশের সিনেমার জায়গাটা চেঞ্জ হবে।’

আসছে অক্টোবরে বেশ কয়েকটি তারকাবহুল সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এগুলোতে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, পরী মনি, মাহিয়া মাহি ও জয়া আহসানের মতো তারকারা।

৫ অক্টোবর পরীমনির ‘আমার প্রেম আমার প্রিয়া’ এবং মাহিয়া মাহির ‘পবিত্র ভালোবাসা’ মুক্তি পাবে। বেশ কয়েকবার মুক্তির দিন পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত ১২ অক্টোবর মুক্তি পাবে ফেরদৌস ও নিঝুম রুবিনা অভিনীত ‘মেঘকন্যা’ ছবিটি।

ঈদুল আজহায় একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল রোশান ও ববি অভিনীত বড় বাজেটের ছবি ‘বেপরোয়া’। ১২ অক্টোবরে বড় পরিসরে শতাধিক হলে সিনেমাটি নতুন করে মুক্তির কথা জানা গেছে।

প্রিয় বিনোদন/আজহার