কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

একটি অনুষ্ঠানে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য যুক্তি দেন, জনগণের মতামতের বা ভোটের প্রয়োজন নেই। ছবি: সংগৃহীত

স্ববিরোধিতা, হালের বুদ্ধিজীবী ও জন‘গণ’

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:০৩
আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:০৩

কলকাতার হালের বুদ্ধি ও সংস্কৃতিজীবী, গানের দল ‘চন্দ্রবিন্দু’ খ্যাত চন্দ্রিলের বক্তব্য শুনলাম। শোনার সূত্র হলো ফেসবুক, তাও একজনের শেয়ারের কল্যাণে। ‘কোথায়-কেন’, এসবের আগে চন্দ্রিলের মূল বক্তব্যে আসি। জনগণ, যাকে তিনি নিজ বক্তব্যে ‘গণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার ধারণায় সেই ‘গণে’র আসলে কোনো কিছু বুঝে উঠার ক্ষমতা নেই। সেই কারণেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ তাদের ভোটকেও সম্মান করার কিছু নেই। ‘গণ’ যে আসলে কিছু না এবং তাদের মতের ওপর আস্থা রাখা অর্থহীন, তিনি এমনটা বোঝাতে চেয়েছেন গোপী গাইনের সাথে বেদের মেয়ে জোছনার প্রসঙ্গ তুলে। সত্যজিতের সিনেমা ক্লাসিক গোপী গাইনের রেকর্ড ভেঙেছে জোছনা। সুতরাং ‘গণে’র কাছে গোপী আর জোছনার কোনো পার্থক্য নেই৷ মোদ্দা কথা ‘গণ’র আসলে ভালোমন্দের বোধই নেই, এমনটাই ধারণা চন্দ্রিলদের।

কিন্তু মুশকিল হলো এই চন্দ্রিলকে চিনে উঠা আমার পক্ষে একটু কষ্টকর হয়ে উঠছে। যিনি আনন্দবাজারে লেখেন, ‘লেঠেল দিয়ে দেশপ্রেম হয় না’, এমন কথা। যিনি বলেন, ‘নাগরিকের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, দেশের ভুল দেখলে, তা নিয়ে সরব হওয়া।’ বলেন, ‘দেশপ্রেম মানে স্তাবকতা নয়। ফেল করা ছেলেকে যে লোক পিঠ চাপড়ে “বহুত আচ্ছা” বলে, সে তার উন্নতি চায় না, অধঃপাতের রাস্তাটাই সুগম করে।’ এমন সব বক্তব্যের সাথে ‘গণ’কে নিন্দা করা কীভাবে, কেমন করে যায়, তার পাঠ বোঝা সত্যিই কষ্টকর। মানুষের বক্তব্য তখনই স্ব-বিরোধী হয়ে উঠে, যখন সে নাম বা পয়সা কামাতে চায়। এমন উদাহরণ অনেকই আছে। প্রথা কী, না জেনেই অনেকে প্রথাবিরোধী হয়ে উঠেন, এটাও স্রেফ নাম কামানোর জন্য। আর নাম কামানোটা হলো ইনভেস্টমেন্ট, যা থেকে পয়সা কামানোর রাস্তা খুলে যায়।

সে যা-হোক, ‘গণ’কে ‘গণ কেইস’ ভাবেন এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা হালের ঢাকাতেও নেহাত কম নয়। এই বুদ্ধিজীবীরাও সাধারণকে ‘গণ’ হিসেবে গণ্য করেন। ‘গণ’ মানে ‘গণ কেইস’ আর কী। ‘গণ’দের মতামত এবং ভোট কোনোটাকেই গুরুত্ব দিতে চান না তারা। অনেকটা আইয়ুব খানের মতো, যিনি গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের কথা বলতেন বেশি। সর্বসাধারণকে ‘গণ’ হিসেবে গণ্য করে তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়েও ব্যঙ্গ করতেন। এমন সব মানুষদের ধারণা, ‘গণ’রা কিচ্ছু বোঝে না, তাই তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হবে সর্বনাশের রুপান্তর। যেহেতু ক্রিকেট দলের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন কোচ, সুতরাং খেলোয়াড়দের মত প্রাধান্যের চিন্তা অবান্তর! বুঝুন অবস্থাটা! যাদের নিয়ে কাজ করবেন, তাদের ভাবনা বুঝবেন না, তাদের ইচ্ছা বুঝবেন না, সঙ্গতি বুঝবেন না, এর চেয়ে বড় বোকামি বোধহয় আর কিছুতে নেই। বুদ্ধিমান সেই কোচ, যিনি খেলোয়ারদের ভাবনা, ইচ্ছা, সঙ্গতি বুঝে জয়ের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন। উল্টো যারা নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে হেরে যান, আর সেই হারার দায় চাপান খেলোয়াড় তথা ‘গণ’র ওপর, তাদের আপনি কী বলবেন?

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’৷ সাহস করে প্রশ্ন করুন না, কে মানুষ করবে, আপনি কী করেছেন? ‘মহাজন’ হিসেবে তো দায়িত্বটা আপনার ওপরও ছিল, নিজের ব্যর্থতা দেশের ওপর চাপিয়ে পার পেয়ে গেলেন। জানি, রবি বাবু প্রয়াত হলেও এমন প্রশ্নে আপনার মহাপাপ হবে। এমন পাপ, যার প্রায়শ্চিত্তও নেই৷ তেমনি ‘গণ’কে অবজ্ঞা করা, অস্বীকার করা বুদ্ধি ও সংস্কৃতিজীবীরা যা বলে যাবেন তাই সত্য বলে বিনাবাক্যে মেনে নিতে হবে। নজরুলের ভাষায় বলতে হবে, ‘হুজুরের মতে অমতকার’৷ না হলে আপনিও ‘গণ কেইস’ মানে ‘গণে’র দলে।

শরৎচন্দ্র লেখার স্বার্থকতা নিয়ে বলতে গিয়ে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন এনাদের বিষয়ে, যা আজও সেই সব বুদ্ধিজীবীদের বোধের বাইরে। যারা সাধারণ মানুষের জন্য না লিখে বোদ্ধাদের জন্য লিখেন। যাদের লেখা সাধারণের অবোধ্য, তাদেরকে সরাসরি প্রবঞ্চক বলেছিলেন শরৎ বাবু। এই একটি শব্দ আর কথাতেই ‘গণ’বিরোধী সব যুক্তি নিমিষেই অসার হয়ে যায়। যে সাধারণকে ‘গণ’ আখ্যা দিয়ে চন্দ্রিলরা অবোধ বলছেন, তাদের সুবোধ করার দায়িত্ব কার? নিজে বুদ্ধিজীবী সাজতে চাইবেন কিন্তু মানুষকে বুদ্ধির ভাগ দেবেন না, এ কেমন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা! সমাজকে গালি দিবেন, মানুষকে মূর্খ জ্ঞান করবেন, বকাবাজি করবেন, কিন্তু ‘গণ’ থেকেই দূরে থাকবেন, এটা তো স্রেফ প্রবঞ্চনা। এই শ্রেণিটি আসলে সুবিধাবাদী। বেনোবনে শেয়াল রাজার মতন এনারাও চান ‘গণ’রা অবোধই থেকে যাক। ‘গণ’দের সুবোধ জাগ্রত হলে তো তাদের জায়গা নেই।

চন্দ্রিলের গোপী গাইন আর বেদের মেয়ে জোছনার উদাহরণটা বেশ মজার। সত্যি বলতে গেলে নিজেও মজা পেয়েছি। মজাটা ছিল মূলত লজিকের দীনতায়। খুব সহজভাবে চন্দ্রিলের লজিকটাকে কেটে দেওয়া যায়, একেবারে বাচ্চাদের কাটাকুটি খেলার মতন। যেমন, একই মানুষ একই সাথে কাবাব পছন্দ করেন, আবার শুটকি ভর্তাও আগ্রহ ভরে খান, এতে কি কাবাবের জাত যায়? মানুষ নীতিশাস্ত্র পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য, আবার ‘জোকস’ পড়ে আনন্দ আহরণের জন্য। চন্দ্রিলকে দিয়েই উদাহরণ দিই, মানুষ গোলাম আলী শোনেন সংগীতের গভীরতা অনুভবের মুগ্ধতায়, আর চন্দ্রিলের ‘গীতগোবিন্দ’ শোনেন অক্ষমতার বেদনায়। তাই বলে কী গোলাম আলী আর চন্দ্রিলের উপযোগিতা সমান হয়ে গেল।
শেষ কথা বলি, যে জ্ঞানীরা ‘গণ’র উপকারে আসেন না, তারা কোনো কিছুরই যোগ্য নন, কোনো পদেরও। ‘গন’কে বোঝেই জ্ঞানী হতে হয়। যারা শুধু জ্ঞানী সাজার জন্য বাক্যবাজি করেন, তারা মূলত নেতা নন, অভিনেতা। আর অভিনেতা দিয়ে ব্যতিক্রম বাদে আর যাই হোক নেতার কাজ চলে না।

ফুটনোট: জ্ঞান ও বিজ্ঞান শব্দ দুটির অর্থগত পার্থক্য রয়েছে, ক্ষেত্রও আলাদা। হালের ‘গণ’কে অবজ্ঞা করা জ্ঞানীরা, এই দুই জিনিসকে এক করে ফেলেছেন। দেখবেন, কাউকে বিশেষিত করতে ইদানীং তারা ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’ শব্দটা ব্যবহার করছেন। এনারা বোঝেন না, নীতিশাস্ত্র হচ্ছে জ্ঞান আর গতিশাস্ত্র হচ্ছে বিজ্ঞান। অথচ হামেশাই নীতি আর গতিকে এক হামানদিস্তায় পিষছেন তারা! বিপরীতে ‘গণ’রা এ দুয়ের পার্থক্যের ব্যাখ্যা না বুঝলেও, ব্যবহারের ক্ষেত্রটা বোঝে। বিষয়টা হলো, কলকাতার বাবুও নৌকার মাঝির মতন। সাঁতার না জানলে ষোল আনাই মিছে আর কী।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]