কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বিদেশি কার্টুন অবলম্বনে এঁকেছেন তানজিল রিমন

সমসাময়িক ভাবনা ও ‘তৈলব্রত’ বিষয়ক গল্প

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:৫০
আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৯:৫০

এক.

আমাদের জীবন আসলে নজরুল ছাড়া অচল। ‘পাবলিক’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ ‘জনসাধারণ’ বা ‘সর্বসাধারণ’, আর এই জন বা সর্বসাধারণের আরেক প্রতিশব্দ হলেন নজরুল। প্রতিটি পরিস্থিতি বা বিষয়ের সাথে নজরুলের লেখা যায়। জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিটি বিষয়ের আশ্চর্য রকম সাযুজ্যতা দেখা যায় নজরুলের লেখায়। সাম্প্রতিক সময়ে স্তুতি ও স্তাবকতা অর্থাৎ ‘তেল ও তৈলব্রত’ বিষয়ে চর্চা হচ্ছে বেশ। অন্যকথায় ‘মোসাহেব’ হচ্ছে চলতি আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। এমন বিষয়ে নজরুলের ‘সাহেব ও মোসাহেব’ উদ্ধৃতি হিসেবে অনবদ্য।

যেমন–মোসাহেবের কথনে নজরুল বলেন, সাহেব কহেন, “সেদিন বিকেলে বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।” মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ? কিবা অপরূপ গল্প!” সাহেবের গল্পটা শুরু না হতেই মোসাহেব বলেন ‘কিবা অপরূপ’।–এমন ‘অপরুপতা’র মিল কী খুঁজে পাওয়া যায় সমসাময়িকতায়? যায়।

সাহেব কহেন, “আরে ম’লো! আগে বলতেই দাও গোড়াটা!” মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা! হুজুরের গোড়া! এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!” –এই যে চুপ করিয়ে হুজুরের গোড়া শোনানোর মোসাহেবীয় ব্যস্ততা, তার ধরণ কী চোখে পড়ে না কোথাও? পড়ে।

সাহেব কহেন, “শোনো না! সেদিন সূর্য্য উঠেছে সকালে!” মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য্য? আমরা কিন্তু দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!” –সাহেবের চোখে সব দেখেন, এমন মানুষদের আমরা কী দেখি না, আশেপাশে তাকালে? দেখি।

আমাদের দেখা-শোনা-জানার বাইরে নয় কোনো কিছুই। সর্বসাধারণের সাথে নজরুলের পার্থক্য হলো নজরুল বলতে পারেন, সর্বসাধারণের বলার সাহস নেই। “প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!” –এমন বলার সাহস নজরুলেরই আছে। এমন ভাষায় বিনাশ কামনা নজরুলের দ্বারাই সাজে।

দুই.

মোসাহেব বিষয়ে পুরাতন গল্পটা নতুন করে বলি। মোসাহেবের কাজ হলো–সকাল-সন্ধ্যা রাজার স্তুতি গাওয়া। বিশেষ করে অত্যাচারী রাজাদের বেলায়। এমন রাজাদের সুনাম ‘সর্বসাধারণ’ প্রজারা করে না, করার সঙ্গত কারণও নেই। বরং আড়ালে-আবডালে, রেখে-ঢেকে যেভাবে পারে নিজেদের ক্ষোভই প্রকাশ হয় তাদের কন্ঠে আর আচরণে। ক্ষোভের কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে। তাই অমন রাজারা মোসাহেব পোষেণ। পোষা পাখির মতন মোসাহেবরা কারণে-অকারণে স্তুতিবাক্য গেয়ে যান।

এমনি মোসাহেব সহযোগে রাজা-রাণী বেড়াতে বের হয়েছেন। একসময় দেখা গেল, একটি বাড়ির আঙিনায় দরিদ্র ভোজন করানো হচ্ছে। রাণী এমন ভোজনের হেতু জানতে চাইলেন। বাড়ির লোকজন জানালেন, দীর্ঘদিন পরে এ বাড়িতে একসাথে তিন রমনীর সন্তান হয়েছে, তাই এই দরিদ্র ভোজনের আয়োজন। আর যায় কোথা, অভ্যাসে মোসাহেব বলে উঠল, মহারাণী এসবই মহারাজের কর্মযজ্ঞের ফল।

এবার বোঝেন, তিনি রমনীর তিন সন্তান, রাজার কর্মযজ্ঞ সাথে মহারাণীর অবস্থাটা। বলতে পারেন, ‘মোসাহেবের কথা তো বিশ্বাস করার কিছু নেই, স্তুতিবাক্য বলাই তো মোসাহেবের কাজ’। কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু মুশকিল হলো, হিটলারের মন্ত্রী গোয়েবলসকে নিয়ে। তার ধারণা ছিল, একটা মিথ্যা একশবার বললে তা মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। মহারাণীও হয়তো স্তুতির মিথ্যা শুনতে শুনতে অনেক কিছুই সত্য ভাবা শুরু করেছিলেন।

তিন.

হিটলারের রত্ন গোয়েবলস বিষয়ে বলতে গিয়ে আরেকটি গল্পের কথা মনে পড়লো। স্বর্গে তেল ব্যবসায়ীদের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় স্থান সংকুলানের সমস্যা হচ্ছিল। এমন তেল ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন ছিলেন মহা-ধুরন্ধর। সে ভাবছিল স্বর্গে এলাম আরাম করতে, আর এখানেও যদি চাপাচাপি করে থাকতে হয়, তাহলে স্বর্গে থেকে লাভ কী। সুতরাং কী করা যায়, ভাবতে বসলেন এবং বুদ্ধিও বের করে ফেললেন। দু’একজন করে তেল ব্যবসায়ীকে ডেকে গোপনে বলতে লাগলেন, ‘আপনাদের আপন ভেবে বলি, এবার নরকে তেলের আমদানি বেড়েছে অনেক’।

আস্তে আস্তে নরকে তেল আমদানির বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ল। ব্যবসায়ী বলে কথা, লাভের কথা শুনলে কী মাথা ঠিক থাকে! সবাই নরকে তেল আমদানির বিষয়টি বিশ্বাস করলেন। ফলাফল যা হবার তাই, সকল তেল ব্যবসায়ীর নরকযাত্রা। অতঃপর স্বর্গে ওই ধুরন্ধর একাকী থাকেন, আরামে খান, ঘুমান। কিন্তু মুশকিল হলো, তার মনের ভেতর সবসময় খচখচ করে। নিজের ছড়ানো কথাই তাকে উসকে দেয়, সেও নিজের বানানো গুজবেই বিশ্বাস করতে শুরু করে।

তার মনের ভেতর থাকা লোভী ব্যবসায়ী বলতে শুরু করে, সবাই যখন তেলের আশায় নরকে গেল, নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। তুইও যা, নইলে কিন্তু তোকে লোকসানে পড়তে হবে। আর যায় কোথা, নিজের সৃষ্ট মিথ্যাকে সত্য ভেবে সেই ধুরন্ধরও ছোটেন নরকের দিকে।

‘একটি মিথ্যাকে একশবার বললে সত্য মনে হয়’, গোয়েবলসের এ ধারণা যেমন আপাত সত্য, নিজ মিথ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে নরকযাত্রা বিষয়ক গল্পের মোরালটাও তেমনি আপেক্ষিক সত্য।

চার.

তেল বিষয়ে বলতেই স্বভাবত চলে আসে মহাজন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা। তিনি তেলমর্দক তথা স্তাবক বিষয়ে বলেছেন, ‘তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না—উকীলিতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না, বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোনো কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না। যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে’। তেলের গুনাগুণ বিষয়ক এর চেয়ে জ্ঞানগর্ভ রচনা আর নাই, আর রচনা করার মতন উপায়ও রাখেন নাই মহামহিম হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। সম্ভবত ১৯১৬ সালে লেখা ওনার ‘তৈল’ বিষয়ক রচনাটি সাম্প্রতিক সময়েও একইভাবে প্রযোজ্য।

রচনাটির শেষে শাস্ত্রী মহাশয় যে কথাটি বলেছেন, ‘এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে’। কথাটা কিন্তু প্রণিধানযোগ্য। এখনো যারা এমন কাজে সফল হতে পারেন নাই, তারা অহেতুক আফসোস না করে, মন ও চাকা ঘোরানোর কাজে লেগে যান।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]