কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বাবার কোলে শিশু আকিফার মরদেহ। ছবি: সংগৃহীত

বন্ধ হোক সড়কে হত্যাকাণ্ডের তামাশা

মানিক মুনতাসির
সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৪০
আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৪০

হয়তো সেই ছোট মেয়ে আকিফাও হতে পারত দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। কিংবা কোনো খ্যাতিমান চিকিৎসক, আইনজীবী বা অন্য কিছু। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নামক এক তামাশায় মেতে উঠে বাসের চালকের খামখেয়ালিপনা তাকে ভবিষ্যতের কোনো পথই ধরতে দিলো না। মায়ের কোলই প্রতিটি শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। সেই মায়ের কোলও পারল না আকিফাকে প্রাণে বাঁচাতে। বলছি কুষ্টিয়ায় বাস চালকের খামখেয়ালির খপ্পড়ে নিহত শিশু আকিফার কথা। আকিফা শুধু একাই মরেনি। চালক হত্যা করল একজন মমতাময়ী মায়ের আশা-ভরসাকে। বাবার চোখের কোণে, আজীবন জল জমিয়ে রাখবে সেই আকিফাকে না ভোলানোর কষ্ট। অবশ্য দেশ-জাতি মানুষ আমরা সবাই ভুলে যাব দু’দিন বাদেই। যেমনটি ভুলে গেছি উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্র হামীমের কথা। হামীমও দুর্ঘটনায় পড়েছিল ঠিক মায়ের হাতে থেকেই। মায়ের হাতও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ঘাতক বাসচালকের অসর্তকতার কারণে সেদিন কাকরাইলের রাস্তা লাল হয়েছিল ছোট্ট হামীমের রক্তে। হয়তো আমার এই লেখা পড়ে অনেকেই মনে করবেন আমি আবার কোন হামীমের কথা বলছি। হ্যাঁ, হয়তো ছয় মাস পর কেউ কেউ এই আকিফার কথাও ভুলে যাব। কোনো আলোচনায় আকিফার কথা তুললে হয়তো আমরা বলব সে আবার কোন আফিফা? আমাদের এই সোনার দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, একটার কথা মাথা থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে অন্যটার চাপে।

কোলে থাকা আকিফা আর তার মাকে বাসের ধাক্কা দেওয়ার ভিডিও দেখে স্থির থাকছি আমরা অনেকেই। হয়তো আমিও স্থির। অর্থাৎ প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে আমরা এসব দেখতে দেখতে রোবট হয়ে গেছি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কেননা এসব এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বাসের চালক, সরকারের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিনিধি এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরাও বোধহয় দিন দিন রোবটে পরিণত হচ্ছেন। অন্যথায় কেন কারও হুঁশ হচ্ছে না।

কতটা নির্মম আর বর্বর সেই বাসচালক! ওই চালক আদৌ স্বাভাবিক ছিলেন কিনা, সে প্রশ্ন আসতেই পারে। এই অমানুষেরা প্রতিদিন মানুষ হত্যা করছে। সেসব হত্যাকাণ্ডকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণও দেওয়া হচ্ছে। যা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। এসব কি ক্ষতিপূরণ? নাকি তামাশা। কেননা দৃশ্যত দেশের আইন-কানুন এসব ঘাতককে কতটা স্পর্শ করছে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। আবার এই সড়ক নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করলে বরং উল্টো জেলে যেতে হয়েছে, হচ্ছে–এমন উদাহরণের শেষ নেই।

একটা ঘটনা বলি। প্রতিদিনের মতো গত শুক্রবার আমার ছেলেকে আর্টের স্কুলে ড্রপ করতে রিকশাযোগে রওনা হলাম আমি। রাস্তার মাঝে হঠাৎ একটি অসুস্থ বিড়াল ছানা এসে পড়ল। মাত্র ৬ বছর বয়সী ছেলে আমার রিকশাচালককে চিৎকার করে বলল–আঙ্কেল আঙ্কেল আস্তে যান। বিড়ালটা ব্যথা পাবে। রিকশার চালকও গতি কমিয়ে বিড়ালকে রাস্তা পারপারের সুযোগ দিলেন। একটি অবুঝ শিশু একটি পশুকেও ব্যথা দিতে চায় না, অথচ আমরা মানুষরূপী বাস-ট্রাক, টেম্পু চালক হিংস্র হায়েনার মতো মানুষকে অকাতরে হত্যা করছি প্রতিনিয়ত।

প্রতি রাতের মতো আজও আপনি-আমি তো বটেই, এমনকি দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও হয়তো নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন। অবশ্য চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে আকিফাও। কিন্তু শিশুটির মা-বাবার কি ঘুম হবে কখনো? বাসের ধাক্কার ওই দৃশ্যটি এ জন্যই বোধ হয় আফিফার বাবা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে অনুরোধ করেছেন। হয়তো তিনি দেখেছেন কিংবা দেখবেন, অথবা দেখেননি। মাত্র ক’দিন আগেই এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রকে বাস থেকে পানিতে ফেলে হত্যা করেছেন বাসচালক আর তার সহকর্মীরা। সে ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়েছে কিনা, তার কোনো সুরাহা হবে কিনা, তা হয়তো আমরা অনুমান করতে পারি, তার আগে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়ক হত্যাকাণ্ড থেকে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ক’দিন আগে চট্টগ্রামে এক বাসযাত্রীকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে হত্যা করেছেন চালকের সহকারী। কই কেউ কি গ্রেফতার হয়েছে এ ঘটনায়। আচ্ছা কোনো মন্ত্রী-এমপি বা কোনো শীর্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার ছেলে-মেয়ে বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন যদি এমন অমানবিকাতর শিকার হতেন তাহলে কী ঘটত? আবার আমরা কিন্তু এটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে, তেমন কোনো ঘটনা কোনো দিন ঘটবে না। ফলে সময় থাকতে ‘সাধু সাবধান’ হওয়া অত্যন্ত জরুরি বৈকি।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে পথচারী পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফুটওভারব্রিজ নেই। আবার কোথাও কোথাও ব্রিজ থাকলেও পথচারীরা সেটা ব্যবহারে উদাসীন। জেব্রা ক্রসিং কোথাও কোথাও থাকলেও তার ব্যবহারের নিয়ম-কানুন পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ, বাস-ট্রাকের চালক কোনোপক্ষই মানি না। হয়তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর নিয়ম-কানুন জানিও না। তবে আকিফার মা যেখানে রাস্তা পার হচ্ছিলেন, সেখানে কিন্তু কোনো ফুটওভারব্রিজ ছিল না। আর বাসটিও তখন দাঁড়িয়েই ছিল। দাঁড়িয়ে থাকা বাসটি হঠাৎ চলা শুরু করবে–এটা কল্পনাও করতে পারেননি আফিফার মা। পারার কথাও নয়। কেননা নিশ্চয়ই ওই চালকের আর তার সহকারীর চোখ রয়েছে। এজন্য চালক স্পষ্ট দেখে-শুনে বাসটা চালিয়ে দিলেন। তাহলে কি এটা হত্যাকাণ্ড নয়। যদি তাই হয়। তাহলে কেন এটাকে সড়ক দুর্ঘটনা বলা হবে। এটাকে কেন হত্যাকাণ্ড বলা যাবে না। এটা হয়তো আইনের মারপ্যাঁচের ব্যাপার। যেহেতু আমি আইনের ছাত্র নই, ফলে সেদিকে আলোচনা পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই।

গরু-ছাগল আর গাছপালা চেনা বাস-ট্রাক, টেম্পু, লেগুনা ইত্যাদির চালকেরা মানুষ দেখেন না, মানুষ চেনেন না। এদের থামাতে না পারলে হয়তো একদিন মাথা ঠুকরে মরতে হবে। যেদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো মন্ত্রী কিংবা এমপি নিজের হাতে দেওয়া লাইসেন্সধারীর হাতে দুর্ঘটনায় পড়বেন। এমন দুর্ঘটনায় পড়তেই পারেন, কেননা এসব চালক তো অপ্রশিক্ষিত। তাদের বেশির ভাগেরই বৈধ লাইসেন্সই নেই। এরা জানমালের তোয়াক্কা না করে সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। এমন কোনো দিন নেই যে, বড় কোনো গাড়ির ধাক্কায় ছোট গাড়ির যাত্রী বা পথচারী মারা যাচ্ছে না। ক’দিন আগে গোপালগঞ্জ সদরের বিজয়পাশায় যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় মারা গেলেন মোটরসাইকেলের আরোহী সিহাব উদ্দিন। তার আগে কুমিল্লার বুড়িচংয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা গিয়ে ধাক্কা মারল গাছে। সেখানে নিভে গেল বাবা ও ছেলের জীবনপ্রদীপ। এরপর মানিকগঞ্জের ঘিওরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাসচাপায় মারা গেছেন পুলিশ কনস্টেবল আতাব আলী ও তার শিশুকন্যা ফাতেমা। আর কত? আর কতজন মারা গেলে এটাকে মিছিল বলা হবে। কানের ভেতরে পানি গড়াবে। তৎপর হবে সরকার। সরকারের মন্ত্রীরা তো আছেন শুধু মিডিয়া কাভারের জন্য। কে হেলমেট পড়লেন আর কে পড়লেন না, এই যেন তাদের কাজ। লাইসেন্স কারা দিচ্ছেন? কীভাবে দিচ্ছেন? আদৌ কী লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে? না কি লাইসেন্স ছাড়াই কেউ চালকের আসনে বসছে? ছাল-চামড়াবিহীন বাস কীভাবে রাস্তায় চলছে। কালো ধোঁয়ার কথা না-হয় বাদই দিলাম। ফিটনেস সার্টিফিকেট কারা দিচ্ছেন? কীসের ভিত্তিতে দিচ্ছেন। এত সব ঘটনা ঘটছে। কেন ঘটছে? কী তার প্রতিকার। আছে কি কারো মাথা ব্যথা?

ঈদের পর সড়কে যেন সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়ক হত্যাকাণ্ডে নিহতের ঢল নেমেছে। অবশ্য এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিদিনই যেখানে কোথাও কোথাও অকাতরে মরছে সেখানে ঈদের সময়ই বা মরবে না কেন? গত ৫৫১ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারের মতো।

অধিকাংশ চালকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করার সময় এসেছে। নয়তো তুচ্ছ ঘটনায় যাত্রীকে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে মারবে কেন? জীবন্ত যাত্রীকে চলন্ত বাস থেকে নদীতে ফেলে দেবে কেন? এসব প্রাণহরণকারী বাসচালক তো অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসেনি। তারা এ দেশেরই আলো বাতাসে বড় হয়েছেন। তাহলে কেন তাদের পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। এটা কি অসম্ভব কোনো বিষয়?