কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর দোষীদের বিচার, নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে স্কুলের শিক্ষার্থীরা

দুটি খবর, প্রশ্নবিদ্ধ সামাজিক নিরাপত্তা এবং প্রতিশোধের পরম্পরা

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০১৮, ২০:০৪
আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৮, ২০:০৪

সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনে একটি খবর দেখলাম, ‘খুনিকে পুড়িয়ে মারল বিক্ষুব্ধ জনতা’- এমন শিরোনামে। দিনাজপুরের বীরগঞ্জে রবিউল নামে একজনকে পুড়িয়ে মেরেছে সংঘবদ্ধ জনতা। সমাজবিজ্ঞান যাকে অবহিত করে ‘ক্রাউড’ নামে। রবিউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে সুরুজ নামে একজনকে কুপিয়ে মেরেছে, দুজনকে গুরুতর আহত করেছে। এর আগেও সে আরেকজনকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু সর্বশেষ সুরুজ মিয়াকে হত্যার পর লোকজন খেপে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে এবং রবিউলকে ধরে এনে সড়কেই পুড়িয়ে মারে। রবিউলের পুড়ে যাওযা মৃতদেহটি পুলিশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায়। রবিউলকে পুড়িয়ে মারার আগে ‘ক্রাউড’ রবিউলের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং রবিউলের স্বজনরা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায়।

এমন ঘটনাই হলো ‘মব জাস্টিস’, রবিউলকে পুড়িয়ে মারা হলো ‘লিঞ্চিং’। এর আগেও এমন শঙ্কা থেকেই লিখেছিলাম, ‘মব জাস্টিস কি অপরাধ, না বিচারিক অসহায়ত্ব’, এমন লেখা। তখনই শঙ্কা ছিল, কয়েকটি ঘটনায় লক্ষণও দেখা গিয়েছিল ‘ক্রাউড’ সংগঠিত হবার। মব জাস্টিস আর লিঞ্চিং এমন অবস্থায় অবশ্যম্ভাবী। তখন তেমন কেউ গুরুত্ব দেয়নি, ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে। এখনো হয়তো তেমন কেউ গা করবেন না; বলবেন, এসব অতিরিক্ত চিন্তা। তা বলুনগে, আমাদের কাজ লিখে যাওয়া, লিখে যাই। অন্তত ইতিহাস তো বলবে আমাদের কাজটি আমরা করেছিলাম।

এই যে রবিউলকে পুড়িয়ে মারার খবরটি, এতে রবিউলের বিরুদ্ধে মানুষকে কুপিয়ে মারা এবং আহত করার অভিযোগ ছিল। এর আগেও কুপিয়ে মানুষ মেরে বহাল তবিয়তে ছিল সে। অর্থাৎ তার একটা প্রবল শক্তি ছিল এবং তা আইনকে ছাপিয়ে যাবার, অস্বীকার করার মতন শক্তি। না হলে সে একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস পেত না। মানুষ হত্যার মতন সাহস এবং শাস্তিকে এড়িয়ে যাবার মতো শক্তি, এ দুটোকে ভয় পেত মানুষ। মনোবিজ্ঞান বলে, ভয়েরও একটা নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে, সেই মাত্রাটা কেটে গেলে মানুষ ভাবলেশহীন হয়ে যায়, ভয়ের অনুভূতিটা তখন আর কাজ করে না। অর্থাৎ জাস্টিস ডিলেইড হতে হতে যখন ডিনাইড হয়, তখনই মানুষ ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে। অন্য কথায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। হয়তো রবিউলের ক্ষেত্রেও হয়েছে তেমনটাই। সে এতদিন মানুষকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ভয় দেখিয়ে, এবার ঘটেছে তার উল্টোটা। এবার ‘ক্রাউড’ তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ‘মব জাস্টিস’ ডিলেইড হয়নি, সরাসরি ‘লিঞ্চিং’, পুড়িয়ে মারা হয়েছে রবিউলকে।

পাশাপাশি এমন আরেকটি ঘটনার কথা বলি। এনটিভি অনলাইন জানিয়েছে, বরগুনায় আলআমীন নামে হত্যা মামলার এক আসামিকে গণপিটুনি দিয়েছে জনতা, সাথে চোখ উপড়ে ফেলারও চেষ্টা করা হয়েছে। কেন হয়েছে, এমন প্রশ্নে গণমাধ্যমটি স্থানীয়দের বরাতে জানিয়েছে, ওই ব্যক্তির প্রাবল্যে মানে শক্তিতে অসহায় ছিল এলাকাবাসী। ইভটিজিং, মানুষকে ভয় দেখানো, মারধর, মাদক ব্যবসাসহ হেন অপকর্ম নেই সে করত না। তার জন্য স্কুলগামী কিশোরীরা স্কুলে যেতে ভয় পেত। কিন্তু কোনোখানেই অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পায়নি এলাকার লোকজন। পরিণতিতে ভয়ের মাত্রা অতিক্রম করে মানুষ পরিণত হয়েছিল ‘ক্রাউডে’। ধারাবাহিকতায় ‘মব জাস্টিস’, যার পরিণতি গণপিটুনি, চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা, এক কথায় ‘লিঞ্চিং’।

এ তো মাত্র দুটি ঘটনা, আরও রয়েছে। এমন আরও ঘটবে এবং এর তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, এমন আশঙ্কা থেকেই আগে এবং এখনকার লেখা। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনও এমন আশঙ্কার বাইরে ছিল না। দীর্ঘদিন থেকেই গণপরিবহনে রয়েছে এক ধরনের মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। আর সেই মাফিয়াদের শক্তি সংশ্লিষ্টদের রবিউল, আলআমীনদের মতন ‘মনস্টারে’ পরিণত করেছিল। এর ফলেই বাচ্চাদের নেমে আসতে হয়েছিল পথে। নিজ সহপাঠীর ক্রমাগত মৃত্যু তাদের ভাবলেশহীন করে ফেলেছিল, ভয়ের মাত্রা ছাড়িয়ে তারা হয়েছিল প্রতিবাদী। তারাই পথের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল। এটাও কিন্তু এক ধরনের ‘মব’ এবং অবশ্যই ‘মব জাস্টিস’। জাস্টিস যখন ফেইল করে, তখনই এমন মব জাস্টিসের উত্থান ঘটে। এই ক্ষেত্রে ‘মব জাস্টিসে’র কুফল বর্ণনার চেয়ে ‘জাস্টিস’ ফেইল করল কেন, সেটা জানা বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই জানাতেই এমন ‘ক্রাউড’ উপশমের ওষুধ লুকায়িত।

তবে এ কথা সত্যি, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘ভয়’ বিষয়টি জরুরি। ধর্মও মানুষকে সুপথে রাখার জন্য শাস্তির ভয় দেখায়, স্বর্গ-নরক দেখায়। শাস্তির ভয় না থাকলে সামাজিক শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতো। এ ক্ষেত্রে মুশকিল হলো, কোথাও কোথাও এই ‘ভয়’ সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে শক্তি প্রদর্শনে বেশি প্রয়োগিত হয়। যেমন প্রয়োগ করেছে রবিউল, আলআমীনেরা। ক্রমাগত এমন শক্তির প্রায়োগিক দাপটে ভয়ের মাত্রা একসময় অতিক্রান্ত হয়। বিদ্রোহ করে মানুষের মস্তিষ্ক, সঙ্গত কারণেই মানুষ পরিণত হয় ‘ক্রাউডে’। ‘ক্রাউডে’র সম্ভাব্য পরিণতি অবশ্যই ‘মব জাস্টিস’, শেষে ‘লিঞ্চিং’। সুতরাং রবিউল, আলআমীনদের থামাতে হলে ‘জাস্টিস’ নিশ্চিত করতে হবে, পক্ষপাতহীন করতে হবে। জাস্টিস অনিশ্চিত ও একপাক্ষিক হওয়া মানেই ‘ক্রাউড’। আর ‘ক্রাউড’ সৃষ্ট ‘মব জাস্টিস’ বা ‘লিঞ্চিং’ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। ‘মব জাস্টিস’ মানেই প্রতিশোধ স্পৃহা। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার এই পরম্পরা রুখতে না পারলে কল্যাণ রাষ্ট্রের আশা বৃথা।

ফুটনোট: সম্ভবত আরেকটি গণমাধ্যমে আগুনে পুড়িয়ে মারা রবিউলকে মানসিক ভারসাম্যহীন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস দেখা গেছে। তাদের এই প্রয়াসটি সত্য হলে সেটা তো আরও ভয়াবহ। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন লোক এতদিন ধরে ‘খুল্লামখুল্লা’ ঘুরে বেড়িয়ে কুপিয়ে মানুষ খুন করেছে, আহত করেছে, আর কেউ কিছু বলেনি, সত্যিই অবিশ্বাস্য! ‘সাইকো’রা যদি বাধাহীনভাবে মানুষ খুন করতে পারে, তাহলে তো সামজিক নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকে না।

পুনশ্চ: সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বরগুনায় গণপিটুনিতে আহত আলাআমীন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। সাথে ‘মব জাস্টিস’ আর ‘লিঞ্চিংয়ে’র বেসরকারি খতিয়ানে যোগ হয়েছে আরেকজনের নাম।   

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]