জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
আগস্ট: শোকের মাস স্মরণে
আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০১৮, ২১:৩৮
একটা সময় ছিল যখন ধনতান্ত্রিক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন এই দুই পক্ষের অবস্থান ছিল ঠিক যেমন উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু। আর তাই উভয়পক্ষের গোয়েন্দাবৃত্তি ছিল উচ্চমার্গের। রাষ্ট্রপ্রধানদের উৎখাত অথবা হত্যা অহরহই ঘটত।
পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ সবচেয়ে তৎপর ছিল এবং অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে বিভিন্ন দেশে। যার মধ্যে রয়েছে–ইরান (১৯৫৩), গুয়েতেমালা (১৯৫৪), হাইতি (১৯৫৯), কঙ্গো (১৯৬০), ডোমিনিকান রিপাবলিক (১৯৬১), দক্ষিণ ভিয়েতনাম (১৯৬৩), ব্রাজিল (১৯৬৪), ইন্দোনেশিয়া (১৯৬৫), উরুগুয়ে (১৯৬৯), বলিভিয়া (১৯৭২), চিলি (১৯৭৩), বাংলাদেশ (১৯৭৫) এবং আর্জেন্টিনা (১৯৭৬)। একমাত্র কিউবাতেই বারবার চেষ্টা চালিয়েও সফল হয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
তা ছাড়াও ১৯৬৬ সালে ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট এনক্রুমো চীন ভ্রমণে থাকাকালে সিআইএ’র সহায়তায় তাকে উৎখাত করা হয়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সাম্যবাদ বা সমাজতান্ত্রিক সরকারের সম্ভাবনা দেখত সেটা তাদের পছন্দ নয় বলে সেখানেই সিআইএ’র একটা প্রকল্প শুরু হয়ে যেত।
আমরা অনেক সময় ভাবতেও পারি না কেমন করে সিআইএ কাজ করে? তবে একটা সত্যি এবং খাঁটি কথা হলো, সমস্ত কর্মকাণ্ডের সব কিছুর রেকর্ডই রাখা হতো। পরবর্তী সময়ে কোনো-না-কোনোভাবে তা প্রকাশিত হয়। ‘ফ্রিডম অব ইনফরমেশন’ নামে একটা নিয়ম চালু আছে। যেমন ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ খ্যাত একাত্তরে ঢাকার আমেরিকান অ্যাম্বাসির কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড যেসব টেলিগ্রাম যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন তা ডিক্লাসিফাইড করা হয়েছে। ব্লাডের টেলিগ্রামের মূল বক্তব্য ছিল, ‘গণহত্যা হচ্ছে সারা বাংলায়, আমাদের কিছু একটা করা দরকার’।
তেমনি একজন প্রখ্যাত ষড়যন্ত্র-বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক ওয়েন মেডসেন ২০১০ সালে সিআইএ’র রিপোর্ট ‘দি স্টোরি অব ওবামা’র আবিষ্কার করেন, যেখানে বাংলাদেশে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রের কথাও রয়েছে।
আমরা হয়ত ভাবতেও পারি না প্রেসিডেন্ট ওবামা সিআইএ‘র তৈরি? আমরা কী ভাবতে পারি, ওবামার পরিবার, তার কেনিয়ান বাবা এবং আমেরিকান মা, ইন্দোনেশিয়ান সৎবাবা, গ্র্যান্ডমা প্রত্যেকেই সিআইএ‘র জন্য কাজ করতেন। অবশ্য গোয়েন্দা বিভাগের অভিজ্ঞতা নিজ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হতে সাহায্যই করে। সিনিয়র জর্জ বুশ তো সিআইএ‘র প্রধান ছিলেন। অন্যদিকে পুতিনতো কেজিবির প্রধান ছিলেন।
ওবামার মা মিসেস এন ডানহাম ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্নকে উৎখাতের জন্য কাজ করেছেন। ভদ্রমহিলা মাইক্রো অর্থনীতি সম্পর্কিত কাজে বাংলাদেশ, নেপাল, থাইল্যান্ড এবং ভারত ভ্রমণ করেছেন। অবাক হলেও সত্যি, এই মাইক্রোর আড়ালে সিআইএ’র হয়ে ম্যাক্রো কাজ করে যেতেন। আরও অবাক করা বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের সব নাম-করা ফাউন্ডেশনগুলোকে যেমন–ফোর্ড, কেনেডি, রকেফেলার, এশিয়া ফাউন্ডেশন হাওয়াইয়র ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার ইত্যাদিকে অপ্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগানো হতো।
বিখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুল্জ-এর বিভিন্ন লেখা এবং বই, ‘Bangladesh–the unfinished revolution’ এবং ওয়েন মেডসেনের বই ‘The Manufacturing of a President: The CIA's insertion on Barack Obama into White house’ থেকে আমরা জানি তখনকার সময় অর্থাৎ একাত্তর, পঁচাত্তরে দুই রাষ্ট্রপ্রধান, চিলির আলেন্দে, এবং বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের নোটবইয়ে ক্রস করা লাল কালিতে লেখা ছিল। আর সেজন্যেই ফিলিপ চেরিকে বাংলাদেশে সিআইএ‘র স্টেশনপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই চেরি সাহেবই উৎসাহিত করেছেন খন্দকার মোস্তাক চক্রকে এবং কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তাদেরকে।
পঁচাত্তরের আগস্টের কালরাত বাংলাদেশকে অকস্মাৎ গ্রাস করে নিল। বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর প্রচেষ্টাকে অংকুরেই বুলেট বিদ্ধ করল।
এরপর আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান গরবাচেভ ‘গ্লালনস্ট ও পেরেস্ট্রইকা’ নামে নিজেই কমিউনিজমের রিফর্ম খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রয়োগ করা শুরু করে। ফলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ভেঙে খান খান হয়ে পড়ল। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে গেল। চেক, হাঙ্গেরি, পোলান্ড এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমান্বয়ে ভেঙে অনেকগুলো স্বাধীন দেশে পরিণত হলো। এরপর সিআইএ‘র ষড়যন্ত্রের কর্মকাণ্ডেও কিছুটা ভাটা পড়ল।
তবে সিআইএ‘র মাধ্যমে পরিবর্তন যখন সম্ভব হচ্ছে না, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধ বাঁধিয়ে ডোমিনো ইফেক্ট ঘটিয়ে দিল মিডিল ইস্টে। একবিৎশ শতাব্দীর বড় ট্রাজেডি এই মিডিল ইস্ট, যা এখনও চলছে।
এক সময় যুক্তরাষ্ট্র যেখানে প্রতিটি দেশের রাজনীতিতে নাক গলাত। আর এখন দেখা যাচ্ছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নাক গলাচ্ছে বর্তমান পুতিনের রাশিয়া। প্রায় দেড় বছর ধরে ‘মুলার কমিটি’ খুঁজে বের করছে কত মাত্রায় নাক গলিয়েছে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনের সময়।
পাঠকরা এখানকার লোকাল পত্রিকায় আমার লেখা ‘Is the US facing its own glasnost and perestroika?’ গুগল করে পড়তে পারেন।
বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে যেমন বিবর্তন এসেছে, তেমনি ষড়যন্ত্রেও বিবর্তন এসেছে। সন্ত্রাসবাদেও বিবর্তন এসেছে। প্লেন ছিনতাই অনেকটা কমে এসেছে। খুব বেশি মাত্রায় সতর্ক হওয়ার ফল হয়তো। কিন্তু শুরু হয়েছে গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা। সভা সমিতিতে বোমা মেরে হত্যা করা। এমনকি খাবারের সঙ্গে রেডিয়েশন বিষক্রিয়াও হচ্ছে।
বাংলাদেশেও এখন সব কিছুই সম্ভব। ভাবলে মন খারাপ হয়, সেই পঁচাত্তরের আগস্টে ইন্ধিরা গান্ধী ‘র’-এর সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু হেসেই উড়িয়ে দিলেন, ‘এরা তো আমাদেরই সন্তান’।
বাংলাদেশে তখন তেমন কোনো অভিজ্ঞ গোয়েন্দা সংস্থাই ছিল না। নইলে এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল, ভাবা যায় না।
নেতা-নেত্রী অপ্রিয় হলে সমস্যা, যেমন সম্প্রতি পানি থেকে উঠে সড়কের ট্রাজেডি বিষয়ে অপ্রীতিকর মন্তব্য করে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছেন এক নেতা।
আবার অধিকতর জনপ্রিয়তা থাকলেও আরও বেশি বিপদ ডেকে আনতে পারে। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। যেমন–লিংকন, কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু, রাজীব গান্ধী। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন অসমাপ্ত বিপ্লব আর দেখতে চাই না। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে গড়ে উঠুক, আগস্ট–শোকের মাসে এই কামনা করছি।
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]