নিয়ম মেনে আপনি আপনার ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় রাখতে পারবেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারও। ছবি: সংগৃহীত
ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা
আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ২২:০৩
(প্রিয়.কম) চিড়িয়াখানায় ভ্রমণ করেননি এমন লোক কি খুব বেশি পাওয়া যাবে? ঢাকা এবং অন্যান্য শহরের সাধারণ মানুষের ভ্রমণের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে চিড়িয়াখানাগুলো। কারণ, নগরবাসী মানুষের আর যাওয়ার মতো তেমন জায়গা নেই। তাই বড়দের জন্যে ঘড়ি ধরে চলা জীবনের একটু বৈচিত্র্য আর শিশু কিশোরদের অনাবিল আনন্দের জন্য প্রতিদিন বহু মানুষের ভিড় জমে চিড়িয়াখানায়। যদি আপনার মনে প্রশ্ন জাগে যে এই ভ্রমণকারীর সংখ্যা আসলে এমন কি আহামরি তাহলে, আপনার জন্য জানাচ্ছি যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় (ঢাকা চিড়িয়াখানা বা মিরপুর চিড়িয়াখানা) ভ্রমণকারীর সংখ্যা ৩০ লক্ষের চাইতেও বেশি। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে নয় হাজার মানুষ ভ্রমণে আসেন বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায়। অন্য চিড়িয়াখানাগুলোর কোনটিই খালি পড়ে থাকে না। সপ্তাহের যে কোনো দিনই দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। তার মানে এই বিষয়টি পরিষ্কার যে ভ্রমণকারী বা দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশ ভালো পরিমাণের।
আসুন তাহলে প্রথমেই জেনে নিই বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিরিয়াখানার সংখ্যা আর অবস্থান। উইকিপিডিয়ার হিসাব মতে বাংলাদেশে সরকারি চিড়িয়াখানার সংখ্যা ১০টি। এগুলো হলো:
১. বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা। (মিরপুর)
২. কুমিল্লা চিড়িয়াখানা (কুমিল্লা সদর)
৩. খুলনা চিড়িয়াখানা (শিবা মোড়, কুমিল্লা সদর)
৪. গাজীপুর বরেন্দ্র পার্ক (গাজীপুর, ঢাকা)
৫. চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা (খুলসি, চট্টগ্রাম)
৬. ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক (চকরিয়া, কক্সবাজার)
৭. নিঝুম দ্বীপ পার্ক (হাতিয়া, নোয়াখালী)
৮. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক (ইন্দ্রাপুর,গাজীপুর)
৯. রংপুর চিরিয়াখানা (রংপুর সদর)
১০. শহীদ এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখান (পুরাতন রেসকোর্স ময়দান, রাজশাহী)
কিন্তু, যে বিষয়টি লক্ষণীয় তাহলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেক’টি চিড়িয়াখানা রয়েছে সেগুলো এই বিশাল পরিমাণ ভ্রমণকারী বা দর্শনার্থীর চাপ নিতে কোনো ভাবেই সক্ষম নয়। পাশাপাশি এগুলোর ব্যবস্থাপনা আর নিরাপত্তার মান তো সকলেরই জানা আছে। পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তাসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত সরকারি ব্যবস্থাপনার এই চিড়িয়াখানাগুলো। এই সমস্যাগুলো মোটেও নতুন না। কিন্তু সমাধানগুলো তাহলে কি? আমরা নিশ্চয়ই রাতারাতি প্রতিটি জেলার জন্য অন্তত একটি করে চিড়িয়াখানা বানাতে সরকারের কাছে দাবি জানাতে পারিনা! আর সেটা সরকারের পক্ষে এই মুহূর্তে করাও সম্ভব না।
তাই, সমাধান হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে চিড়িয়াখানা নির্মাণ করা। দেশের নানা জায়গায় এ ধরণের কিছু ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা থাকলেও তা সংখ্যার দিক থেকে খুবই কম। কারণ, আইনি জটিলতা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। বাংলাদেশে আপনি চাইলেই আপনার বাড়ির ছাদে এক জোড়া বাঘ সুন্দরবন থেকে ধরে এনে বা চোরাকারবারির কাছ থেকে কিনে নিয়ে পোষা শুরু করেত পারবেন না। অথবা আপনার যত ইচ্ছাই থাকুক না কেন আপনি চাইলেই ২/৪ জোড়া হরিণ কিনে এনে পালন করতে শুরু করতে পারেন না। এমনকি আমরা যে বাড়িতে নানান ধরনের পাখি যেমনঃ টিয়া, ময়না, ঘুঘু এসব পালান করি, তাও আইনত দণ্ডনীয়। কারণ এ কাজটি করার জন্য আপনাকে একটি বিশেষ আইন মেনে চলতে হবে। আইনটির নাম “বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন - ২০১২”। এই আইনের আছে ১০ টি অধ্যায়, ৫৪ টি ধারা আর প্রায় প্রতিটি ধারার বেশ কিছু করে উপধারা। আপনি এই আইনটি পড়ে নিয়ে সকল শর্ত পূরণ করেই কেবল ব্যক্তি উদ্যোগে এই সকল বন্য প্রাণী পালনের অনুমতি পাবেন। অর্থাৎ, ব্যক্তি মালিকানায় কেউ চিড়িয়াখানা করতে চাইলে তাকে অবশ্যই এই আইনের সবগুলো শর্ত মেনে নিয়ে ও পূরণ করে সরকারি অনুমতি নিয়ে তারপর করতে হবে। কাজটি মোটেও সহজ নয়। সরকারিভাবে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করা না হলেও বেসরকারিভাবে কিছু মানুষ উদ্যোগী হয়েছেন এই ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করবার জন্যে। তার মধ্যে অন্যতম নাম “বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন এন্ড রিয়ারিং এসোসিয়েশন”। প্রিয়.কম এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে “বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন এন্ড রিয়ারিং এসোসিয়েশন” এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রফেসর ড. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, তারা মূলত এই ধরনের কাজ করছেন বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণীর জাত বিলুপ্তি ঠেকানোর জন্য। এটি তাদের একটি জনহিতকর কাজ। এই কাজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত কোনো ব্যবসায়িক মুনাফা করার ইচ্ছা তাদের নেই।
ছবিতে “বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন এন্ড রিয়ারিং এসোসিয়েশন” এর একটি বিজ্ঞাপন।
আমাদের প্রশ্ন ছিল এই যে বন্য প্রাণী যেমন বিভিন্ন পাখি বা বাঘকে খাঁচায় আটকে রাখা হবে এটা ঐ প্রাণীগুলোর জন্যে কতটা অসুবিধাজনক? জবাবে তিনি প্রথমেই আমাদের যে ভুল ভাঙ্গিয়ে দেন তা হলো, চিড়িয়াখানা করুন আর বাড়িতে পালুন আপনাকে অবশ্যই “বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন - ২০১২” মেনে কাজটি করতে হবে। আর এই আইনে কোনো প্রাণী পালার জন্য আপনার কতোটুকু পরিমাণ জায়গার দরকার, কি কি ধরনের সেবাযত্ন দরকার, সব কিছুই নির্দেশিত করা আছে। তাই যদি কেউ “বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন – ২০১২” মেনে কাজটি করে তাহলে সে নিজেই যে কোনো প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা আর যত্নের ব্যবস্থা করে ফেলবে। তাকে আর কোনোভাবেই চিন্তা করতে হবেনা। পাশাপাশি তিনি একটি উদাহরণ দেন। তার নিজের কাছে থাকা অত্যন্ত দামি দুইটি ম্যাকাও যখন পরস্পরকে সহ্য করতে পারছিলো না তখন তারা কৃত্রিম ঝড় তৈরি করেছিলেন যাতে করে পাখি দু'টো একে অন্যের কাছে নিরাপত্তা খুঁজতে কাছাকাছি থাকে। আর এখানেই প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আরও একবার মনে করিয়ে দেন তিনি। বলেন, শুধু আইন মানলেই হবে না। জানতে হবে কোন বিশেষ সময়ে কি করতে হবে সে বিষয়গুলো।
এতো গেলো ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা কোথায় পাওয়া যাবে সেটি। কিন্তু আপনি কেনো উদ্যোগী হবেন একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা করার জন্য? “বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন এন্ড রিয়ারিং এসোসিয়েশন” ইতোমধ্যে ঢাকায় তাদের ফিকামলি মিলি চিড়িয়াখানা পরিচালনা করে আসছেন। এখানে প্রতিদিন কয়েকশত মানুষ আসেন পাখি দেখতে। কিন্তু তারা এখানে কেবল কিছু বিরল পাখিকেই আবাসন দিতে পেরেছেন আর সাথে কয়েকটি হরিণ কিন্তু এর চাইতে বেশি কিছু করার জন্য তারা ঢাকা শহরের এই পান্থপথে আর স্থান সংকুলান করতে পারছেন না। তাই তারা বরিশালের ভান্ডারিয়ায় একটি বড় জায়গা নিতে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে বাঘ পালার এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জাত রক্ষার উদ্যোগ এর মধ্যেই নিয়েছেন। আপনি কি অবাক হচ্ছেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জাত রক্ষার কথায়? অবাক হলেও বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা জানার পর আপনার এই অবাক লাগা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। শেষ সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে বন্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা মাত্র ১০৬টি। আর সকল চিড়িয়াখানা এবং অভয়ারণ্য মিলিয়েও এই সংখ্যা ৫০০টিতে পৌঁছায় না। তাই রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে উইকিপিডিয়াতে। আর এই বিলুপ্ত প্রায়, নামে মাত্র সংখ্যার প্রাণীটির চামড়াসহ বিভিন্ন অংশ অত্যন্ত মূল্যবান হওয়ায় চোরা শিকারির হাতে প্রতি বছরই এর সংখ্যা কমে চলেছে। তাই এখনই প্রকৃত উপায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ভবিষ্যতে কেবল জাতীয় প্রতিকেই দেখা যাবে। আর তা আমাদের পর্যটন তথা জীব বৈচিত্র্যের জন্য কোনোক্রমেই সুসংবাদ হবে না। একই রকমভাবে আমাদের দেশের অন্যান্য অনেক বন্য প্রাণীই আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তাই ভবিষ্যৎ পর্যটনের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে একমাত্র এই ব্যক্তি উদ্যোগের বিভিন্ন মহলের এগিয়ে আসার মাধ্যমেই প্রকৃতিতে তার পূর্বের অবস্থায় ফেরত নেওয়ার মতো বন্য প্রাণী যোগান দেওয়া সম্ভব হবে। দেশের ইকো সিস্টেমের জন্যেও এটি বিশেষ জরুরী হয়ে পড়েছে।
পাশাপাশি এই ধরনের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা যে আপনাকে শুধুমাত্র সখের বসে করতে হবে তাও না বরং, অর্থনীতিক দিক থেকেও বেশ লাভজনক বিনিয়োগ হতে পারে এটি।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। যে সকল বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত বা বিলুপ্ত প্রায় তাদের ক্ষেত্রে বনের পরিবেশটি অবশ্যই অনুকূল ছিল তা কিন্তু নয়। তাই এদের জাত রক্ষার লক্ষেই মূলত এই চিড়িয়াখানা বানানোর প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ। আমাদের দেশে ইতোমধ্যে প্রায় ৪৮ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত। আরো প্রায় ২৬ প্রজাতির পাখি অচিরেই বিলুপ্তির পথে। যেমন: রাজ শকুন, কালা শকুন, বাদা ছাতারে ইত্যাদি পাখিগুলো এখন খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কিন্তু এরা আমাদের পরিবেশ আর জীব বৈচিত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদের জাত রক্ষায় এখনই যত্নশীল না হলে বাকি বিলুপ্তপ্রায় পাখীগুলোও চির দিনের মতো হারিয়ে যাবে। আর এদেরকে রক্ষার একমাত্র পথ হলো এদের খাঁচায় পালনের মাধ্যমে সংখ্যা বৃদ্ধি করা। আর এই কাজটি কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই চিড়িয়াখানা তৈরি করে ব্যক্তি উদ্যোগে এই সকল বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষার এই উদ্যোগ আন্দোলনে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা জানতে পারি ড. আব্দুল ওয়াদুদের কাছ থেকে।
এই একই ধরনের কাজ ব্যক্তি উদ্যোগে আরও কিছু মানুষ শুরু করেছেন। ভ্রমণ, পরিবেশ আর জীব বৈচিত্র্য একে অপরের সাথে এতটাই গভীরভাবে জড়িত যে এর কোনোটিকে আলাদা করে হিসেব করার কোনো উপায় নেই। তাই আসুন, সবাই মিলে পরিবেশকে রক্ষা করি। জীব বৈচিত্রময় বনে-জঙ্গলে ভ্রমণের পথ সুগম করি। আনন্দময় হোক আপনার ভ্রমণ।
সম্পাদনাঃ ড. জিনিয়া রহমান
প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post।
- ট্যাগ:
- ভ্রমণ
- ভ্রমণ
- পশু-পাখি
- চিড়িয়াখানা
- আইন