কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

প্রকৃত বন্ধুর অভাব টিনএজ বয়সে খুব একা করে দেয়, যা থেকে তৈরি হয় হতাশা। ছবি কৃতজ্ঞতা: নূর। মডেল: মারিয়া।

আজকাল টিনএজারদের মাঝে কেন বেড়ে চলেছে আত্মহত্যা প্রবণতা?

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:০৩
আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:০৩

(প্রিয়.কম) লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সাম্প্রতিক সময় তরুণদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এর তথ্যানুসারে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে সমগ্র পৃথিবীতে একজন আত্মহত্যা করছে! আরো যোগ করা প্রয়োজন, প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে প্রায় ২০ বারের প্রচেষ্টা! খুব বেশী দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, যারা আত্মহননের চেষ্টা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর টিন এজার।

 কিছু সাইক্রিয়াটিস্টদের এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে, তাদের কাছে ১০ বছরের শিশু আত্মহত্যার কথা বলছে এবং এই বিষয় নিয়ে ভাবছে! সাইক্রিয়াটিস্ট শৈলাস পাংগাওঙ্কার এর মতে, “বেশীরভাগ সময়ে আত্মহত্যা হুট করে নেওয়া কোন সিদ্ধান্ত নয়, এর পেছনে থাকে অনেকদিনের চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনা”!

ভ্রমণকারী জুডি মরিস তার অভিজ্ঞতা থেকে ১৩ টি কারণ খুঁজে বের করেছেন যার ফলে তরুণদের মাঝে আত্মহত্যা প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।   

১/ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলা

আমরা ভাবি যে তারুণ্যই জীবনের সবচেয়ে বেশী স্বাধীন এবং আনন্দময় সময়। কিন্তু এখনকার সময়ে সেই ধারণা এবং সেই ভাবটা যেন আর নেই। অন্যান্য সকল ধরণের চাপ বাদ দিয়ে, যে চাপটা সারাক্ষণ এখন মাথার উপরে চেপে বসে থাকে সেটা হলো- চারপাশের সকলের ইচ্ছার চাপ!

নিজের পরিচিত গন্ডির মাঝে নিজেকে গ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্য নিজের ইচ্ছা এবং মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ করার এই মানসিক চাপটা এখন খুব বেশী থাকে সকলের উপরে। প্রতিটা বাবা-মায়ের তাই উচিত, নিজের সন্তানদের প্রতি সঠিকভাবে খেয়াল রাখা। তার সন্তানেরা কাদের সাথে মিশছে, চলছে এবং বেশীরভাগ সময় কাটাচ্ছে সে সকল বিষয়ে তাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

২/ যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া

মিডিয়ার বিভিন্ন ধরণের আবেদনময় কাজ টিনএজারদের মাঝে প্রবল আগ্রহ তৈরি করে। সঠিক তথ্যের অভাবের ফলে তাদের মধ্যে যৌনক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত অঙ্গের উপর অত্যাধিক আগ্রহের সৃষ্টি হয়, যেটা তাদেরকে যৌনক্রিয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকেই অল্প বয়সে গর্ভধারণ এর মতো ঘটনা ঘটে থাকে। যার ফলাফল সম্পর্কের ভাঙন, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত ও হতাশা। 

৩/ স্কুল কিংবা কলেজে টিটকারির সম্মুখীন হওয়া

যে কারোর জন্যেই বাসার ভেতরের ও বাইরের পরিস্থিতি এবং অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি শিশু যখন বাসাতে থাকে, তখন সে তার চারপাশের বড় মানুষদের মাঝে থাকে এবং তাদের দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু যখনই এই শিশুটি বাইরের দুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, তখন থেকেই তাকে একইসাথে ভালো এবং খারাপ কিছুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হচ্ছে।

খারাপ অভিজ্ঞতার মাঝে টিটকারির সম্মুখীন হওয়া খুবই ভীতিকর টিনএজারদের জন্য। যদিও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই এইসকল পরিস্থিতি সামলে নেয়, তবুও কিছু ক্ষেত্রে বাবা-মা এবং শিক্ষকদেরও এইদিকে নজর দেওয়া উচিৎ।

৪/ বাবা-মায়ের সময়ের অভাব

সন্তানকে সঠিকভাবে, নিরাপদে বড় করে তোলার জন্যে প্রতিটি বাবা-মায়েরই তাদের সন্তানের সাথে প্রচুর সময় কাটানো দরকার। এই সময় কাটানোর ফলে তাদের মধ্যে খুব চমৎকার একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থা তৈরি করে দেয়।

কিন্তু, যেসকল বাবা-মায়েরা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত এবং অফিসিয়াল কাজ নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকে এবং সন্তানদের দিকে ভালমতো খেয়াল রাখতে পারেন না অথবা তাদের সাথে খুব একটা বেশী সময় কাটাতে পারেন না, তাদের সন্তানেরা অনেক বেশী নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে বেড়ে ওঠে।  

৫/ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়া

আশেপাশের পরিচিতজনের মাধ্যমে, বন্ধুদের প্ররোচনায় এবং অবাধে টাকাপয়সা হাতের আসার ফল স্বরূপ উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা মাদক গ্রহণ করে থাকে। কিছু মাদক আছে, যা মস্তিষ্কে মধ্যে একইসাথে চূড়ান্ত সুখ এবং দুঃখের অনুভূতি তৈরি করে থাকে, যার ফলে অনেকেই আত্মহত্যা করে থাকে। অল্পবয়সে মাদকে আসক্তির মতো চূড়ান্ত ভয়াবহতা আর কোনকিছুই হতে পারে না। যারা তাদের কিশোর বয়সেই ভুল মানুষের প্ররোচনার ফলে এমন অন্ধকার দুনিয়ার প্রবেশ করে তাদের জন্যে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। খুব কম সংখ্যক মানুষ এই অন্ধকার অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। তবে যারা সুস্থ হতে পারে না, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।  

৬/ প্রকৃত বন্ধু এবং বন্ধুত্বের অভাব

আধুনিক এই সময়ে শিশু-কিশোররা একদম ছোট থেকে সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়! এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতশত বন্ধু তাদের! কিন্তু এর মাঝে তাদের সত্যিকারের এবং প্রকৃত বন্ধু কে বা কয়জন? খুঁজলে হয়তো হাতে গোনা কয়েকজন পাওয়া যাবে, অথবা একেবারেই পাওয়া যাবে না!

প্রতিটা মানুষের জীবনে বন্ধুর প্রয়োজন, গভীর বন্ধুত্বের প্রয়োজন। জীবনে অন্তত এমন একজন বন্ধু প্রয়োজন আর সাথে জীবনের সকল কথা, সকল সুখ-দুঃখের আলাপ করা যাবে নির্দ্বিধায়। কেউ যখন তার জীবনে এমন বন্ধু পায় না, তখন সে খুব একা হয়ে পড়ে। নিজের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে ওঠে সে একটা সময়ে গিয়ে। যা অনেক সময় আত্মহত্যার মতো দুর্ঘটনা বয়ে নিয়ে আসে।    

৭/ অনুপ্রাণিত না হয়ে অনুসরণ শুরু করা

স্কুল এবং কলেজ এমন জায়গা যেখানে একজন তার পরিচিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হয়, তাদের সাথে মেশার সুযোগ পায়। প্রতিটি ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা কিংবা অন্যান্য সকল এক্সটা কারিকুলাম এক্টিভিটিসে স্বকীয় এবং নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী ফলাফল করে থাকে। এক্ষেত্রে কিছু ছাত্রছাত্রী অনেক বেশী ভালো করবে, এবং বেশীরভাগই থাকবে একেবারে মাঝামাঝি স্তরে।

যারা এমন মাঝামাঝি স্তরে থাকে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগের যে প্রবণতা থাকে, তারা ভাল ফলাফলকারীদের থেকে অনুপ্রেরণা না নিয়ে তাদের অনুসরণ করা শুরু করে।সকলের ধারণ ক্ষমতা এবং গ্রহণ করার ক্ষমতা সমান নয়। তাই কেও যখন অনুসরণ করতে গিয়ে সেই রূপ ফলাফল করতে ব্যর্থ হয়, তখন খুব দ্রুত হতাশ হয়ে পড়ে।   

৮/ ছেলেবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া

এটা আপনাকে মানতেই হবে যে, যেকোন বয়সের যে কারোর জন্যেই আত্মহত্যার মতো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই স্পর্ধামূলক একটি কাজ! একজন মানুষের মধ্যে যখন বেঁচে থাকার সকল ইচ্ছা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায় তখনই কেবলমাত্র কেও এমন ধরণের ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

অনেক বেশী ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ফলে একজন তার জীবন এর শেষ দেখতে চায় বলেই আত্মহত্যা করে থাকে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিগুলোর মাঝে বেশীরভাগ সময়ে যেটা প্রধান কারণ হয়ে থাকে- পরিবারের কোন সদস্যর দ্বারা খুব ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া। যা সেই শিশু বয়সেই একজনের মনের মধ্যে অনেক বেশী বাজে প্রভাব ফেলে দেয়। যার ফলে সেই শিশু যখন বড় হয় তখন তার মধ্যে ছোটবেলার সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো হানা দিতে থাকে বারবার। যা তাকে একেবারে হতাশ এবং নিরুপায় করে ফেলে। এই বাজে অভিজ্ঞতাগুলোর কথা কেউই কাউকে বলতে চায় না এবং বলেও না। নিজের ভেতরে রেখে দিয়ে একাই অসম্ভব মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। এমন বাজে মানসিক অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যেই  অনেকে আত্মহননের পথটি বেছে নেয়।

৯/ যে কোন সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া

শিশু এবং বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা মানসিকভাবে এবং অনুভূতিগত দিক দিয়ে বেশীরভাগ সময়েই অন্যের উপরে অনেক বেশী মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে থাকে। এই মানুষগুলো হতে পারে পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক অথবা ভালোবাসার মানুষ। যে কোন সম্পর্কে- হতে পারে এই সম্পর্ক বন্ধুর সাথে, পরিবারের সাথে অথবা ভালোবাসার মানুষটার সাথে। হুট করেই কোন ঘটনার অথবা অঘটনের প্রেক্ষিতে কারোর সাথে যখন সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় তখন তারা মানসিকভাবে অনেক বেশি দূর্বল হয়ে পড়ে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকে এই মনঃকষ্টটা কাটিয়ে উঠতে পারে। তবে যারা পারে না, তারা বেছে নেয় একদম শেষ উপায়টি!

১০/ লেখাপড়ায় অতিরিক্ত চাপ

পড়ালেখার ক্ষেত্রটি এমনিতেই খুব প্রতিযোগিতাপূর্ণ। এর উপরে কিছু অভিভাবক রয়েছেন যারা পড়ালেখা, ভালো ফলাফল এবং তাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সন্তানদের উপরে অনেক বেশী মানসিক চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। বাবা-মায়ের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল  করার জন্যে থাকে মানসিক চাপ, এর সাথেই থাকে ভালো কোন স্কুল কিংবা কলেজে ভর্তি হবার চাপ। প্রতি বছর বোর্ড পরীক্ষা এবং ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর প্রত্যাশিত ফলাফল করতে না পারার হতাশে প্রচুর তরুণ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে থাকে।

১১/ সামাজিক মিডিয়া এবং মোবাইলের গেমিং অ্যাপস

সাম্প্রতিক সময়ের বাইরের দেশে শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার জন্য ‘ব্লু হোয়েল গেমিং অ্যাপ’কে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এই গেমটি ছাড়াও, মোবাইল এবং সামাজিক নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটে এমন কিছু ভয়াবহ গেমস রয়েছে যা কি আত্মহত্যার দিকে শিশু-কিশোরদের প্ররোচিত করে থাকে। শিশু-কিশোরেরা মূলত কৌতূহলী হয়ে এবং জানার আনন্দ পাওয়ার উদ্দেশ্যে গেমস গুলো খেলতে শুরু করে এবং যার পরিণতি হয় চূড়ান্ত ভয়াবহ।

১২/ নিজের থেকে তৈরি করা মানসিক চাপ

জীবনে সকলেই সফল হতে চায়। তবে কিছু শিশু-কিশোর নিজেদের উপরে নিজেরাই এতো বেশী মানসিক চাপ প্রয়োগ করে, যা তারা নিজেরাই বহন করার জন্যে প্রস্তুত থাকে না। এই চাপটা শুধুমাত্র পড়ালেখার জন্যে তৈরি হয় না, নিজেদের পারিপার্শ্বিক আরো বহু কারণ থাকে, যেমন- যারা মোটা তাদের মাঝে শুকানোর তাগিদ থাকে, খেলাধুলায় ভালো করার তাড়না থাকে অথবা স্কুল কিংবা সকল ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জনপ্রিয় হওয়ার প্রতিযোগিতা থাকে। এইসকল মানসিক চাপ থেকে অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশী হতাশায় ডুবে যায়।

১৩/ টিভি সিরিজ এবং সিনেমা

এমন কিছু টিভি সিরিজ এবং সিনেমা আছে, যার কাহিনী থাকে খুবই অদ্ভূত এবং হতাশাজনক। যা অনেক শিশু-কিশোরদের মনের উপর গভীর ছাপ ফেলে দেয় এবং যা তাদের আত্মহত্যার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তোলে। 

গবেষক এবং সাইক্রিয়াটিস্টরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে, মানসিকভাবে যারা খুব দুর্বল চিত্তের এবং সবসময় খুব হতাশ হয়ে থাকে তাদেরকে মানসিকভাবে সাহস এবং উৎসাহ দিতে, তাদের পাশে থাকতে। যদি অবস্থা খুব বেশী খারাপ মনে হয় তবে সেক্ষেত্রে দ্রুত মানসিক রোগের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।  

সূত্র: thelndusparent, The Time of India.  

সম্পাদনা : রুমানা বৈশাখী