আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদউল্লার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং। ছবি: সংগৃহীত
কেন বিগ হিটার তৈরি করতে পারছে না বাংলাদেশ?
আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৫৪
(প্রিয়.কম) আপনি হয়তো এজাজ আহমেদ, সালাউদ্দিন পাপ্পু কিংবা হাসানুজ্জামানের নাম শোনেননি। আপনি হয়তো অতীতে জিয়াউর রহমানকে একের পর এক ছয় হাঁকাতে দেখেছেন। আচ্ছা, আপনি যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘ডাই হার্ড’ অনুসারী হন তারপরও কি কখনও নাজমুল হোসেন মিলনের উপস্থিতি টের পেয়েছেন?
উত্তরটা আসলে কী হবে, তা জানা যাচ্ছে না। যাদের জানা নেই, তারা জেনে রাখুন এ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে মারকুটে ব্যাটসম্যান তারা। যদিও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) মতো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টগুলোর ফ্র্যাঞ্চাইজিরা তাদের চায় না। টুর্নামেন্টের এসব দলগুলোর চোখ খুঁজে বেড়ায় বিদেশি ক্রিকেটার। সেটা হতে পারে এজেন্টের মাধ্যমে, বিদেশি কোচের মাধ্যমে, বিদেশি কোন টি-টোয়েন্টি লিগের মাধ্যমে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবের কোন ভিডিও ক্লিপস দেখে! এখনও ভাগ্য ভাল, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো বিদেশে ক্রিকেটার খুঁজতে কমিটি পাঠানো শুরু করেনি। হয়তো বাজেট থাকলে সেটাও করে বসবে।
বিপিএলের কোন দলের প্রধান নির্বাহী কিংবা মালিক যদি বিদেশি কোন টুর্নামেন্টের নির্দিষ্ট কোন ফাস্ট বোলারের প্রতি আগ্রহী হন, সঙ্গে সঙ্গে তার এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কখনও মেধাবী দেশি ক্রিকেটার খোঁজার ব্যাপারে সমান আগ্রহ দেখায় না।
তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলা যায়, এই আশাটা আসলে করাও উচিত হচ্ছে না। কারণ দেশে নিয়মিতভাবে একাধিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হয় না। সে কারণেই বিপিএলের টুর্নামেন্টে দেশি ক্রিকেটারের কোটা পূরণ করতে প্রথম শ্রেণি কিংবা একদিনের টুর্নামেন্টের সেরা পারফরমারদের দলে ভেড়ানো হয়।
সালাউদ্দিন পাপ্পু জানালেন, আসলে বাংলাদেশে বিগ হিটার তৈরি হওয়ার পথে সমস্যা কোথায়। তিনি জানান, বাংলাদেশে বিগ হিটারদের কখনোই উৎসাহিত করা হয় না। ঘরোয়া লিগে এক বলে এক ছক্কা হাঁকানোর পরের বলে আবার বিগ হিটের চেষ্টা করলেই কোচ শেখানো শুরু করেন কীভাবে খেলতে হবে। কিংবা টানা মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হলেই পরের ম্যাচ খেলা অনিশ্চিত হয়ে যায়। খেলোয়াড়দের শেখার জায়গা হচ্ছে ঘরোয়া লিগ, এখানেই হিটারদের আতঙ্কে থাকতে হয়।
পাপ্পু বলেন, ‘আমি সবসময় মেরে খেলতে চাইতাম। সব ক্লাবের হয়ে ধুম-ধাড়াক্কা ব্যাট করতাম। আমি ভাবতাম, হয়তো বিপিএলে সুযোগ পাব। কিন্তু দূর্ভাগ্য, আমি কখনও বিপিএলের প্লেয়ার ড্রাফটে জায়গা পাইনি। আমাকে এই মৌসুমে আরও ভাল করতে হবে যেন আমাকে সবাই লক্ষ্য করে।’
গেল ১১ বছর ধরে ক্লিন হিটার হিসেবে সুপরিচিত এজাজ আহমেদ। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটিও প্রতিযোগিতামূলক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা হয়নি তার। অথচ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দ্রুত রান করার ব্যাপারে তার মুন্সিয়ানা প্রমাণিত অনেক আগে থেকেই। স্ট্রাইক রেটও দারুণ ঊর্ধ্বমুখী।
মিলনকে (নাজমুল হোসেন) নিয়ে অনেক কথা হয়। লোয়ার অর্ডারে নেমে তার মারকুটে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অদ্ভুত অ্যাকশনের মিডিয়াম পেস বোলিং তাকে ব্যতিক্রমী ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত করেছে। বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ১৪ বল খেলে করেছিলেন অপরাজিত ৩৬ রান, যেখানে ছয় ছিল পাঁচটি! কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অলরাউন্ডার যদি পেসার কিংবা মিডিয়াম পেসার হয় আগ্রহ কম থাকে। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি স্পিন করতে পারলে বেশি আগ্রহী হন নির্বাচকরা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচকরা যখন চিন্তা করেন তাদের মারকুটে ব্যাটসম্যান লাগবে, তারা জিয়াউর রহমানকে দলে ডাকেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ইংল্যান্ড সফরে ৬৯ বলে ১০৪ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেছিলেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। এই পেস অলরাউন্ডার বাংলাদেশ দলে জায়গা পাওয়ার জন্য নিজের সেরাটা দিয়েই সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এই দলে খেলা মানেই যেন তাকে প্রতিটা বল গ্যালারিতে পাঠাতে হবে। যখন সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তখনই বাদ পড়েছেন। ১৪ টি-টোয়েন্টি খেলা এই ক্রিকেটারকে ২০১৪ সালের জুনের পর আর দেখা যায়নি লাল-সবুজ জার্সিতে। এখনও এমন অনেক মেধাবী ক্রিকেটার রয়েছে যারা একরকম দূর্ঘটনা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, যিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে ২০১৫ বিপিএলের শিরোপা জিতিয়েছেন, তিনি জানিয়েছেন আসন্ন আসরে প্রত্যেক দল দেশি ক্রিকেটার গুরুত্বের সঙ্গে দলে ভেড়াতে পারে। যতটা পারা যায়, এই ব্যবধান পূরণ করার চেষ্টা থাকবে বলে তার দাবি। সঙ্গে হতাশার কথাও জানাতে ভোলেননি তিনি।
বলেন, ‘আমি শুরুতে দলের কম্বিনেশন দেখি। নিশ্চিত হই যে আমরা শুরুতে বিদেশি ক্রিকেটার নেব, তারপর দেশি ক্রিকেটার দিয়ে দল তৈরি করব। আমরা ক্রিকেটারদেরকে দলে নিই তাদের নাম, খ্যাতি আর সাম্প্রতিক রেকর্ড দেখে। আমি ঘরোয়াতে অনেক জায়গায় কোচিং করিয়েছি তাই ব্যাপারগুলো বুঝি। বাংলাদেশে খুব অল্পকিছু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে বিপিএল হল একমাত্র যেটা উল্লেখ করা যায়। এবারের আসরে পাঁচজন করে বিদেশি ক্রিকেটার খেলবে মূল একাদশে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো স্থানীয় নতুন ক্রিকেটারদের একাদশে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইবে।’
জাতীয় দলের বাইরে থাকা মেহেদী মারুফ এবং মিজানুর রহমানের মত ব্যাটসম্যানরা নিজেদের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ৬০% এরও বেশি রান করেছেন চার-ছয়ের মাধ্যমে। সাব্বির রহমান অনেক ছয় হাঁকান, কিন্তু তাদের কেউই (সাব্বির, মারুফ ও মিজানুর) ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে নিয়মিত ভাল করতে পারছেন না।
তাদের সবাই টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান। সবাই সহজাত স্ট্রোক প্লেয়ার। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে হিটার খুঁজে ফিরছে। এভাবেই চলতে থাকবে। শুরু হবে, শেষ হবে। একটা প্রথাগত নিয়মে আটকে থাকবে সবকিছু। সেই নিয়মটা কী? টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে মারকুটে ব্যাটসম্যানদের উপর অগাধ বিশ্বাস আর একটি বলে ছয় হাঁকিয়ে পরের বলে ডিফেন্স করা ব্যাটসম্যানকে প্রশংসা করা।
প্রিয় স্পোর্টস/ শান্ত মাহমুদ