কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস রোহিঙ্গা নিধন অভিযান। ফাইল ছবি

মিয়ানমারের সামরিক শক্তি বেড়েছে যেভাবে

আবু আজাদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:০৫
আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:০৫

(প্রিয়.কম) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ভয়ংকর সেনা অভিযানে খুন, কুপিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, ধর্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ঘটনা ঘটেই চলছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দমনের নামে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে’ মাত্রা ছাড়ানো নৃশংসতায় সাধারণ ও নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নাগরিক হত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। শক্তিশালী ও ভারী অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি শক্তি প্রয়োগ করছে সেনাবাহিনী, ইতোমধ্যে এমন অভিযোগ করে বিষয়টির নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। চোখ ধাঁধানো এসব নিত্য-নতুন অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে অমানবিক নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বেশ কয়েকটি দেশ ও সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে, প্রায় ২০ বছর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অত্যাধুনিক এত অস্ত্র কোথায় পেয়েছে মিয়ানমার?

সামরিক শাসনই দেশটিতে অস্ত্র সমাবেশের মূল ভিত্তি

১৯৬২ সালে সামরিক সরকার মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর গত ৫৪ বছর ধরে (২০১২ পর্যন্ত) সামরিক সরকার দেশটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। সে সময় বিভিন্ন দেশের সামরিক হুমকি মোকাবেলা, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা, সামরিক নেতাদের চাপসহ বহুমুখী কারণে মিয়ানমার অস্ত্র সংগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়ে। একপর্যায়ে দেশটি তার রাষ্ট্রীয় বাজেটের এক চতুর্থাংশ বরাদ্দ করে অস্ত্র কিনতে তথা সামরিক খাতে। ২০১৩ সালেও যার আকার ছিল ১.১৫ বিলিয়ন ডলার! তবে মিয়ানমারে অস্ত্রের উৎস ও অস্ত্র সংগ্রহের কৌশল এবং পরিধি বুঝতে দেশটির সামরিক শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে একবার চোখ বুলানো প্রয়োজেন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বেসামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলেও ১৯৬২ সালের ২ মার্চ জেনারেল নে উইনে’র নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক জান্তা। সরাসরি ক্ষমতা দখলের পর দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এমনকি বৈদেশিতক নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে সামরিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলে। পাশাপাশি সেনা সরকার বৌদ্ধ মৌলবাদের বিস্তৃতিতে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে প্রকৃতপক্ষে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দেশটিতে বসবাসরত বিভিন্ন সংঘ্যালঘু ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিম জাতি-গোষ্ঠিীর ওপর নির্মম নির্যাতন ও জীবনযাত্রায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

শান্তির প্রচারক বৌদ্ধরাও দেশটিতে রোহিঙ্গা বসবাসের বিরোধিতা করে সহিংতাকে আরো উস্কে দিচ্ছেন । ছবি: রোমিও গাকার্ড, এএফপি

সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা দেশটিতে রোহিঙ্গা বসবাসের বিরোধিতা করে সহিংতাকে আরও উস্কে দিচ্ছেন । ছবি: রোমিও গাকার্ড, এএফপি

১৯৮৮ সালে অং সান সুচির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় এনএলডি’র নেতৃত্বে সেনা শাসনে অতিষ্ঠ মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকেরা দেশটিতে গণতন্ত্রের দাবিতে সংগ্রাম শুরু করলে বিশ্বনেতারা ও বিভিন্ন রাষ্ট্র দেশটির প্রভূত সমালোচনা করেন। ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকার সুচি’কে গৃহবন্দী করে। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সামরিক জান্তা। নির্বাচনে এনএলডি বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও কিন্তু সামরিক সরকার ওই ফলাফল মেনে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। বরং বিভিন্ন অজুহাতে ক্ষমতাকে আড়ও আকড়ে ধরে রাখে।

ধারাবাহিক এসব ঘটনায় ৯০-এর দশকেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর দফায় দফায় সামরিক (অস্ত্র) ও বাণিজ্যিক অবরোধ জারি করে। তবুও থেমে থাকেনি তারা। প্রকাশ্য বা গোপন দোসরের মাধ্যমে চালিয়ে গেছে অস্ত্র সংগ্রহ আর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে মেতে উঠেছে খুন-ধর্ষণের মহোৎসবে।

ক্রমাগত অবরোধ, বিশ্ব থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ও প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপে ৫৪ বছর পর ২০১২ সালে সেনাবাহিনী প্রায় বাধ্য হয়েই বন্দুক নিয়ন্ত্রিত লোক দেখানো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, যার মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে সামরিক বাহিনীর হাতেই। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পেক্ষাপটও পরিবর্তিত হয়, তুলে নেওয়া হয় অবরোধ। এবার মিয়ানমারকে অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে রক্তপিপাসু সামরিক জান্তার হাত রাঙানোর সাহায্যে প্রকাশ্যেই এগিয়ে আসে কয়েকটি দেশ, যারা এত দিন গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।  

বিভিন্ন সেনা অভিযানে অস্ত্রের ব্যবহার, অসহায় মানুষ

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের সময়কাল থেকেই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসতি স্থাপন করেছিল রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষেরা। পরবর্তীতে বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে রাখাইনে আগত বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে ওই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে এয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে শংকরজাত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি ও ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের স্বাধীন রাজ্য নিয়ে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি অর্জন (১৪৩০-১৭৮৪) করা রোহিঙ্গাদের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে ১৭৮৪ সালে মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া কর্তৃক রাখাইন দখল ও চরম বৌদ্ধ আধিপত্যবাদের সূচনার মাধ্যমে। রাজ সেনারা হাজারো রোহিঙ্গা হত্যা করে, ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে হাজারো রোহিঙ্গা পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। প্রথমবারের মতো শরণার্থী হয় স্বাধীন রোহিঙ্গা জাতি।

রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ছবি: ই অং চুরোহিঙ্গা নিধন অভিযানে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ছবি: ই অং চু

১৯৪২ সালে জাপান কর্তৃক মিয়ানমার দখলের পরে ব্রিটিশ বাহিনীর সহায়তার অভিযানে জাপানি বাহিনী ও বার্মিজ সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যায় কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসকের হাতে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যরেখা আরও পরিবর্তত হয়। ১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বিদেশি জনগোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করে ‘রোহিঙ্গারা হলো বাংলাদেশি, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে’ মিয়ানমার সরকারের এমন ঘোষণার মাধ্যমে ওই ভূমিতে হাজার বছর ধরে বাস করা জাতিগোষ্ঠির নাগরিকত্ব অস্বীকার করলে মহাদুর্যোগ নেমে আসে রোহিঙ্গাদের জীবনে।

পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর 'নাগামান' (ড্রাগন রাজা) অভিযানে অগণিত রোহিঙ্গা নিহত এবং প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন এক সেনা অভিযানে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। এমনই ভিন্ন অভিযানে ২০১৫ সালে অন্তত ২৫ হাজার এবং ২০১৬ সালে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ ছাড়া ১৯৯৭ সালে দেশটির মান্ডালে, ২০০১ টাউনগোতে, ২০১২ সালে রাখাইনে, ২০১৩ সালে মধ্য ও পূর্ব মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে, ২০১৪ মান্ডালে, ২০১৬ সালে বাগো অঞ্চলের রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান ও দাঙ্গায় আরও অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে এ সংখ্যা (নিবন্ধিত) ৫ লাখের কিছু বেশি।

প্রতিটি সেনা অভিযান ও দাঙ্গায়ই দেশটির সেনাবাহিনী ও বার্মিজদের বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জাতিগত নিধন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ ওঠে।

জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম। ছবি: সংগৃহীত

জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম। ছবি: সংগৃহীত

২০১৭ সালের ১১ আগস্ট শনিবার রাখাইনে নতুন করে সেনা মোতায়েন এবং ২৫ আগস্ট থেকে শুরু করা ভয়ংকর ‘কিলিং মিশন’ অতীতের সমস্ত ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গেছে।  এ পর্যন্ত গুলি করে, কুপিয়ে-পুড়িয়ে-জবাই করে হত্যা, ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের মতো ভয়ংকর নির্যাতনের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইতোমধ্যে ৪ লাখ রোাহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। নিহত হয়েছে প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। অগ্নিসংযোগ ও হত্যা মিশনে জনশূন্য হয়ে গেছে ১৭৬টি রোহিঙ্গা গ্রাম। জাতিসংঘ বলছে, নির্যাতনের ভয়াবহতায় প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে।  

মিয়ামারের অস্ত্রসম্ভার

মিয়ানমার তার আয়তন ও সম্পদের তুলনায় বেশ দরিদ্র রাষ্ট্র। তারওপর ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক অবরোধ দেশটির উন্নতির পথে বেশ বাধা সৃষ্টি করেছে। তারপরও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের চেয়ে দেশটির সামরিক শক্তি ও অস্ত্র সম্ভার বৃদ্ধিকেই উন্নতির একমাত্র নির্ধারক হিসেবে মনে করেছে। ফলে স্বল্প সামর্থ্যর মধ্যেও সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে সামরিক সরকার।

সুইডেন ভিত্তিক ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনইস্টিটিউট ‘উইকিপিডিয়িা’ ও ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার.কম’ সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার যেসব অস্ত্র কিনেছে তার মধ্যে রয়েছে সশস্ত্র সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধ জাহাজ, রাডার সিস্টেম, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। দেশটির সেনাবাহিনীর আকার ৫ লাখ ১৬ হাজার যার মধ্যে ৪ লাখ ৬ হাজার নিয়মিত ও ১ লাখ ১০ হাজার রিজার্ভ সেনা সদস্য রয়েছে।

প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের মত বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গা শরনার্থীরা। ছবিটি ৯ সেপ্টেম্বর উখিয়া সীমান্ত থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা।

প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের মতো বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। ছবিটি ৯ সেপ্টেম্বর উখিয়া সীমান্ত থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা 

এ ছাড়া মিয়ানমারের হাতে যেসব অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে তার মধ্যে ১২৭টি যুদ্ধ বিমানসহ মোট ২৬৪টি সামরিক বিমান, ৯টি অ্যাটাক হেলিকপ্টারসহ ৮৬ হেলিকপ্টার, ৮৮৬টি অত্যাধুনিক ট্যাংক, ৪২১২টি বিভিন্ন ধরনের মিসাইল, ১২০০ সাঁজোয়া সামরিক যান, আকাশ প্রতিরক্ষায় অন্তত ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র, ৩৯২টি গান সিস্টেম, ১২০০ এন্টি ট্যাংক অস্ত্র, ২৭টি নেভাল ফ্রিগেড, ৪০টি পেট্রোল ক্যাফটসহ মোট ১৫৫টি নৌ-যুদ্ধযান।

অস্ত্রের মূল যোগানদাতা যারা

জাতিগত নিধনে গণহত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ বহুমুখী মানবাধিকার লঙ্ঘেনের অভিযোগে অভিযুক্ত মিয়ানমার গত শতকের ৯০ দশক থেকেই অবরোধের মুখে রয়েছে। প্রায় ২০ বছর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এত অস্ত্র কীভাবে সংগ্রহ করেছে দেশটি? সুইডেন ভিত্তিক ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনইস্টিটিউট’ এর গবেষণা অনুসারে মিয়ানমারের অস্ত্র সম্ভারের যোগানদাতাদের তথ্য পাওয়া যায়।

এতে দেখা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে দেশটির প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে চীন, রাশিয়া, ভারত, ইসরায়েল এবং ইউক্রেন। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সার্বিয়া, বেলারুশ, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, যুগোশ্লাভিয়া, পোল্যান্ড, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড রয়েছে এই তালিকায়। এসব দেশের বেশিরভাগ বিশেষত প্রথম সারির তালিকায় থাকা দেশগুলোর বেশিরভাগই গোপনে এবং পরবর্তীতে প্রকাশ্যে অস্ত্র বিক্রি করেছে মিয়ানমারের কাছে।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরপি)-এর রেজিস্ট্রারে বলা হয়, উল্লিখিত দেশের মধ্যে মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কেবল চীনের কাছ থেকে ১৬৯ কোটি ডলারের অস্ত্র সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে মিয়ানমার। অস্ত্র বিক্রিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। এসআইপিআরপি রেজিস্টারের তথ্যে জানানো হয় চীন-মিয়ানমার অস্ত্র বাণিজ্যের প্রদর্শিত ওই একই সময়ে মিয়ানমারের সাথে রাশিয়ার রয়েছে কমপক্ষে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ অস্ত্র বাণিজ্য হয়েছে। মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে রাশিয়ার পরই তৃতীয় অবস্থানে সার্বিয়া ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইউক্রেন।

সুইডেন ভিত্তিক ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনইস্টিটিউট’ প্রকাশিত তথ্য। ছবি: আল জাজিরা

বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে মিয়ানমারের অস্ত্র সংগ্রহের চিত্র। ছবি: আল জাজিরা

এদিকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে বলেও উল্লেখ করেছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনইস্টিটিউট। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার মুখে মিয়ানমারের কাছে ভারতের অস্ত্র বিক্রির তথ্য জানাজানি হলে ওই দেশ ও সংগঠনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ভারত স্বীকার করে, অস্ত্র বিক্রি নয়, অভিন্ন সীমান্তে তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিরক্ষা বিষয়ক চুক্তিতে আবদ্ধ আছে।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রির অন্যতম হোতা হিসেবে ইসরায়েলের নাম উঠে আসছে। ২০০০ সালে লন্ডনভিত্তিক গোয়েন্দা বিষয়ক জেন’স ইন্টেলিজেন্স রিভিউ প্রকাশনার এক রিপোর্টে মিয়ামার ও ইসরায়েলের মধ্যে অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় বিষয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিদ্যমান সম্পর্কের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়। তবে তা অস্বীকার করে ইসরায়েল। পরে মিয়ানমারের বর্তমান কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল মিন অং হ্লাইং ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইল সফর করে একটি অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করেন।

২০১৬ সালের শেষে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘টার আইডিয়াল কনসেপ্টস’ মিয়ানমারের কাছে ১০০ ট্যাঙ্ক ও বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এসব অস্ত্র মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হত্যায় (২০১৬ সালের অক্টোবরের রাখাইনে সেনা অভিযান) ব্যবহৃত হচ্ছে অভিযোগ তুলে মানবাধিকার কর্মীরা আদলতে মামলা করলে প্রাথমিক শুনানিতে সরকার জানায়, ‘তাদের এই অস্ত্র বিক্রি কূটনৈতিক। এক্ষেত্রে আদালতের বলার কিছু নেই’। ঘটনাটির নিন্দা জানিয়ে ইসরাইলের মানবাধিকার বিষয়ক কর্মী ওফের নেইম্যান বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের কাছে ইসরাইলের প্রতিটি সরকার অস্ত্র বিক্রি করেছে। তবে উত্তর কোরিয়া-মিয়ানমারের সামরিক সম্পর্কের বিষয়টি যাচাই করা খুবই দুষ্কর। কারণ এশিয়ায় এই দুটি দেশই অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে।

এদিকে মুখে মানবতার বুলি আওড়ে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে গোপনে মিয়ানমাকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনইস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এর আর্মস ট্রান্সফারস প্রজেক্টের গবেষক সিমন ওয়েজম্যান ২০০৭ সালের এক গবেষণা প্রবন্ধে লিখেছেন, মিয়ানমারে অস্ত্র বিক্রির যতটুকু জানা যায় তা বৈধ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি তমসাচ্ছন্ন। কারণ আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এমন কিছু দেশ আছে তারা নিজেদের ভাবমূর্তিকে উন্নত দেখাতে চায়। কিন্তু মুখোশ পরে অস্ত্র বিক্রি করে।

প্রিয় সংবাদ/শান্ত/রিমন