প্রতীকী ছবি
কখন চিকিৎসকের স্বীকার করা উচিত তারা জানেন না
আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:২৫
মেডিকেল স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর পরিবার আর বন্ধুদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লো আমি শহরের সবচেয়ে নামীদামী হাসপাতালে কাজ শুরু করছি। শুরু হলো তাদের পরামর্শ চাওয়া।
প্রথমেই ছিল মায়ের এক বন্ধু। তিনি আমার কাছে পরামর্শ চাইলেন হাঁটু প্রতিস্থাপনের অপারেশন করাবেন কী না। মেডিকেলের চূড়ান্ত বর্ষে মাত্র কয়েকজন এরকম রোগী দেখার ‘বিপুল অভিজ্ঞতা’ আর একগাদা অহংবোধ নিয়ে তাকে ফ্রিতে পরামর্শ দিতে আমি যেন তৈরি হয়েই ছিলাম।
একদিন বাড়িতে চিকিৎসার ইতিহাস নিয়ে হাজির হলেন এক চাচা। ২০ বছর আগে ব্যাথা পেয়েছিলেন তিনি। এখনও চাপ পড়লে ব্যাথা পান। ভেবেছিলেন সুচিকিৎসা পাবেন। মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞের মতো আমিও আগ্রহ নিয়ে তাকে দুই পয়সার পরামর্শ শুনিয়ে দিলাম।
এরপর আমার এক বন্ধু। বেচারা দীর্ঘদিন ধরে শহরের ক্লিনিকগুলোতে তার মাতৃত্বের জন্য ঘোরাঘুরি করছিলো। একবার আমার কাছে সাহায্য চাইতেই তাকে সমাধান শোনাতে আমার বেশিক্ষণ লাগলো না।
কখনও কার্ডিওলোজিস্ট, কখনও মানসিকরোগ বিশেষজ্ঞ, কখনও কিডনি বিশেষজ্ঞ, কখনও স্নায়ুবিশেষজ্ঞ, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞও কি ছিলাম না আমি? হয়ে উঠেছিলাম ফ্রি পরামর্শের বিশেষজ্ঞ। সবার চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্যায় আমি সামনে এসে দাঁড়াতাম। সঙ্গে থাকতো একগাদা অহংবোধ।
প্রত্যেক ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতাম আমার ‘আধাপাকা’ পরামর্শ এসব রোগীর ভালো করতে না পারলেও যেন খারাপ কিছু না ঘটায়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমি মনে রাখতাম তাদের মেডিকেল সমস্যার বিষয়ে ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতার বেশি নেই আমার।
আমি এমন এক পদ্ধতির ফ্রেশ মেডিকেল গ্রাজুয়েট ছিলাম, যেখানে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার বিষয়ে বিস্তারিত শেখানো হলেও মেডিকেল এথিকস নিয়ে এক লেকচারও শুনিনি।
একটা ডিগ্রি ছিলো আমার। কিন্তু এর সঙ্গে যে দায়িত্ব এসে পড়ে তা ছিলো না। আমি জানতাম না, কীভাবে আর কখন তাদের পরামর্শ দিতে হবে। ফ্রি পরামর্শ দেওয়া নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। কোনো কোনো সময় এটা দায়িত্বও বটে। আমার মনে হতো, এই ভালো কাজের মধ্য দিয়ে আমি সমাজের উপকার করছি। সামাজিক কর্তব্য পালন করছি।
আর আমি নিশ্চিত এই কাজ করা ব্যক্তি শুধু আমিই ছিলাম না। আমাদের সমাজে এটা খুবই প্রচলিত যে, মানুষ তাদের চিকিৎসার ইতিহাস খোলামেলাভাবে পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। আর আশপাশে যদি একজন ডাক্তার থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। অন্যদিকে ডাক্তাররাও উদারভাবে তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর সমস্যার বিস্তারিত না জেনেই।
এই চল শুধু নতুন ডাক্তারদের ক্ষেত্রে নয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুরো মেডিকেল কমিউনিটির বিভিন্নস্তর এই সমস্যায় জর্জরিত।
ডাক্তাররা কখন তার রোগীকে বলবেন, ‘আমি জানি না?’ এটা খুবই কঠিন প্রশ্ন। চিকিৎসকরা তাদের প্রশিক্ষণ আর শিক্ষার সবস্তরেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে শিখে থাকেন। উত্তর ‘না দেওয়া’ অথবা ‘জানি না’ বলাকে কখনওই ভালোভাবে দেখা হয় না।
সঠিক রোগনির্ণয় আর সরাসরি ওই রোগের চিকিৎসার বিষয়ে চাপে থাকেন ডাক্তাররা। তাদের কাছে রোগীরা আসে বিপুল আশা নিয়ে। জটিল সব প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারা হ্যা-না উত্তর পেতে চায়।
বেশিরভাগ লোকই বুঝতে চায় না ওষুধ হলো অনির্দিষ্টতায় ভরা এক সমুদ্র, আর ডাক্তাররা হলেন সেই সমুদ্রের নাবিক। তারা বই পড়েন, রোগ কিন্তু তা পড়ে না। ডাক্তাররা উপায় ঠিক করে দেয়, রোগ তা সব সময় মেনে চলে না। ডাক্তাররা মেডিকেল গাইডলাইন অনুসরণ করে, কিন্তু এই গাইডলাইন প্রায়ই পাল্টে যেতে থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ের জটিলতা নিরাময় কেন্দ্রে বহুবছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে প্রতিনিয়ত বিনয়ী করে তুলেছে। এমন কোনো দিন যায়নি যে, আমি বুঝতে পারিনি আমি কতোটা কম জানি। টেবিলের উপর জমতে থাকা মেডিকেল জার্নাল আর রিসার্চ আর্টিকেল আমাকে প্রতিনিয়ত আমার না জানার অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
এই সব না জানার অভিজ্ঞতা কি রোগীদের জানানো ঠিক হবে? তারা যদি জানতে পারে তাদের ডাক্তার এটা জানে না, তখন কী ভাববে? রোগীরা কি ডাক্তারের উপর ভরসা হারিয়ে ফেলবে? এই সমস্ত বিষয় ডাক্তারকে রোগীদের ‘জানি না’ বলতে বাধা দেয়। কখনো এটাও ঘটে যে, যখন তারা আসলেই জানে না তখনও তারা তা বলতে পারে না।
ডাক্তাররা যদি রোগের জটিলতা সম্পর্কে রোগীকে জানাতে সময় নেয়, সঠিক রোগ ধরতে কী করা লাগবে তা জানায়, চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ে বিস্তারিত জানায়, কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে তা জানায়, তাহলে ডাক্তার আর চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর তাদের বিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে।
যখন রোগী বুঝবে যে তার ডাক্তার সমস্যা ধরার বিষয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন তার সঙ্গে সমপর্ক গাঢ় হবে। দ্রুত বিশ্বাস তৈরির ঝোঁকও তৈরি হবে। সবকিছুর পরে সঠিক রোগ ধরতে পারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ওষুধ সম্পর্কে জানার বিষয়টি একটা বিজ্ঞান, আর তা কাজে লাগানো একটা আর্ট। আমার আবাসিক প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ও গুরু ডা. টড গ্রেস প্রথম ফিডব্যাক মিটিংয়ে একটি বাক্য বলেছিলেন। ২০ বছরের চিকিৎসক জীবনে আমি কখনও তা ভুলিনি। বাক্যটি ছিলো, ‘আমি জানি না, তবে খুঁজে বের করবো।’
লেখক: ডা. সারমাদ চৌধুরী। তিনি ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন ও পুলমোনারি বিশেষজ্ঞ। সৌদি আরবের জেদ্দার কিং ফয়সাল হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টারের পুলমোনারি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি কমিউনিটি সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিষয়ক সচেতনতা তৈরির সঙ্গে কাজ করছেন।