কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

সুজেয় শ্যাম। ছবি: সংগৃহীত।

'বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করতেই অনেকের বাধে, এই অসভ্য দেশে আমি কী লিখবো?’

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:১৮
আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:১৮

(প্রিয়.কম) সুজেয় শ্যাম। বাংলাদেশের খ্যাতিমান সুরকার ও সংগীত পরিচালক। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন অন্যতম গুণী সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠযোদ্ধা। চলচ্চিত্রের সংগীতে অসমান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বেজেছিল তার সুর করা জনপ্রিয় গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ গানটি। বিজয়ের মাসে প্রিয়.কম এর সঙ্গে কথা হলো গুণী এই সুরকারের সঙ্গে।

প্রিয়.কম: শরীর কেমন দাদা? অনেকদিন ধরেই বোধহয় অসুস্থতায় ভুগছেন?

সুজেয় শ্যাম: ভালো না। একে তো ডায়াবেটিস, তার উপর চোখের অবস্থা মারাত্মক খারাপ। ডান চোখটাকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারবো না। এখন আমাদের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেও বিব্রত হই। টিকেট কেটে বসে আছি রে বোন, যেদিন ডাক আসবে, চলে যেতে হবে।

প্রিয়.কম: দেখতে দেখতে আবার চলে এলো বিজয়ের মাস। স্বাধীনতার ৪৬ বছর। বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? তারা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করতে পেরেছে? আপনার মূল্যায়ন কী?

সুজেয় শ্যাম: একাত্তরের চেতনায় বর্তমান তরুণ প্রজন্ম উজ্জীবিত, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা আসলে সঠিক ইতিহাস জানতে চায়। আমরা কী তাদের সঠিক ইতিহাসটা জানাতে পারছি? তুমি দেখবে, তাদের কিন্তু জানার ব্যাপারে প্রচুর আগ্রহ আছে, তারা জানতে চায় কিন্তু সঠিক ইতিহাসটা জানতে পারছে না। ফলে কি হচ্ছে বলো তো? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তারা এক রকম বিভ্রান্ত হচ্ছে। দেশ এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু তরুণ প্রজন্মের, তাই তাদের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে সাহায্য করতে হবে।

প্রিয়.কম: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে গানটি বেজেছিল, সেটার সুরকার আপনি। ঐ স্মৃতি সম্পর্কে একটু বলবেন?

সুজেয় শ্যাম: ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। প্রতিদিনের মতো সেদিনও গান করতে বসেছি। কিন্তু এরইমধ্যে একজন আমার কাছে এসে বললো বিজয়ের গান গাইতে হবে। এখন বিজয়ের গান তো আমাদের কাছে নেই, এত অল্প সময় বিজয়ের গান কোথায় পাবো ভাবছিলাম। সেখানে শহীদুল ইসলাম ছিলেন, তিনি বললেন অসুবিধা নেই, আমি লিখে দিচ্ছি। তিনি তাৎক্ষণিক লিখলেন বিজয় নিশান উড়ছে ঐ। গানটি সুর করার পর রেকর্ড করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সেখানে এলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি বেতার থেকে একটা ভাষণ দিলেন, তার ভাষণের পরপরই অজিত রায়ের নেতৃত্বে বিজয় নিশান উড়ছে ঐ গানটি আমরা গেয়েছি।

প্রিয়.কম: দাদা, এ বছরেই চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শিল্পী এবং আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল জব্বার। এক একজন করে সবাই চলে যাচ্ছেন। কিন্তু এ ৪৬ বছরে স্বাধীনতার গানগুলো সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কী?

সুজেয় শ্যাম: স্বাধীনতার যে গানগুলো এখন নতুন শিল্পীদের গলায় শুনতে পারছো- আমি আড়াই-তিন মাস কষ্ট করে ক্লোজ আপ ওয়ানের বাচ্চাদের এগুলো দিয়েছি। যে গানগুলো ওরা গায়, এগুলোর সুর আমি তুলে দিয়েছি ওদের। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান পদে আমিন চৌধুরী যখন ছিলেন তখন তিনি দুইটা সিডি রেকর্ড করেছিলেন একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে নামে। উনি ঐ উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে গানগুলো বেঁচে গেল। এখন স্বাধীনতার যেই গানগুলা শোনা যায়, সেগুলো উনার অবদান। আর এনটিভিতে যখন নওশাদ ভাই কাজ করতেন, তখন উনারা আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের গানগুলো দিতে বললেন। ঐখানে আমি পঞ্চাশটা গান করেছিলাম। ঐ সিডিগুলো রেকর্ড হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আর বাজারজাত হয়নি।

প্রিয়.কম: এনটিভির নওশাদ সাহেব কিংবা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আমিন চৌধুরী- এগুলো তো ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা বলছেন দাদা। সরকারিভাবে তো স্বাধীনতার গানগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত আগে।

সুজেয় শ্যাম: ভাই রে, এগুলো বলতে বলতে আমি ক্লান্ত। এসব বলে আর লাভ নাই। তুমি জানো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, গান- সব নিয়ে আমাকে অনেকেই বই লিখতে বলে, আমি তাদের বিনয়ের সঙ্গে না করে দিই।

প্রিয়.কম: কেন না করেন? অভিমান থেকে নাকি রাগ থেকে? কোনোকিছু নিয়ে আপনার কষ্ট আছে ভেতরে?

সুজেয় শ্যাম: শোনো, যে দেশে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা’ হিসাবে স্বীকার করতেই অনেকের বাধে, এই অসভ্য দেশে আমি কী লিখবো? কেন-ই বা লিখবো? দেখো, পাকিস্তানীদের আমরা কি বলছি- বর্বর, অত্যাচারী, অসভ্য, মৌলবাদী। কিন্তু জিন্নাহকে এক বাক্যে তারা জাতির পিতা মানে, এটা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ নেই। একইভাবে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে এত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও কিন্তু মহাত্মা গান্ধীই তাদের জাতির পিতা মানা নিয়ে কোনো বিবাদ নেই তাদের। কিন্তু যে মানুষটা এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজের পুরোটা জীবন দিয়ে দিলেন, তাকে নিয়ে আমরা বিতর্কে জড়াই- এরচেয়ে কষ্টের কী আছে? কি দেশ স্বাধীন করলাম আমরা?

প্রিয়.কম: দেশ স্বাধীনে আপনাদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। আপনার কী মনে হয়, স্বাধীন দেশে আপনারা আপনাদের প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন?

সুজেয় শ্যাম: একটু আগেই তো তোমাকে বললাম। যে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক করতে পারে, সে দেশ আমার মতো সুজেয় শ্যামকে নিয়ে কী ভাববে? আমি তো আশাও করি না।

প্রিয়.কম: অভিমান থেকে বলছেন এসব?

সুজেয় শ্যাম: কিসের অভিমান? কার উপর অভিমান করবো? এ দেশের রাজনীতিদবিদরা এখন যেসব কথা বলে, সেসব শুনলে কষ্ট হয়। উনারা কথা বলার সময় মনেই রাখেন না, কাদের ত্যাগের ফলে, কাদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এ দেশ পেয়েছি আমরা, এ দেশ বঙ্গবন্ধুর কষ্টের ফসল। কাকে বুঝাতে যাবো এসব? যারা স্বাধীনতার চেতনা বুকে ধারণ করেন, তাদের সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। আমিও সময় হলে চলে যাবো।

প্রিয়.কম: রাষ্ট্রের তো একটা দায়িত্ব আছে আপনাদের জন্য...

সুজেয় শ্যাম: আমার একটা কথার উত্তর দাও- বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তুমি শিল্পীদের এ রকম বেহাল দশা দেখেছো? মাহমুদুন্নবী, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীরা চাররি করে না, গান গেয়ে সংসার চালাতেন। আজকে সৈয়দ আব্দুল হাদীর মতো মানুষকে চাকরি করতে হয়। সুবীর নন্দীর মতো শিল্পীকে চাকরি করতে হয়! শুধুমাত্র গান গেয়ে আমাদের সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আর আমাদের গান গাইতে ডাকছেই বা কয়জন? বাইরে থেকে শিল্পী আনছে, ভারত থেকে শিল্পী এনে কনসার্ট যারা চালাচ্ছে, আমাদের একটা অনুষ্ঠানে তারা কত পারিশ্রমিক দিচ্ছে- এই খবর রাখছে কেউ?

প্রিয়.কম: এখন তো চ্যানেল বেড়েছে। আগে না হয় বিটিভি একমাত্র চ্যানেল ছিল। তবুও চ্যানেলগুলো কেন আপনাদের ডাকে না?

সুজেয় শ্যাম: ডাকে তো। কিন্তু প্রতিটা চ্যানেলেই ঘুরেফিরে কিছু দিন পরপর একই শিল্পীদেরই ডাকে।

প্রিয়.কম: কেন? একই শিল্পীদের ডাকার কারণ কী? আর্টিস্টদের ভ্যারিয়েশন আনলেই না দর্শক অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহ পাবে...

সুজেয় শ্যাম: তেল যে দিতে পারবে, তাকেই তো বারবার ডাকবে। পৃথিবীর কোথাও শুনেছো শিল্পীদের কালো তালিকা হয়? আমাদের দেশে এটা বছরের পর বছর হয়ে আসছে। সব সরকারের আমলে এক একটা নতুন কালো তালিকা করা হয়, তারপর সেই তালিকা অনুযায়ী শিল্পীদের ব্যান করা হয়। যখন যে সরকার থাকে, শুধু সে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা শিল্পীরাই কাজ পায়।

প্রিয়.কম: বিজয়ের মাসে দেশের মানুষের কাছে বা দেশের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

সুজেয় শ্যাম: নতুন প্রজন্মই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। তাই তাদের বিভ্রান্তিতে না রেখে সত্যটা জানাতে আমাদের সবার সাহায্য করা উচিত। এখানে রাষ্ট্রের যেমন দায় আছে, প্রতিটা ব্যক্তি মানুষেরও সচেতন হওয়ার বিষয় আছে।

প্রিয়.কমধন্যবাদ দাদা, অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রিয়.কম সময় দেওয়ার জন্য।

সুজেয় শ্যাম: তোমাকে আর প্রিয়.কমকে ধন্যবাদ।

প্রিয় বিনোদন/গোরা