কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বালুখালীতে গড়ে তোলা হয়েছে ক্যাম্প। ছবি: ফোকাস বাংলা

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার জন্য কী কাগজপত্র আছে?

আবু আজাদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৬
আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৬

(প্রিয়.কম) সেনা নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে যে সমঝোতা বা অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে তথ্য প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে তাদের ফেরত নেয়া হবে। দুই মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেও উল্লেখ রয়েছে ওই সমঝোতায়। কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তাৎক্ষণিক পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অনেকেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনার সময়টুকুও পাননি। তবে কোন কাগজপত্র ছাড়া কীভাবে তাদের ফেরত পাঠানো হবে?

কাজগপত্র না নিয়ে পালিয়ে আসা এমনই একজন শরনার্থী ফাতেমা বেগম। যিনি আশ্রয় নিয়েছেন কুতুপালং শরনার্থী শিবিরে। তার ভাষ্য, ওই পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচানোই তার কাছে মুখ ছিল।

তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র ছিল কিন্তু সব পুড়ে গেছে। আমরা জীবন নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসেছি। আমরা অত্যাচার, জুলুম সহ্য করতে না পেরেই চলে এসেছি বাবা...।’

ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের সবারই মোটামুটি একই রকম বক্তব্য। তারা চান রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, সমান সুযোগ ও নাগরিক অধিকার এবং স্থায়ী শান্তি। এসব নিশ্চিত না হলে তারা আর রাখাইনে ফিরতে চান না। ফাতেমা বেগম বলছিলেন তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ফিরতে পারবেন মিয়ানমারের অধিবাসী, যারা স্বেচ্ছায় যেতে আগ্রহী, অভিভাবকহীন এবং আদালতে স্বীকৃত বাংলাদেশে জন্ম নেয়া শিশু। ফিরতে হলে সবাইকে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। এজন্য লাগবে নাগরিক পরিচয়পত্র, জাতীয় নিবন্ধন। আর আবাসস্থলের প্রমাণ করতে লাগবে বসবাসের ঠিকানা, ব্যবসা বা জমির দলিল, স্কুলের পরিচয়পত্র, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ইস্যুকরা কাগজপত্র।

রাখাইনে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নুরুল আমিন এখন ক্যাম্পের বাসিন্দা। ছবি: বিবিসি বাংলা

রাখাইনে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নুরুল আমিন এখন ক্যাম্পের বাসিন্দা। ছবি: বিবিসি বাংলা

রাখাইনে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নুরুল আমিন এখন বালুখালি ক্যাম্পের বাসিন্দা। এসেছেন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। সঙ্গে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে। নুরুল আমিন আসার সময় হাতের কাছে থাকা সব কাগজপত্রই এনেছেন। যার মধ্যে আছে জমির দলিলপত্র, ব্যবসার লাইসেন্স এবং রাখাইনে কর্তৃপক্ষের দেয়া সাময়িক সনদ।

২০১০ সালে তারা ভোট দিয়েছিল এমন একটি কার্ডও আছে তার সঙ্গে। স্থানীয় চেম্বার অব কমার্সের ইস্যু করা একটি পরিচয়পত্র আছে নুরুল আমিনের। রাখাইনে ২০ একর জমিতে মাছ, ধান ও বনায়নের সমন্বিত প্রকল্প ছিল নুরুল আমিনের। সেই খামারের কয়েকটি স্থিরচিত্র নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। নুরুল আমিন যেসব তথ্য প্রমাণ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন রাখাইনের অধিবাসী প্রমাণে এটি যথেষ্ট। নিজ দেশে ফেরার প্রশ্নে নুরুল আমিন জানান তাদেরও কিছু শর্ত আছে।

তিনি বলেন, ‘প্রথম শর্ত হলো আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো অধিকার দিতে হবে। আর আমার যে জমিজমা, ব্যাবসা-প্রজেক্ট ছিল সেগুলো ফেরত দিতে হবে। আমরা চলে যাব। আমরা আমাদের দেশেই থাকতে চাই।’

সরকার বলছে, ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে এই অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এরকম ব্যবস্থার মাধ্যমে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।

চতুর্থবার বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন শরীফ খান। ছবি: বিবিসি বাংলা

চতুর্থবার বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন শরীফ খান। ছবি: বিবিসি বাংলা

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন লোকজন রয়েছে যারা একাধিকবার দু'দেশে যাওয়া আসা করেছেন। আশির কাছাকাছি বয়স হোসেন শরিফ এই নিয়ে চতুর্থ বার বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তার কাছে বাড়ির নম্বর প্লেটসহ দলিলপত্র ছবি সবই আছে। সেই সাথে সঙ্গে আছে দু'দেশে আসা যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতি।

১৯৭৮ সালে তিন সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। বছরখানেক পর ফেরত গিয়ে আবার ১৯৯১ সালে আসতে হয়েছে পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে। ওই দফায় বাংলাদেশে ছিলেন তিন বছর। এবার নয় সন্তান আর নাতি-নাতনি নিয়ে আবার বাংলাদেশে। এখন আবার ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে হতাশ হোসেন শরীফ।

শরীফ খান বলেন, ‘আমরা আর কত কষ্ট করবো। আর কতবার দুঃখ সহ্য করবো। আর ভাল লাগে না। মনে হয় মরলে এখানেই মরবো। আমাদের দেশ আমাদের দিলে, রোহিঙ্গা হিসেবে মেনে নিলে যাব, নইলে যাব না।’

দুই দেশের স্বাক্ষরিত সমঝোতায় বলা হয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে যুক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর জানাচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো তারা এই দলিলের কপি পায়নি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে ইউএনএইচসিআর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মোহাম্মেদ আবু আসকের। ছবি: বিবিসি বাংলা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে ইউএনএইচসিআর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মোহাম্মেদ আবু আসকের। ছবি: বিবিসি বাংলা

তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সংস্থাটির পক্ষে মোহাম্মেদ আবু আসকের বলেন, ‘তারা দেশহীন শরণার্থী। তারা কোন্ দেশের সেটি প্রমাণ করার মতো তথ্য প্রমাণ তাদের হাতে নেই। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্বাক্ষরিত অ্যারেঞ্জমেন্টের বিষয়টি আমরা জেনেছি। আমরা অফিসিয়ালি এটি পাইনি, কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমরা চাচ্ছি টেকসই সমাধান।’

আবু আসকের আরও বলেন, ‘তাদের নাগরিকত্বসহ মূল সমস্যার সমাধান আমরা চাই। এখানে অনেকেই কয়েক দফা এসেছে আবার ফেরত গিয়েছে। আমরা চাইনা বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক।’

এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে সব রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যে জটিল প্রক্রিয়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে শর্ত যাই থাকুক এই ব্যবস্থা হলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সূচনামাত্র।

বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের সচিব মো. শাহ্ কামাল। ছবি: বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের সচিব মো. শাহ্ কামাল। ছবি: বিবিসি বাংলা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ্ কামাল বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই একটি লোকের যখন ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, তাকে যখন বলপূর্বক বিতাড়িত করে, তখন তার কাগজপত্র নেয়ার কোনো সময় সুযোগ থাকে না। তারপরও যাদের আছে তাদের তো আছেই। বাকিদের ব্যাপারে ইউএনএইচসিআর, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়গুলো ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় দফা, তৃতীয় দফা আলাপ আলোচনা করবে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

প্রিয় সংবাদ/কামরুল