কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

শরদিন্দুর জনপ্রিয় জামা হ্যারি পটার ও গুলফেম। ছবি কৃতজ্ঞতা: শরদিন্দু

'আমার ভেতরে অর্ধেক আমি, অর্ধেক শরদিন্দু'

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:০৬
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:০৬

(প্রিয়.কম) 'আমার ভেতরে অর্ধেক আমি, অর্ধেক শরদিন্দু।' ঠিক এই কথাটিই বলেছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম একজন তরুণ উদ্যোক্তা হাবিবা আক্তার সুরভী। অনলাইন ভিত্তিক রুচিশীল জামাকাপড়ের দোকান শরদিন্দুর প্রধান কর্ণধার ও উদ্যোক্তা তিনি। একইসাথে পড়ালেখা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তৃতীয় বর্ষে।

শরদিন্দুর সূচনা হয় বিকল্প আয়ের উৎসের খোঁজে! প্রশ্ন জাগবে ‘বিকল্প আয়ের উৎস’ মানে কী? এটা জানার জন্যে যেতে হবে একটু পেছনের সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে সুরভী নিজের হাতখরচের জন্য বাচ্চাদের একটি ছোট স্কুলে ছবি আঁকা শেখাতেন। হুট করেই এই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ বিপাকে পড়ে যান তিনি। টিউশনি করলে হাতখরচের টাকা খুব সহজেই উঠে আসে। কিন্তু সুরভী টিউশনিতে আগ্রহী নন মোটেও। এমন কোন কাজ তিনি করতে চাচ্ছিলেন, যার নিয়ন্ত্রক হবেন তিনি নিজেই।

শরদিন্দু ছবি ০১

এক্ষেত্রে নিজের পছন্দমতো কাজ খুঁজে বের করাটা বেশ কঠিন। তবে সুরভী সবসময় একটা কথা বিশ্বাস করতেন- 'মানুষ মন থেকে যে কাজটি করেন সেটাতেই তিনি সবচাইতে ভালো ফল পান ।' এই বিশ্বাসের জের ধরেই খেয়াল করে দেখলেন রঙ, পোশাক, ভিন্নতা, গতানুগতিকের বাইরে কিছু কাজ করে সকলকে চমকে দেওয়ার মাঝে তার ভালোলাগা কাজ করে।

রঙ নিয়ে তার প্রতিদিন নাড়াচাড়া করা হলেও রঙ ও পোশাকের মাঝে মেলবন্ধন ঘটানোর মতো ব্যাপারটিতে তার তেমন জ্ঞান ছিল না তখনো। ভরসা হলো ইউটিউব। বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে টাইডাই এর কাজ শেখা শুরু করলেন সুরভী। নতুন কাজটি শিখতে ও করতে দারুণ মজা পেয়ে যান প্রথম থেকেই। সাদা একটি কাপড় রঙিন পানিতে ডুবালেই বিভিন্ন প্যাটার্ণ ও নকশার ডিজাইন তৈরি হয়ে যায় একেবারে জাদুর মতো। দারুণ এই উপভোগ্য ব্যাপারটিকে সঙ্গে নিয়েই শুরু হলো সুরভী ও শরদিন্দুর পথচলা।

একদম শুরুতে টাইডাই এর পণ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে টাই-ডাই, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্ট নিয়ে কাজ করছেন সুরভী। শুরুর দিকে শুধু সেলাইবিহীন জামা ও থ্রি-পিস এর কাপড় পাওয়া গেলেও চলতি বছরের শুরু থেকেই কয়েকটি সাইজের রেডিমেড সেলাইসহ জামা পাওয়ায় যাবে শরদিন্দুতে। শরদিন্দুর প্রতিটি জামা তৈরি করা হয় কয়েকটি ধাপে অনেক যত্ন ও সময় নিয়ে। প্রতিটি জামার জন্য নতুন ডিজাইন তৈরি করা, ডিজাইন চূড়ান্ত হয়ে যাবার পরে পছন্দমতো জামার কাপড় কেনা, কারখানা থেকে ব্লক বা প্রিন্ট জামাতে বসিয়ে পরিপূর্ণভাবে একটি জামা তৈরি করতে ৭-১০ দিন সময় প্রয়োজন হয়।

শরদিন্দু ছবি ০২

শরদিন্দুর প্রতিটি জামার ডিজাইন ভিন্নধর্মী ও নজরকাড়া। প্রথম থেকে প্রতিটি ডিজাইন সুরভী নিজে করলেও মাস দুয়েক ধরে একজন সহকারী ডিজাইনার জামার ডিজাইন তৈরিতে সাহায্য করছেন তাকে। ভিন্নধর্মী কাজের ধারা নিয়ে পথ চলা শরদিন্দুর সর্বাধিক বিক্রিত জামাগুলো হচ্ছে ‘ভূতের বাড়ি’, ‘হ্যারি পটার’ এবং ‘মমতাজমহল’। নাম শুনেই আন্দাজ করা যায়, কেন এই জামাগুলো ক্রেতাদের নজর কেড়েছে। এই তিনটি জামা ছাড়াও নীল সরা, গুলফেম, সাগরিকা, অরণ্য, সেতারা বিবি, তারামন বিবি জামাগুলোও বেশ বেশ জনপ্রিয়তা। চমৎকার এই জামাগুলোর দাম ১৩০০- ৩০০০ এর মাঝেই।  

শুরুটা একা হলে বর্তমানে শরদিন্দুর পেছনে সুরভী একাই কাজ করছেন না। তার সাথে আছেন ব্যবসায়িক পার্টনার তানবীর হোসাইন রিফাত। ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে এলএলবি তে পড়াশোনা করছেন তিনি। দুজনের মাঝে বোঝাপড়া বেশ ভালো হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে তেমন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না তাদের। দুইজনেই জানেন কে কোন কাজটি ভালো পারেন। সেইরূপ নিজ নিজ দায়িত্ব ভাগ করে নেন নিজেদের মাঝে।

তবে দুজনের মাঝে কাজের খাতিরে তর্ক যে একেবারেই হয় না সেটা কিন্তু নয়। তর্ক তৈরি হলেও সেটা হয় গঠনমূলক তর্ক। যার মাঝে থেকে নিজেদের ভুলগুলো বের করে নিজেদের কাজকে আরো খানিকটা গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।

শরদিন্দু ছবি ০৩

সুরভীর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ক্রেতাদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পান তার ভিন্নধর্মী কাজের জন্য। উত্তরে তিনি বলেন, 'আলহামদুল্লিলাহ, বেশ ভালো সাড়া পাই। বাঙ্গালী নারী ক্রেতা হিসেবে খুবই আন্তরিক। তারা খুব সহজেই ভিন্ন ধারার নকশাগুলোকে সমাদর করে,ভিন্ন রকম এবং নান্দনিক কাজের প্রশংসা করে,সময়মত পণ্যটি হাতে পৌছে দিলে সুন্দর করে দুলাইনে ধন্যবাদ প্রকাশেও দ্বিধাবোধ করে না।'

এক বছর পার করে ফেলা শরদিন্দুর ফেসবুক পেইজের লাইকের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে। সুরভী আশা করেন খুব দ্রুতই অর্ধলক্ষে পৌঁছে যাবে এই সংখ্যা। শুধু লাইকের সংখ্যা দিয়েই তিনি নিজের কাজের বিচার করেন না। নিজের কাজের পরিসর ও মানের ব্যাপারে দারুণ সতর্ক তিনি সবসময়। তিনি বলেন, 'শরদিন্দু এর চলার পথে আমরা নিজেরাই নিজেদের অনুপ্রেরণা,আমরা প্রতিদিন নিজেরাই  নিজেদের ভাঙ্গতে চাই,আমাদের কাজের পরিসর বাড়াতে চাই, প্রতিটা পোষাকের ডিজাইন থেকে ফটোগ্রাফি মার্কেটিং সবকিছুতেই একটা জিনিস আমাদের মাথায় থাকে তা হচ্ছে-এটা ঠিক আগেরটা থেকে ভালো হতে হবে।'

কাজের ক্ষেত্রে সকলের প্রশংসা ও শুভকামনা থাকলে সমস্যাও কম থাকে না। এর মাঝে ছবি চুরির ব্যাপারটি নিয়ে অনেক ভুগতে হয়। বিশেষ করে, শরদিন্দুর পোশাকের ডিজাইন নকল করে নিম্নমানের কাপড় দিয়ে অন্য পেইজ একই রকম জামা বানিয়ে থাকে। এতে অনেক ক্রেতাই প্রতারণার শিকার হন। যা অনেকাংশে শরদিন্দুর প্রতি নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে দেয়।

শরদিন্দু ছবি ০৪

এমন ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণও করে ফেলেন সুরভী ও রিফাত। সুরভীর সারাদিন কাটে এই শরদিন্দুকে নিয়েই। তার সকল ভালো স্মৃতি, আনন্দের কারখানা যেন এই শরদিন্দুতেই। আর শুরুতেই তো তিনি জানিয়ে দিয়েছেন- আমার ভেতরে অর্ধেক আমি, অর্ধেক শরদিন্দু!

যার পুরো দুনিয়া ঘিরেই শরদিন্দু, সেই শরদিন্দু ঘিরে তার স্বপ্নটাও খুব চমৎকার। আগামী দশ বছরের মাঝেই বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি ফ্যাশানহাউজ হিসেবে শরদিন্দুকে প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। নিজের কাজের প্রতি যার রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা, তার এমন স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণ হওয়াটাই সমীচীন।  

প্রিয় লাইফ/ কে এন দেয়া