কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পরিচিতি পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে না পেরে বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। ছবি: ফোকাস বাংলা

যেভাবে আজকের রোহিঙ্গা সংকট

জাহিদুল ইসলাম জন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৩৯
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৩৯

(প্রিয়.কম) সীমান্ত পেরিয়ে আসা গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই নতুন সংখ্যায় রোহিঙ্গারা ঢুকছেন বাংলাদেশে। মৃত্যুফাঁদ পেছনে ফেলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সামনে রেখে প্রাণ হাতে নিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরে এই পালিয়ে আসা চলতে থাকলেও শেষ দুই সপ্তাহের মধ্যে এসেছেন অন্তত তিন লাখ মানুষ। কেন তাদের এভাবে পালাতে হয়? ইতিহাস ঘেঁটে দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ইতিহাস।

বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারের পরিচয়টি মধ্যপ্রাচ্যের গাজা থেকে প্রতিস্থাপিত হতে চলেছে মিয়ানমারের রাখাইনে! নবম দশম শতাব্দীর ‘রোহাঙ’ কালক্রমে বাংলা সাহিত্যে হয়ে ওঠে আরাকান। আর তার বাসিন্দাদের পরিচয় হয় রোহিঙ্গা নামে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এখন তাদের বিশ্বের সবচে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলে অভিহিত করছে। মুসলিম ধর্মাবল্বী এই জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় কয়েকশতক ধরে নিপীড়নকেই ভাগ্য মানতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

রোহিঙ্গা নেতারা দাবি করে থাকেন, সপ্তম শতকে পারস্যের বণিকদের দ্বারা আরাকানে মুসলমানদের উদ্ভব। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে তাদের সঙ্গে আত্মীকৃত হতে থাকেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মুসলমানরাও। দীর্ঘদিনে ধরে স্বাধীন থাকার পর চৌদ্দ শতকে বার্মার রাজাদের অধীনে চলে যায় আরাকান। পরবর্তী শতাব্দীতে এসে ভারতীয় মোগল শাসকদের সহায়তায় আবারও দখল ফিরে পান আরাকানের রাজারা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজারা সেসময় মোগলদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেই আনুগত্যের প্রমাণ মেলে ১৫ শতকের আরাকানে প্রচলিত মুদ্রায়। তৎকালীন অনেক মুদ্রায় মুসলমানদের কালেমা ও পারস্য অক্ষর খোদাই দেখতে পাওয়া যায়। ফলে ধারণা করা যায়, রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও মুসলমানদের সঙ্গে তাদের গড়ে উঠেছিল নিবিড় সম্পর্ক।

টেকনাফ হয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা

জীবন হাতে করে পালিয়ে টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকছেন রোহিঙ্গারা। সংগৃহীত ছবি

মোগল সম্রাট হুমায়ূন বাংলায় সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করলে অস্থিরতার সুযোগ নেন আরাকান রাজা মিন-বিন। পূর্ব বাংলার বিশাল এলাকা দখল করে নেন তিনি। স্থানীয় রাজাদের মাধ্যমে পরবর্তী ১২০ বছর বাংলা এলাকায় শাসন করেছেন তিনি এবং তার উত্তরসুরিরা। ফলে এদেশের মানুষের সঙ্গে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন শুরুর পর ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে নিলে মায়ানমারের সঙ্গে ভারতীয়দের যোগাযোগ নিবিড় হয়। ভাগান্বেষণে অনেক বাঙালিও সেখানে বসতি গড়ে তোলে। ১৯৪৭-এ মিয়ানমার স্বাধীন হয়ে গেলে কয়েকশত বছর ধরে ওই অঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে দেশটির সামরিক সরকার।

১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর নাগরিকত্ব আইন পাশ করে পূর্ণাঙ্গ, সহযোগী এবং অভিবাসী এই তিন ধরনের নাগরিকদের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তাতে ঠাঁই পাননি রোহিঙ্গারা। ১৮২৩ সালে মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাতের সময় থাকা ১৩৫টি গোত্রভুক্তরা মিয়ানমারের নাগরিক স্বীকৃত হলেও সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের গোত্র হিসেবে অস্বীকার করে বসে সামরিক সরকার। কয়েক শতাব্দীর দীর্ঘ রাজনৈতিক আর সামাজিক যোগাযোগকে অস্বীকার করে তাদের পরিচয় নির্ধারিত হয় পূর্ব বাংলা থেকে আসা ‘অবৈধ জনগোষ্ঠী’। সামরিক জান্তা দাবি করে বসে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই জনগোষ্ঠী দেশটিতে আশ্রয় নিয়েছে। নিজভূমে পরবাসী হয়ে রোহিঙ্গারা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রবিহীন সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। ছবি: রয়টার্স

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা তৎকালীন বার্মা (পরে মিয়ানমার) দখল করে নেওয়ার পর প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেই শুরু। এরপর ১৯৭০ দশকে বিদেশি তাড়ানোর অজুহাতে সরকারি পীড়ন শুরু হলে আবার পালাতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। মাঝখানে বিরতি দিয়ে আবার নাফ নদী আর বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকতে থাকে ১৯৯১-৯২ সালে। জাতিসংঘের হিসাবে, ওই সময় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর ২০১২ সালে কয়েকজন রোহিঙ্গার হাতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এক নারী ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হলে রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। নিপীড়নের মুখে আবারও পালাতে থাকে রোহিঙ্গারা। আর চলতি বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাখাইনের সেনা চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১১ নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হলে নতুন করে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে সেনাবাহিনী। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে গণহত্যার শামিল বলে উল্লেখ করার পরও থেমে নেই নিপীড়ন। হামলার মুখে প্রতিদিনই বাংলাদেশ সীমান্তে বাড়ছে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা।

বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে মিয়ানমারের কোনো তথ্য না থাকলেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে তাদের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। নিপীড়নের শিকার হয়ে কয়েক দশক ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। ভাষা আর চেহারায় মিল থাকার সুযোগে এসব রোহিঙ্গারা মিশে যাচ্ছে বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। ফলে চাপ বাড়ছে বাংলাদেশে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার পর নতুন করে তিন লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।

জীবন হাতে পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা

বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের স্রোত। ছবি: ফোকাস বাংলা

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত সংস্থাটির রাখাইন বিষয়ক পরামর্শক কমিশন গত মাসে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ওই প্রতিবেদন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের মীমাংসা করতে সতর্ক করে দিয়েছে। ৬৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মীমাংসা না হলে মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি দেশটির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

রোহিঙ্গা সংকটের নেপথ্যে অন্য গন্ধ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের খনিজ সম্পদের উপর পাশ্ববর্তী দেশগুলোর রয়েছে শকুন দৃষ্টি। সামরিক শাসনের যুগে ১৯৮৯ সালে দেশটির উপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। ২০১৬ সালে দেশটির প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অং সান সুচির দল বিজয়ী হলেও সেনাবাহীনির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়। কার্যত ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ হয় সেনাবাহিনীর। আর কথিত গণতান্ত্রিক উত্তরণের দোহাইতে ৮ অক্টোবর দীর্ঘদিনের মার্কিন অবরোধ তুলে নেওয়ার পরদিন নতুন করে রাখাইনে ‘জঙ্গিবিরোধী’ অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

নাফ নদী দিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা

কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ এলাকা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। ছবি: ফোকাস বাংলা

২০০৪ সাল থেকে রাখাইনে খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর বিনিয়োগ সেখানে বিনিয়োগ বাড়ায় চীন। ওই বিনিয়োগ খর্ব করাসহ তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে রাশিয়ান বিশ্লেষকরা। দেশটির সংবাদমাধ্যম স্পুটনিক জানিয়েছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আরটিএনকে জানিয়েছেন রাখাইনে সাম্পতিক সহিংসতা একটি চীনবিরোধী খেলা। কারণ সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম উগ্রপন্থা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এমনটা করা হচ্ছে। আর তৃতীয়ত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ান দেশগুলোর জোট আসিয়ানের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিতে তৎপর রয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রীড়ানকেরা।

তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, আলজাজিরা, বিবিসি