বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ছবি: স্টার মেইল
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে: জাতিসংঘ
আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:২২
(প্রিয়.কম) মিয়ানমারের রাখাইনে ২৪ আগস্ট রাত থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো নজিরবিহীন অমানবিক অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে প্রায় ৪ লক্ষ রোহিঙ্গা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাগুলো।
১৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) সহকারী হাই কমিশনার জর্জ ওকোথ-ওব্বো ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার অপারেশসন্স অ্যান্ড ইমার্জেন্সি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মেদ আবদিকার মোহামুদ কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দুরাবস্থা দেখতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান। সেখানে শরণার্থীদের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আন্তর্জাতিক সহায়তার অনুরোধ জানান আবদিকার মোহামুদ। তিনি বলেন, “আমাদের উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ‘এখনও যথেষ্ট’ কিছু করছে না।”
বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, ‘আরও অনেক কিছু করতে হবে।’
এদিকে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী হওয়া এই বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় তাদের।
পলিথিন, বাঁশের সাহায্যে বানানো ঘরে এভাবেই পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জীবযাপন করছেন। ছবি: স্টার মেইল
এ বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) সহকারী হাই কমিশনার জর্জ ওকোথ-ওব্বো সাংবাদিকদের বলেন, ‘আড়াই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় চার লাখ মানুষ আসায় বাংলাদেশে গুরুতর মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা অনেক বড় সংখ্যা এবং বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’
একইসঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ইউএনএইচসিআর ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানানো হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধিরা কক্সবাজার ঘুরে এসেছেন; আমরাও গিয়েছিলাম। বৈঠকে সে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়েছে। একইসঙ্গে সমস্যাটির সমাধানে যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়।’
বৃদ্ধাকে কোলে নিয়ে পার হচ্ছেন একজন রোহিঙ্গা পুরুষ। ছবি: স্টার মেইল
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে বেশ কিছু পুলিশ পোস্টে হামলার প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী নজিরবিহীন নৃশংস অভিযান পরিচালনা করে। খুন, কুপিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, ধর্ষণসহ নানাভাবে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন অব্যাহত রাখে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনী। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৪ লক্ষ রোাহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। নিহত হয়েছে প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। জনশূন্য হয়ে গেছে প্রায় ১৭৬ টি গ্রাম।
এদিকে যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অনুরোধে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি দেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আহ্বান জানায়। এর আগে এ সংকট নিরসনে ড. মোহাম্মদ ইউনূসসহ ১২ জন নোবেল বিজয়ী ও বিশ্বের ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি খোলা চিঠি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠিয়েছে।
মিয়নমার সরকার বলছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিন্তু এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (এআরএসএ)। সংগঠনটির পক্ষ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘২০১৬ সালের রাখাইনে গঠিত রোহিঙ্গদের দল দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (এআরএসএ) আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এন্ড লেভান্তে (আইসআইএস), লস্কর-ই-তায়েবা অথবা বৈশ্বিক জঙ্গিগোষ্ঠির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়।’
২৪ আগস্ট সংঘাত শুরুর পরে হংকংভিত্তিক এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি’র মুখপাত্র হিসেবে দাবি করা আবদুল্লাহ নামের একজন বলেন, ‘২৪ অাগস্ট রাতে দ্য আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (এআরএসএ) স্বপ্রণোদিত হয়ে নয় বরং আত্মরক্ষার স্বার্থে এ হামলা চালায়। ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষিতে এর প্রতিষ্ঠা হলেও এটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়। এটা প্রকৃত অর্থে জাতিগত অধিকারভিত্তিক সংগঠন।’
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা একটি নৃগোষ্ঠীর নাম। যার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইসলাম (এর সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ) ও ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গাদের আদি আবাসস্থল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শত শত বছর ধরে রাজ্যটিতে বাস করা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে মিয়ানমার সরকার এ জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালাচ্ছে।
পেছনে জ্বলছে ফেলে আসা ঘরবাড়ি, সামনে বাংলাদেশ। ছবি: ফোকাস বাংলা
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার সময়ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল। ১৯৬২-তে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে রোহিঙ্গারা। ১৯৭৪ সালে সামরিক জান্তা ‘বিদেশি’ আখ্যা দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে প্রণোয়ন করা হয় নাগরিকত্ব আইন। আর এই কালো আইনের মাধ্যমে অস্বীকার করা হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব। নাগরিকত্ব হরণ করে তাদের অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সাদা কার্ড নামে পরিচিত ওই পরিচয়পত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয় সীমিত কিছু নাগরিক অধিকার।
জাতিসংঘের সহায়তায় ২০১৪ সালে পরিচালিত আদমশুমারিতে রোহিঙ্গা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাধার মুখে পড়তে হয় রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। তাদের শুমারি বয়কটের ঘোষণার মুখে সামরিক জান্তা সিদ্ধান্ত দেয় রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত হতে গেলে অবাঙালি হতে হবে। ২০১৫ সালে সাংবিধানিক পুনর্গঠনের সময়ে আদমশুমারিতে দেওয়া সাময়িক পরিচয়পত্র বাতিল করে সামরিক জান্তা। পদ্ধতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করা হয় মৌলিক অধিকার থেকে। চলাফেরা, বাসস্থান নির্মাণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, এমনকি চাকরির অধিকার থেকে আইনসিদ্ধভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের।
প্রিয় সংবাদ/শান্ত