কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বারী সিদ্দিকী। ছবি সংগৃহীত।

যার গান শুনে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন আসামি

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪৯
আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪৯

(প্রিয়.কম) এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে/সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে- এ গানের কথাগুলোর মতোই প্রতিটা প্রাণের জীবন; একদিন চলে যেতে হবে, এটাই কঠিন নিয়তি। জন্ম নিলে তার শেষ পরিণতি অবধারিত। মৃত্যুই হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। তবুও মায়া থেকে যায়; মানুষের প্রতি মানুষের মায়া, পৃথিবীর প্রতি মায়া, সম্পর্কের মায়া, আরো না জানি কতকিছুর মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়া সহজ হয়ে ওঠে না তাই।

একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে, এ সত্যটা জানার পরেও বুকের কোথায় যেন হাহাকার জমে থাকে, প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া তাই মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ যেদিন মৃত্যু শব্দটার সঙ্গে প্রত্যেকের পরিচয় ঘটে, আমরা জেনে যাই- এটাই চিরন্তন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এর ব্যতিক্রম নেই, হবেও না কোনোদিন। কিন্তু ঐ যে মায়া, পৃথিবীতে মানুষ আসেই মায়ার বন্ধনে জড়াতে, তারপর একদিন হুট করেই চলে যেতে হয়, রেখে যেতে হয় সকল কর্ম, সৃষ্টি, সব সম্পর্ক, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি। উপরে প্রদত্ত গানের লাইন দুটি প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার বিজয় সরকারের লেখা। আর এ গানটিতে কণ্ঠের জাদু দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছেন গ্রামীণ লোকসংগীত ও আধ্যাত্মিক ঘরানার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বংশী বাদক বারী সিদ্দিকী। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যিনি আজ প্রতিটা প্রহর কাটাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতাল স্কয়ারের শুভ্র বিছানায়। গত তিন দিন যাবৎ এ হাসপাতালেই লাইফ সাপোর্টে আছেন গুণী এই শিল্পী, এখনো তার অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।

গতকাল সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হঠাৎই তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে শঙ্কিত হয়ে পড়েন তার অগণিত ভক্ত-অনুরাগী-শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রিয়জনরা। মনেপ্রাণে সবাই শুধু একটাই প্রার্থনা করছেন; ফিরে আসুন বারী সিদ্দিকী, আবারও দরাজ কণ্ঠে দরদ দিয়ে গেয়ে উঠুন সেই চিরচেনা গানগুলো। প্রিয়.কম এর আজকের আয়োজন বারী সিদ্দিকীর দশটি জনপ্রিয় গান নিয়ে। পাঠক এ গানগুলোর মাধ্যমে বারী সিদ্দিকীকে স্মরণ করুক, প্রাণ ভরে প্রার্থনা করুক তার ফিরে আসার। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, বারী সিদ্দিকী সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য-

প্রখ্যাত এ সংগীতশিল্পীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোণায়। জন্মেছিলেন এক সংগীত প্রাণ পরিবারে, ফলে শৈশব থেকেই গানের শিক্ষা পেয়েছেন পরিবারের সদস্যদের হাতে ধরেই। তবে সংগীতে আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি হয় ১২ বছর বয়সে। নেত্রকোণার খ্যাতিমান শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে তার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার শুরু। এরপর তিনি একে একে সান্নিধ্য পান ওস্তাদ দবির খান, আমিনুর রহমান, পান্নালাল ঘোষসহ আরো অনেকেরই।

ক্লাসিক্যাল সংগীতে তার আগ্রহ খুব ছোট থেকেই, ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে তাই ক্লাসিক্যাল মিউজিকে পড়াশোনা শুরু করেন বারী সিদ্দিকী। একটা সময় ঝোঁক বাড়ে বাঁশির প্রতি, ফলে বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিমও নিয়ে নেন তিনি। শুধু দেশে নয়, সংগীতে উচ্চতর তালিম গ্রহণের জন্য নব্বই দশকে তিনি ভারতবর্ষে পাড়ি জমান। ভারতের পুনে শহরে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে মনোযোগী হয়ে ওঠেন লোকসংগীতে, পাশাপাশি চলতে থাকে ক্লাসিক ঘরানার গানও।

চলুন শুনে নেওয়া যাক বারী সিদ্দিকীর জনপ্রিয় কিছু গান-

কোনোদিন স্বপ্ন দেখেননি এত বড় শিল্পী হবেন, ভাবনাতেও ছিল না কখনো, তবু কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে তিনি আজকের বারী সিদ্দিকী। এত ভালোবাসা পেয়েও তার আফসোস থেকে গেছে, বেড়েছে স্পৃহা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার তিনি বলেছেন- আমার হয়তো আরো শিখে গান গাওয়া উচিত ছিল, ভারতবর্ষে গিয়েছিলাম সংগীতের দীক্ষা নিতে, আরো কিছুদিন সেখানে থেকে আসা প্রয়োজন ছিল বোধহয়। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের বিখ্যাত এ গানটি বারী সিদ্দিকীর মাধ্যমেই অধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে- শুয়া চান পাখি আমার, শুয়া চান পাখি/আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি/ তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি/আজি কেন হইলে নীরব মেল দুটি আঁখি রে পাখি/আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’।

বিধির বিধান খণ্ডাতে পারে না কেউই, মানুষ হয়ে জন্মালে এ সত্যটুকু মেনেই জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এটাই চরম বাস্তবতা; আর বাস্তবতায় কান্নাকাটি কিংবা আবেগের কোনো স্থান নেই, সবকিছুই অনর্থক- এমনই একটি অসাধারণ গান বারী সিদ্দিকীর সুরেলা কন্ঠে- বিধি তোমার এমনই রায়, আপিল করার জায়গা নাই/কান্নাকাটি সবই মাটি, নিঠুর আদালত পাড়ায়’।

প্রতিটা মানুষের মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু কেউ কেউ হয়তো দেহ ত্যাগ না করেও মৃত্যুকে যাপন করে জীবিত অবস্থায়, হয়তো প্রিয় মানুষকে হারিয়ে, কিংবা কাছের মানুষের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ পেয়ে। সে জন্যই হয়তো বারী সিদ্দিকী গেয়েছেন- আমি একটা জিন্দা লাশ, কাটিস না রে জংলার বাঁশ/আমার লাইগা সাড়ে তিন হাত কবর খুঁড়িস না, আমি পীরিতের অনলে পোড়া/মরার পরে আমায় পুড়িস না তোরা’।

ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হবে, সে কষ্ট যেমন যন্ত্রণার, কিছুটা মধুরও। এ জন্যই হয়তো মানুষের হৃদয় বারবার ভালোবাসতে চায়। এ ভালোবাসার যন্ত্রণা বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে অনেক বেশি মধুর হয়ে উঠেছে সব সময়। ভালোবেসে যন্ত্রণা পাওয়া মানুষগুলো যেন তার গানেই ফিরে ফিরে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। বারী সিদ্দিকীও তাই উকিল মুন্সির এ বিরহের গান গেয়েছেন পরম দরদে- লিলুয়া বাতাসে প্রাণ, না জুড়ায় না জুড়ায় রে/একা ঘরে ঘুম আসে না, শুইলে বিছানায়...রে প্রাণ না জুড়ায়, না জুড়ায় রে’।

বেদনার মধ্যে দিয়েই জীবনকে প্রবাহিত করতে হয়। বারী সিদ্দিকীর গানের ভেতর প্রেম-বেদনা দুই-ই সমানভাবে বিদ্যমান। তার গানের এমনই আবেদন যে ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে একজন কয়েদির জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল, বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে একবার আমার গায়ে যত দুঃখ সয় গানটি শুনবেন। রাত দশটার কাছাকাছি সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফোন আসে বারী সিদ্দিকীর কাছে। মৃত্যুপথযাত্রী ঐ ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা তিনি রেখেছিলেন, গেয়েছিলেন সে ব্যক্তির পছন্দের ও উকিল মুন্সির লেখা জনপ্রিয় গান- আমার গায়ে যত দুঃখ সয়/বন্ধুয়ারে কর তোমার মনে যাহা লয়’।

সাধারণত বিরহের গানগুলো হয় অপরপক্ষকে দোষারোপ করে, সেখান থেকে সরে এসে গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী লিখলেন একটি ভিন্নধর্মী গান, যেখানে পৃথিবীর সকল মন্দ কিছুর দায় নিজের উপর নেওয়া হলো, অপরপক্ষকে ভালোবাসার কৃতজ্ঞতা জানানো হলো। আর এ গানটিতে বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠ হয়তো অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে থাকবে- আমার মন্দ স্বভাব জেনেও তুমি, কেনো চাইলে আমারে/এত ভালো হয় কি মানুষ, নিজের ক্ষতি করে। 

অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন বারী সিদ্দিকী, তবে একবার এক নারী তাকে ফোন করে ভীষণ রকম বকাঝকা করেছিলেন। বলেছিলেন, বারী সিদ্দিকীর গান তাকে অস্থির করে দিয়েছে। তিনি না পারছেন ঘরে থাকতে, না পারছেন বের হয়ে যেতে। ঐ বকা যে মায়া জড়ানো, তা নিশ্চয় আমরা উপলব্ধি করতে পারি। মানুষ যখন কষ্টে থাকেন, তখন তাকে বিরহের কিংবা কষ্টের গানগুলোই স্পর্শ করে, কাছে টান, এ নারীর ক্ষেত্রেও হয়তো সেরকম কিছুই হয়েছিল কিনা কে জানে। মানুষের মন বড় বিচিত্র, কখনো সাগরের মতো উত্তাল থাকে, কখনো নদীর মতোই শান্ত। এমনই এক গান বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে- মানুষের ভিতরে মানুষ, করিতেছে বিরাজন/ মানুষ ধর মানুষ ভজ, শোন বলি রে পাগল মন’।

বারী সিদ্দিকী তার অসংখ্য গানের জন্য কালজয়ী থাকবেন ভক্ত-অনুরাগীদের হৃদয়ে। কিছু গান ভালোবাসার মানুষদের জীবনকে পরিপূর্ণ করে দিতেই হয়তো সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি একটি গান- রজনী হইসনা অবসান, আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন/কত নিশি পোহাইলো মনের আশা মনে রইলোরে, কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান/ আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন’।

সাধক উকিল মুন্সির জনপ্রিয় সব গান বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে অমর হয়ে থাকবে। তেমনই একটি কালজয়ী গান-  ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে পুবালী বাতাসে/বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসে রে’। 

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন বারী সিদ্দিকী। মূলত হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহেই তিনি প্রকাশ্যে এসে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। নন্দিত এ কথা সাহিত্যিকের লেখা কিছু গানও গেয়েছেন বারী সিদ্দিকী। এ রকমই একটি গান - কেহ গরিব অর্থের জন্য, কেহ গরিব রূপে/এই দুনিয়ার সবাই গরিব, কান্দে চুপে চুপে

 প্রিয় বিনোদন/গোরা