কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

তৌকির আহমেদ। ছবি: প্রিয়.কম।

শিল্পের দায় কিন্তু দুজনেরই-নির্মাতা এবং দর্শকের: তৌকির আহমেদ

মিঠু হালদার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪১
আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪১

(প্রিয়.কম) এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীকে ঘিরে জনপ্রিয় নির্মাতা তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র ‘হালদা’। এটি নির্মাতার পঞ্চম ছবি। বিজয় দিবসের প্রথম ছবি হিসেবে এ ছবি মুক্তি পাবে পহেলা ডিসেম্বর। ছবির গল্প লিখেছেন আজাদ বুলবুল, চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিজেই। ছবিটির প্রধান চারটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন-জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং ফজলুর রহমান বাবু। চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনা করেছেন পিন্টু ঘোষ। ছবিটি বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশনা করতে যাচ্ছে দি অভি কথাচিত্র। দেশের শতাধিক এবং বিশ্বের প্রায় ১৬টি দেশে ছবিটি মুক্তি পাবে সিনেমায়টি। এজন্য গত ২৯ নভেম্বর বিকালে প্রিয়.কমে এসেছিলেন অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকির আহমেদ। কথা বলেছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে-

(প্রিয়.কম) ‘জয়যাত্রা’, ‘রূপকথার গল্প’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘হালদা’-আপনি এখন পর্যন্ত এ সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছেন। এর বিষয়বস্তুগুলোও গতানুগতিক ধারার বাইরে। অন্যদিকে দর্শকদের কথা যদি বলি সেখানেও নির্দিষ্ট সংখ্যক বলে, অনেকেই বলে থাকেন। ভিন্নমতও রয়েছে। তবে এ ধরনের সিনেমা নির্মাণে আপনার ফিলোসফিক্যাল জায়গাটা ঠিক কেমন?

তৌকির আহমেদ: প্রতিটি কাজের বড় একটি বিষয় হচ্ছে, সেটির অবজেকটিভ কী? মানে লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্যটা কী? আমরা যদি লক্ষ্য করি, একদল নির্মাতা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন বাণিজ্যের লক্ষ্যে। আরেকদল এর বাইরে গিয়ে। ঠিক এ ধারাটার আমি কাজ করতে চাই না। তবে আমি চাই, আমার ছবিটা যেন মৌলিক ছবি হয়। একই সঙ্গে চলচ্চিত্র একটি মাধ্যম হিসেবে সৃজনশীল কিছু যেন করে।

আর যেটিকে আমরা বাণিজ্যিক কিংবা মূল ধারা বলছি সেটাকে আমি মূল ধারা মনে করি না। আমি মনে করি মূল ধারা হচ্ছে যেখানে, চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের শক্তি যেখানে প্রকাশ পায় সেটিই হচ্ছে মূল ধারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি হয়তো আমাদের দেশে ততটা সফলতা পায়নি। এছাড়া এ দুটোর মধ্যে মাঝামাঝি জায়গায় বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা হয়েছে। আমার পূর্বসূরী অনেক মেধাবি মানুষজন সেটা করেছেন।

আর এবার আমি চেষ্টা করছি আমার ‘হালদা’টা কী করে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের দেখানো যায়। কারণ দর্শক আমার ছবি পছন্দ করে, এটা আমি জোর গলায় বলতেই পারি। সেটি ‘জয়যাত্রা’, ‘রূপ কথার গল্প’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, আর ‘অজ্ঞাতনামা’র যেটির কথাই বলেন। কিন্তু সব দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবিগুলো দেখতে পান নাই। কিংবা প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা এটা নিতে চাননি। আবার যখন নিয়েছেন দর্শক ছবিগুলো দেখেতে যাননি। যার কারণে নেওয়ার দু-তিন দিন পর আবার হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এখানে আমার কিছু করার নেই। শিল্পের দায় কিন্তু দুজনেরই-নির্মাতা এবং দর্শকের। নির্মাতা যদি একটি ধারায় কাজ করতে চান, দর্শকদেরও সেখানে একটি ধারায় অংশগ্রহণ থাকা উচিত। তাদেরও দায়িত্ব থাকে। সেই জায়গাটা থেকেই বলব, আমাদের কাজেই মাধ্যমেই যদি দর্শকদের এগিয়ে নিয়ে আসতে পারি, আমরাও যদি আমাদের কাজকে আরও সুন্দর, মৌলিক কিংবা সৃজনশীল উপায়ে উপস্থাপন করতে পারি, তাহলে একটি পয়েন্টে এসে দুটি মেরু মিলবে। যদিও আমি জানি সেটা পৃথিবীতে এখনও হয়নি।

(প্রিয়.কম) আপনার সিনেমাগুলো বেশিরভাগই আলোচনায় থাকেনি, আর বাণিজ্যিক দিকটার প্রসঙ্গ তুলে সিনেমাবোদ্ধারা অভিযোগ করে থাকেন। এমনটা কেন, বিশেষ করে অনেকেই আপনার মার্কেটিং পলিসিকে অভিযোগের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে চান এ জন্য?

তৌকির আহমেদ: একটা সময় ছিল, যেটা হচ্ছে ইনডিপেন্ডেট ছবিগুলো মানে এফডিসির বাইরের ছবিগুলোকে পরিবেশকরা ততটা সমাদর করতেন না। এর দুটা কারণ হতে পারে-প্রথমত, এগুলোর মধ্যে যথেষ্ট বাণিজ্যিক ছবির মতো উপাদান নেই। অথবা তারা চাইতেন না, এ ধরনের ছবি জনপ্রিয়তা লাভ করুক। সেখানে অনেকেরই স্বার্থ থাকতেই পারে। আর আমরা দেখি যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা স্বার্থ কাজ করেই। কিন্তু আমরা মনে করি চলচ্চিত্রকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, এরজন্য অগ্রগতি দরকার। এবং সেখান থেকে নতুন নির্মাতারা নতুন ভাবনা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে হাজির হবেন, সেটাই আশা করি। আমরা নতুন কিছু শিখব।

(প্রিয়.কম) বিষয়টা কী এমন, যে সাধারণ মানুষ আপনার সিনেমার ভাষা কিংবা আর্টওয়ার্কের কথা যদি বলি, সেটা তারা বুঝতে পারছে না?

তৌকির আহমেদ: আমাদের দর্শকদের মধ্যেও কিন্তু অনেকগুলো ভাগ রয়েছে। কেননা, সমাজের যারা প্রান্তিক মানুষ তাদের শিল্পরুচি কিংবা দর্শন এক রকম। আবার যারা শিক্ষিত শ্রেণি তাদের এক ধরনের ভাবনা আছে। আবার যারা তরুণ বা উচ্চবিত্ত তাদের ভাবনাটা আবার আলাদা। আবার একই ছবি সবার ভালো লাগবে এমনও কিন্তু কোনো কথা নেই। কিন্তু এটাও সত্যি কথা যা ভালো তা ভালোই। কিন্তু সমস্যাটা হয় যেখানে তারা বিশ্বাসের জায়গাটা রাখেন না। আবার অনেকেই আছেন যারা ফেসবুকে লিখেন, কিন্তু সিনেমা হলে যান না। সেটা আবার নানান কারণ রয়েছে। 

(প্রিয়.কম) তবে এই ইস্যুতে আরেকটা বিষয়ে কথা বলতে চাই, অনেকেই আপনার সিনেমা হয়তো বোঝেন না। তাই আপনার সিনেমা নিয়ে তারা আলোচনা-সমালোচনা করেন না। শিক্ষিত তরুণ সমাজ কেন আলোচনা-সমালোচনা করেন না। যেমন-বেশ কিছুদিন আগে মুক্তি প্রাপ্ত ‘ডুব’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’ এর কথাই বলি, ছবিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুই করেছেন...

তৌকির আহমেদ: আমি তো আশাবাদী, সেটাই ঘটছে কিন্তু। আজ তারা ছবি নিয়ে কথা বলছে। তারা কিন্তু পরিচালকে প্রশ্নও করছে। যদিও আমি মনে করি সে প্রশ্নের ধরণ কিংবা প্রকাশের ভঙ্গি বেশ আক্রমণাত্বক কিংবা অশালীন হয়। সেটা যদি তারা শুধরে নেন, এটা খুব পজেটিভ। এর সঙ্গে সঙ্গে তারা যদি হলে যাওয়ার চর্চাটা নিয়মিত করেন, আগামি পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে বাংলা সিনেমার চেহারাটা পাল্টে যাবে।

আমি তো মনে করি দর্শকই হালদাকে প্রচার করছে এখন। আমি যখন হালদার প্রচারের কথা ভাবছিলাম, তখন দেখলাম যারা অজ্ঞাতনামার দর্শক তারা নিজস্ব উদ্যোগে ফেসবুকে বিভিন্নভাবে প্রচার করছেন। সিনেমা তো শিল্প, এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে, বিতর্কও হতেই পারে। শিল্পকে শিল্পী হিসেবেই দেখা উচিত। ওভার এক্সপেকটেশন এর কিছুই নাই। সেটার সমালোচনা যদি যৌক্তিক হয় আমিও সেখান থেকে গ্রহণ করার চেষ্টা করব। 

(প্রিয়.কম) একজন নির্মাতা তার চিন্তা, চেতনা, দর্শন কিংবা ভাবনাবোধের জায়গাটা তার সৃষ্টিশীল কাজের কিংবা সিনেমার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। প্রশ্নটা হলো, আপনি কোনটা প্রাধান্য দেন, সিনেমা কার জন্য দর্শকদের জন্য নাকি পুরস্কারের জন্য?

তৌকির আহমেদ: এই প্রশ্নটার ধারণাটাই আমার কাছে মনে হয় ঠিক নয়। ফেস্টিভ্যালে যে যায়, সেখানে কিন্তু দর্শকই দেখেন। সেখানে ভিনদেশের ভিন্ন কালচারের দর্শক দেখেন এবং আসলে বাণিজ্যিক ধারার পাশাপাশি এই ধরনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মগুলোর সার্কিট হচ্ছে ফেস্টিভ্যালে। অন্যায়ের কিছু নেই, দোষেরও কিছু নেই, খোঁচা দিয়ে বলারও কিছু নেই। পৃথিবীতে তো নানান রকমের ছবি হয়। আমি তো আগেই বলেছি ছবি একেকজন একেক উদ্দেশ্যে বানায়। আমার ছবি ৯টি হলে মুক্তি দেবেন, আবার ফেস্টিভ্যালে গেলে বলবেন, তার ছবি ওখানে গেছে, এটা বলা ঠিক নয়।

ফেস্টিভ্যালে তো ভালো ভালো ছবি দেখানো হয়। সেগুলোই তো মৌলিক ছবি এবং বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল ছবি। সেখানে তো অসুবিধা নেই। একজন নির্মাতা যখন একটি ফ্যাস্টিভ্যালে যায়, দশজনের সঙ্গে কথা বলেন, বিভিন্ন দেশের ছবি দেখেন সেখানে তার নিজেরও শিক্ষারও বিষয় আছে। ফ্যাস্টিভ্যালের ছবি যদি সাধারণ দর্শক দেখতে শিখেন তাহলে তারা পছন্দ করবেন। কিন্তু আমরা যদি আগেই ধরে নিই, ছবি মানে গান, নাচ, কমেডি এবং একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মতো হবে, তাহলে তো সেখানে ভালো ছবি বাণিজ্য করতে পারবে না।  

(প্রিয়.কম) সিনেমা তো আপনার জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যমও। আপনার সাথের যারা তারা তো অনেকেই বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণের দিকে ঝুঁকেছেন। ওখানে তো অর্থের ঝনঝনানিও বেশি। আবার বিপরীতমুখীও রয়েছে। আপনি সেদিকে না গিয়ে বলা চলে ঠিক তার বিপরীত পথে হেঁটেছেন। অর্থের লোভটা কীভাবে সংবরণ করলেন?

তৌকির আহমেদ: আমার কাছে মনে হলো যে চলচ্চিত্র একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, যে মাধ্যমটি সমাজে আসলে ভূমিকা রাখতে পারে, একটি দেশের ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারে। অর্থ তো নানানভাবেই উপার্জন করা যায়। আমি এক সময় রিয়েলস্টেট ব্যবসা করতাম সেখানে এক সময় অনেক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব ছিল। আমি আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করতাম, কনসাল্টটেন্সি করতাম পরবর্তীতে ব্যবসা করেছি, সেখানে অর্থের অনেক হাতছানি ছিল।

সেটা আসলে আমাকে খুব টানেনি। আমি জানি আমার প্রয়োজন সীমিত। সুতারাং আমার মন এবং মানসিকতা যেখানে টানে সে কাজটিই করতে চাই। সে জায়গাটি অবশ্যই শিল্প। সেজন্যই আমি শিল্পের পথে হাঁটার চেষ্টা করেছি। শিল্পী হবার চেষ্টা করছি। তাই ওটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই এবং আমার মনে হয় ঠিক সময়েই আমি সঠিক সিদ্বান্তটি নিয়েছিলাম। আর আমি যে সিদ্বান্ত নিতে পেরেছিলাম এজন্য আমাকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। 

(প্রিয়.কম) আপনি বুয়েট, মানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল-সম্পর্কিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। ট্র্যাকটা চেঞ্জ করা সেই সময়ে আপনার জন্য কতটা কঠিন ছিল, আর স্থাপত্য বিষয়টি ফিল্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে কী ধরনের সহায়তা করছে এখন, কারণ দুটোই তো সৃজনশীল কাজ?

তৌকির আহমেদ: আর্কিটেকচার তো ভীষণভাবে একটি শৈল্পিক বিষয়। ট্রাক চেঞ্জ করার কিছু ঘটে নাই। বরং ওই শিক্ষাটাই আমার ফিল্মে বিভিন্নভাবে কাজে লাগে। কারণ স্থাপত্য এমন একটি বিষয় যেখানে আমাদের অনেক বিষয়ই শেখানো হয়। পৃথিবীতে বহু ফিল্মমেকার আছেন যাদের ব্রাকগ্রাউন্ড হচ্ছে আর্কিটেকচার। যেমন-সের্গেই আইজেনস্টাইন-সোভিয়েত চলচ্চিত্র পরিচালক এবং চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক, সার্বিয়ান কোস্তারিকা বাংলাদেশেও রয়েছেন, এনামুল করিম নির্ঝর ও মসিহউদ্দিন শাকের রয়েছেন।

(প্রিয়.কম) আচ্ছা, আপনার টিভির যে কাজগুলো আমরা দেখেছি, সেখানে তো সাধারণ মানুষকে বিনোদন দেওয়া, না হয় বাজারি আবেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার বিষয়গুলো দেখেছি। কিন্তু আপনাকে সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে দেখলাম, ঠিক তার বিপরীত রাস্তায় হাঁটছেন, আপনার চিন্তার এই যে জায়গাটা সেটি কোথা থেকে এলো?

তৌকির আহমেদ: টেলিভিশন এমন একটি মাধ্যম যেটিকে সবাই আসলে খুব সিরিয়াসলি দেখে না এবং দেখলেও ভুলে যায়। আমি টেলিভিশনে প্রচুর ভালো কাজ করেছি। যেটা-নক্ষত্র চলচ্চিত্র নামে ইউটিউবে একটি চ্যানেল রয়েছে সেখানে গেলে আমার অনেক কাজই দেখতে পাওয়া যাবে। সে কাজগুলো নতুন উপাদান ও ভাবনার বিষয়ও ছিল। কিন্তু যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলাম, এটা তো বেশ সিরিয়াস বিষয়, দর্শকও বেশ সিরিয়াস নেয়। কারণ তারা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমাটি দেখেন মনোযোগ সহকারে। এর জন্য আলাদা একটি প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন। যে কারণে সেটি অনেকেরই চোখে পড়েছে। 

(প্রিয়.কম) তবে কি আমরা বলতে পারি, আপনি আপনার ক্যারিয়ারের ঐ সময়টা (টিভি ক্যারিয়ার) ভাবনাগত জায়গার প্র্যাকটিস করার জন্যই ঐ কাজগুলো করেছেন?

তৌকির আহমেদ: অবশ্যই, আমার কাছে তখন সেটি নেট প্র্যাকটিসের মতোই বিষয় ছিল। তুমি যদি লক্ষ্য করো আমার ‘নাইওরী’, ‘উত্তর পুরুষ’, 'গ্রহণকাল', ‘সোনালি রোদের রং’, ‘বিহঙ্গকথা’ এগুলো পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্রের ভাষায় বানানো। অনেক বড় আয়োজন নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। সেটি অনেক টেলিভিশন দর্শক হয়তো বুঝতেই পারেননি। আবার অনেকেই হয়তো নোটিস করেছেন। সেগুলো চলচ্চিত্রই বানিয়েছিলাম টেলিভিশন ক্যামেরা দিয়ে। আমাদের দেশে কিন্তু এই চর্চাটা আছে। কারণ অনেকে টিভি নির্মাতার স্বপ্ন থাকে ভবিষ্যতে ফিল্ম বানানো। তাই আমার অনুশীলনের অংশ হিসেবে আমি টেলিভিশনটাকে কাজে লাগিয়েছি।

(প্রিয়.কম) অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশে ফিল্ম নিয়ে তাত্ত্বিকভাবে পড়াশোনা করার জায়গাটা ছোট, এর কারণটা আসলে কী, কিন্তু আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসও তো দীর্ঘদিনের। নাকি আমরা আমাদের এই সমস্যাটা এখনও পয়েন্ট আউট’ই করতে পারি নাই?

তৌকির আহমেদ: এটা তো নির্ভর করে একটি দেশের রাষ্ট্রীয় পলিসি কী, পরিকল্পনা কী সেটার উপরে। আমাদের এখানে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছে পাশাপাশি তখনই যদি প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার ব্যবস্থাটাও করা যেত, তাহলে হয়তো আমরা এগিয়ে যেতাম। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ফিল্ম অব ড্রামা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর আমাদের এখানে একটি ইন্ডাস্ট্রি হলো কিন্তু সেখানে ষাটের দশকেই একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতাম, তাহলে অনেক সুবিধাই হতো। না হওয়াতে যেটা হয়েছে, ইন্ডাস্ট্রিকে ফিট করার জন্য একটি ভ্যাকিউম হয়ে গিয়েছে। অনেক অযোগ্য ও তৈরি না হলে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেছেন। যারা পরবর্তীতে বাংলা ছবির এ দুরাবস্থার জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি।

(প্রিয়.কম) ‘হালদা’র প্রসঙ্গ; হালদা সিনেমার যে বিষয়বস্তু সেটির আইডিয়াটা কোথা থেকে এলো?

তৌকির আহমেদ: এই নদীটি আমাকে আকর্ষণ করেছিল। এই নদীটির যে বৈশিষ্ট্য একটি প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন কেন্দ্র, সাউথ এশিয়াতে এটি সবচেয়ে বড় মাছের আধার। যেখানে মাছ ডিম ছাড়ে এবং সে ডিম সারা দেশে কনট্রিবিউ করে। এটা আমার কাছে আকর্ষণের একটি বিষয় ছিল। ওখানকার পরিবেশ, বৃষ্টি পড়া, বিদ্যুতের চমক, মেঘের গর্জন। সবকিছু মিলিয়েই। আমি যখন শুনি এটার উপর একজন গল্প একজন লিখেছেন আজাদ বুলবুল। আমার প্রযোজকের সঙ্গে যখন কথা চূড়ান্ত হলো যে এটি ছবি করা যেতে পারে তখন আমি একটি দায়িত্ব চেয়ে নিয়েছিলাম যে চিত্রনাট্যটি আমি করব।

যিনি লিখেছেন তিনি তো আর সিনেমার কথা ভেবে লিখেননি। এটা তো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মাধ্যম। এরমধ্যে তো পার্থক্যই রয়েছে। এই জনপদের গল্পটি আমি বলতে চেয়েছি নদী ও নারীর একটি গল্প হিসেবে। যেখানে একটি নদীতে মাছের প্রজনন, আর নারীর মাতৃত্ব, দুটোই আমি মিলেয়েছি, একটি প্রেমের গল্পের মধ্য দিয়ে। এটাও এক ধরনের চেষ্টা যে দর্শক কীভাবে নেয়। এটা রিসার্চ বেইজড একটি ফিকশন। যেখানে বাস্তবতাকেই একটি গল্পের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। ঐ জনপদের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদানও রয়েছে।

(প্রিয়.কম) সিনেমা মুক্তির আগেই ছবিটি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। পোস্টার, গান, টিজারের পর এবার ট্রেলার রিলিজ হল। ট্রেলারেও তো প্রশংসা কুড়িয়েছে?

তৌকির আহমেদ: আমরা যে গান দুটি ছেড়েছি, সেটি দেখে অনেকেই প্রশংসা করেছেন, লিখেছেনও। অনেকে হয়তো পছন্দ কম করেছেন। তবে পছন্দের সংখ্যাই বেশি। ট্রেলার যেটা প্রকাশ করেছি তাতে তো বেশ সাড়া পেয়েছি। নিঃসন্দেহে বিষয়গুলো ছবিতে আরও পলিসড আকারেই আসবে। অনেকে কিছুতেই হয়তো তাড়াহুড়ো ছিল সে সময়। দর্শক যদি আগ্রহ নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যায়, যদি তাদের ভালো লাগে এ ক'মাস যে প্রচারণাটা করেছিলেন সেটা আরও বাড়িয়ে করবেন। আর যদি তাদের ভালো না লাগে তারও সমালোচনা করবেন। আমিও সেটা শুনতে চাই। কী করে সেটা থেকে আগামিতে আমিও শিক্ষা নিতে পারি।

(প্রিয়.কম) তৌকির আহমেদ এবং জাহিদ হাসান, আপনার দীর্ঘদিন ধরে একই নাট্যদলে যুক্ত ছিলেন, যদিও সিনেমাতে আপনাদের প্রথম কাজ এটি (হালদা)...

তৌকির আহমেদ: জাহিদও খুব ব্যস্ত অভিনেতা। আমিও ব্যস্ত ছিলাম সেদিক থেকে বলতে গেলে। আমি জাহিদ, মোশাররফ একই দলে কাজ করি। আমার অনেকে নাটক সিনেমোয় মোশাররফ কাজ করেছে। জাহিদকে নিয়ে করা হয়নি, হয়তো তার জন্য সুইটেবল চরিত্রটি আসতে দেরি হয়েছে। আমার সাথে কিন্তু সবাই কাজ করেছে। সেদিক থেকে জাহিদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছে। কেউ না কেউ কিন্তু আমার সঙ্গে কাজ করেই গিয়েছে। আমার যাকে দরকার আমি তাকেই নিয়ে কাজ করেছি। জাহিদের আসতে দেরী হয়েছে, অবশেষে জাহিদও এলো।

(প্রিয়.কম) অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক-আপনার ভবিষ্যতের গোলটা ঠিক কোথায়, নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

তৌকির আহমেদ: আমি ভালো ছবি নির্মাণ করতে চাই। আমি লেখার কিছু কাজ করছি। এই মুহূর্তে একটি মঞ্চ নাটক লেখার কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি ২০১৮ সালে এটি মঞ্চে প্রযোজনা করার ইচ্ছে আছে এবং বইমেলাতেও বইটি বের করার ইচ্ছে আছে। একই সঙ্গে আমি ভালো ছবি এবং বিশ্বমানের ছবি নির্মাণ করতে চাই। যে ছবি অন্য দেশে নিয়ে গেলে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল হয়। সে কাজটি যদি আমার হাত দিয়ে হতো তাহলে নিজেকে আমি খুব ভাগ্যবান মনে করতাম। 

(প্রিয়.কম) বাংলা সিনেমার একটি বিষয়ের কথা বলেন, যারা প্রয়োজনীয়তা আপনি এখন দারুণভাবে অনুভব করছেন?

তৌকির আহমেদ: নির্দিষ্ট একটা বিষয়ে বলা যাবে না। একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হলগুলোর অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এটা ঠিক করা দরকার। একই সঙ্গে সিনেমার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার আছে। এটার বাণিজ্য কিংবা লগ্নীকৃত অর্থ যোগান দেওয়ার বিষয় রয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের সার্বিকভাবে ভাবতে হবে। দর্শককেও মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই নির্মাতা আরও ভালো ছবি নির্মাণ করতে পারবেন। 

(প্রিয়.কম) প্রিয়কে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

তৌকির আহমেদ: প্রিয়কেও।

প্রিয় বিনোদন/গোরা