কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

উর্বি'র হাতে আঁকা চোখের ছবি। ছবি কৃতজ্ঞতা: চৌধুরি সাদিয়া ফাহমিদা উর্বি।

প্রতিভা ও দক্ষতার আলোয় উজ্জ্বল উর্বি

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৪
আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৪

(প্রিয়.কম) জীবনের প্রথম ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলেন তার মা ও শিক্ষকের হাত ধরে। স্বাভাবিকভাবেই খুব বিচলিত ছিলেন। ভয় পাচ্ছিলেন। একেবারেই যেতে চাচ্ছিলেন না প্রতিযোগিতায়। তারপরেও অন্যান্য প্রতিযোগীদের সাথে বসিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। ফলাফল, প্রতিযোগিতা শুরু হবার পাঁচ মিনিট পরেই উঠে দৌড় দিয়েছিলেন। মা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলেছিলেন, "তুমি প্রতিযোগিতায় ফার্ষ্ট না সেকেন্ড হলে সেটা বড় কথা নয়। তুমি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছ এটাই বড় কথা।" তার মায়ের বলা এই কথাটাই তার জীবনের জন্যে অনেক বড় অনুপ্রেরণা হয়ে যায়। যে কারণে পরবর্তী কোন প্রতিযোগিতাতেই তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি একটি বারের জন্যেও। যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার অর্জনের খাতায় চোখ বোলালেই।

urrbi

অসম্ভব প্রতিভাবান ও দক্ষ এই চিত্রশিল্পী হলেন চৌধুরি সাদিয়া ফাহমিদা উর্বি। বর্তমানে তিনি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল এর চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। তার ছবি আঁকার শুরুটা হয় স্কুলে ভর্তি হবার আগে থেকেই। ছোটবেলা থেকে নিজেই টুকটাক ছবি আঁকার চেষ্টা করতেন তিনি। কাগজ আর পেন্সিল হাতের কাছে পেলেই মনের খুশি মতো ছবি আঁকতে শুরু করতেন। সালটা ছিল ২০০০।  তখনকার সময়ে কুষ্টিয়ার ‘ধিয়েল আর্ট স্কুল’ এর বেশ সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল। ছবি আঁকার প্রতি তুমুল আগ্রহের কারণেই মা আজিজা নিলুফা আখতার তাকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই মূলত উর্বি’র ছবি আঁকার যাত্রা শুরু হয়।

উর্বি ছবি ২

একদম প্রথম দিকে তিনি যখন ছবি আঁকতেন তখন তার মাথায় কাজ করত, এটা তার নিজস্ব স্বাধীন একটি পৃথিবী। তার নিজের স্বপ্নের ও ভালোলাগার রং দিয়ে সেই পৃথিবীকে সাজাতে চাইতেন তিনি। সেই ভাবনা ও ধারণা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ভালোলাগা ও ভালোবাসা তৈরি হয় উর্বি’র। সেটা এখন তার জীবনে প্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রায় ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে ছবি এঁকে চলেছেন উর্বি। তার ছবি শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল বর্তমানে নামকরা চিত্রশিল্পী সোহাগ পারজেভ এর কাছে। ধিয়েল আর্ট স্কুলে সাত বছর ধরে ছবি আঁকা শেখার পাশাপাশি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সাথেও দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ছবি আঁকা, গান ও আবৃতি নিয়ে ছিলেন তিনি। এরপরে চারুকলায় ছবি আঁকার স্কুলে ছিলেন দেড় বছরব্যাপী। ছবি আঁকা ছাড়াও দারুণ গান ও আবৃতি করেন তিনি। বর্তমানে ছায়ানটের সাথেও যুক্ত রয়েছেন।

উর্বি ছবি ৩

ছবি আঁকার ক্ষেত্রে উর্বি’র অনুপ্রেরণা তার প্রিয় সকল চিত্রশিল্পী। তাদের আঁকা দারুণ সকল ছবি দেখেই আরও ভালো ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়ে থাকে। তার প্রিয় চিত্রশিল্পীরা হলেন- পাবলো পিকাসো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রফিকুন নবী, ধ্রুব এষ, অসীম রায়, তন্ময় ইরতেজা এবং শিশির ভট্টাচার্য।

বিভিন্ন ধরণের ছবি আঁকা হলেও ‘হিউম্যান পোর্ট্রেইট’ ও ‘ল্যান্ডস্কেপ’ ছবি আঁকতেই বেশী ভালোবাসেন উর্বি। নারীদের আঁকা ছবি নিয়ে ‘Senoritaনামে তার একটি সিরিজও রয়েছে। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে অয়েল প্যাস্টেল, পেন স্কেচ এবং পেন্সিল স্কেচ করতেই বেশী পছন্দ করেন তিনি। একেকটি মিডিয়ামের উপর নির্ভর করে একটি ছবি সম্পুর্ণ এঁকে শেষ করতে ভিন্ন পরিমাণ সময়ের প্রয়োজন হয়। যেমন: একটি পেন্সিল স্কেচ সম্পূর্ন শেষ করতে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে চার দিন লেগে যায়। ছবি আঁকার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনেন আজিজ সুপার মার্কেটের গ্রাস হপার্স থেকে। এছাড়া নিউমার্কেটের ক্যানভাস ও মর্ডান থেকেও মাঝে মাঝে কেনাকাটা করেন তিনি।

উর্বি ছবি ৪

এতগুলো বছরে বহু ছবি এঁকেছেন এবং প্রতিদিন নতুন নতুন বহু ছবি এঁকে চলেছেন তিনি। উর্বি’র কাছে জানতে চেয়েছিলাম নিজের আঁকা সকল ছবির মাঝে কোন ছবিটি তার সবচেয়ে বেশী প্রিয়। উত্তরে তিনি বলেন, "আমার আঁকা একটি চোখের ছবি আছে। যেটাতে চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। ছবিটা এঁকেছিলাম ২০১৫ সালে একটা ফটোগ্রাফি দেখে। ছবিটা অনেক প্রিয় কারণ ওই সময়টা আমার জন্য অনেক কঠিন একটা সময় ছিল। মানসিক ভাবে অনেক ভাঙচুর হয়েছিল তখন। অনেকটা সেই ভাবনাকেই ছবিতে তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমি।" 

উর্বি ছবি ৮

কমিশনের ভিত্তিতে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ছবির সাইজ ও ছবি আঁকার মিডিয়ামের উপর নির্ভর করে থাকে ছবির মূল্য। একটি ১০ বাই ১০ ইঞ্চির পেন্সিল স্কেচ-সিঙ্গেল ছবির মূল্য পড়বে ৭০০ টাকা, কাপল ছবি ১১০০ টাকা। এক্ষেত্রে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে ফাহমিদার আঁকিবুঁকি চরিত পেইজ ঘুরে আসলে জেনে নেওয়া যাবে অন্যান্য সকল তথ্য।

উর্বি ছবি ৫

ছবি আঁকার ব্যাপারটি উর্বি’র কাছে মেডিটেশনের মতো। মূলত ছবি আঁকাটা তার কাছে ডায়েরী লেখার মত একটা ব্যাপার। একেকটা ছবি একেকটা ডায়েরী, একেকটা মনের ভাবনা, সুপ্ত ইচ্ছা, কষ্ট, আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম। যার জীবনের সকল কিছুর সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ছবি আঁকা, তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো যে ছবি আঁকা কেন্দ্রিক হবে সেটাই স্বাভাবিক। উর্বি’র তিনটি স্বপ্ন ও ইচ্ছা হলো- নিজের আঁকা ছবি দেশ-বিদেশে প্রদর্শনী করা, নিজের একটি ছবি আঁকার গ্যালারি তৈরি করা; যেখানে নতুন আঁকিয়েদের ছবি প্রদর্শনীতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং সবশেষে শিশুদের জন্য ছবি আঁকার স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।

উর্বি ছবি ৬

লেখার একদম শুরুতে বলা হয়েছিল, জীবনের প্রথম ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার পরে কখনোই উর্বিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কথাটি শুধুই বলার জন্যে বলা হয়নি। তার অনবদ্য দক্ষতাও প্রতিভার ছাপ রেখেছেন পরবর্তি প্রতিটি সময়েই। ছবি আঁকা, গান ও নানবিধ কাজের ক্ষেত্রে ১৫০ উপরে পুরষ্কার পেয়েছেন উর্বি। সকল প্রতিযোগিতা ও পুরষ্কারের মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু পুরষ্কারের বিবরণ তুলে ধরা হলো।

উর্বি ছবি ৭

- ২০০০ সালে SAARC এর Meena festival এর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়েছিলেন তিনি। একই বছর Unicef আয়োজিত "yes! for children" ক্যাম্পেইন এ আয়োজিত প্রতিযোগীতায় দ্বিতীয় হন। এছাড়া একই বছরে এম. নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন আয়োজিত "গল্প লেখা" প্রতিযোগীতায় "অঙ্কুর বিভাগে" পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন তিনি।

- ২০০১ এ সারা বাংলাদেশে আয়োজিত "ভ্রাম্যমাণ চারুকলা প্রদর্শনী" তে প্রথম হন উর্বি। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন স্বয়ং রফিকুন নবী স্যার।

- ২০০৩ সালে একুশে স্বর্ণ পদক প্রতিযোগীতায়  রবীন্দ্র সঙ্গীতে প্রথম হয়েছিলেন। এছাড়া ৪ঠা অক্টোবর চ্যানেল আইয়ের জন্মদিনে আয়োজিত দেশব্যাপি পোস্টার আঁকা প্রতিযোগীতায় প্রথম হন তিনি।

- ২০০৪ সালে পুরো বাংলাদেশের মধ্যে উর্বি "জয়নুল পুরষ্কার" পেয়েছিলেন। এছাড়া রোট্যার‍্যাক্ট আর আবুল খায়ের গ্রুপ মিলে "স্টারশিপ বিজয় দিবস" চিত্রাংকন প্রতিযোগীতায় "স্টার সম্মাননা" অর্জন করেছিলেন।

- ২০০৫ এ চারুকলায় নিত্য উপহার আয়োজিত "বসে আঁক" প্রতিযোগীতায় জুনিয়র গ্রুপে "সেরা আঁকিয়ে" হিসেবে সম্মাননা অর্জন করেছিলেন উর্বি। উক্ত প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে ছিলেন স্বয়ং ধ্রুব এষ, শিশির ভট্টাচার্য, হাশেম খান।

- ২০১৬ তে "Mentos" আয়োজিত সারা বাংলাদেশে "voice hunt" প্রতিযোগীতায় ফাইনালে বারোতম হয়েছিলেন উর্বি।

দারুণ ব্যাপার হচ্ছে উর্বি লালন একাডেমীর একজন আজীবন সদস্য। ২০০২ সালে বিটিভিতে শিশু সংগীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও "জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগীতা" এবং "জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ" প্রতিযোগীতায় বহুবার অংশ গ্রহন করেছিলেন এবং বিভাগীয় প্রাইজও পেয়েছেন অনেক।

নিজের ভালোবাসা ও স্বপ্নকে নিয়ে এগিয়ে চলা প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী উর্বি’র জন্য নিরন্তর শুভকামনা।

প্রিয় লাইফ/ কে এন দেয়া