কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

এসওএস শিশুপল্লীতে নিজের একটি পরিবারে বেড়ে ওঠে ছিন্নমূল শিশুরা। ছবি ও তথ্য কৃতজ্ঞতা: কাজী তানিয়া ইমতিয়াজ

ছিন্নমূল শিশুদের নির্ভয়ের ছায়া: এসওএস শিশুপল্লী

কে এন দেয়া
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০১৭, ০০:২৫
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭, ০০:২৫

(প্রিয়.কম) একটি শিশু যখন পিতা-মাতা, পরিজন হারায়, তখন তার কী মনে হয়? খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলো তো আসবেই, কিন্তু তারচাইতেও গভীরে সে অনুভব করে আরো একটি অভাব। মায়ের অভাব। নিজের একটি পরিবারের অভাব। অনাথ, আশ্রয়হীন শিশুদের জন্য উষ্ণ ভালোবাসার অভাব পূরণ করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো এসওএস শিশুপল্লী। চট্টগ্রামের এসওএস শিশুপল্লীতে জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন কাজী তানিয়া ইমতিয়াজ। তিনিই আমাদের জানান মহীরুহ এই প্রতিষ্ঠানের আদ্যপান্ত।

হারম্যান মেইনারের পদক্ষেপ

ড. হারম্যান মেইনার (Hermann Gmeiner) (২৩ জুন ১৯১৯ - ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬) ছিলেন একজন বিখ্যাত অস্ট্রীয় সমাজসেবক ও দাতা। ছিন্নমূল ও অসহায় শিশুদের জন্য এসওএস শিশুপল্লী প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। মায়ের মৃত্যুর পর ষোড়শী বড় বোন তাদের দেখাশোনা করেন, পরিবারে তাদের মায়ের ভূমিকা ছিল তারই। হারম্যান মেইনার ছিলেন মেধাবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপর মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের পর তিনি দেখেন, চারিদিকেই যুদ্ধ ফেরত যুবক আর শরণার্থী শিশুদের আহাজারি। হারম্যান মেইনার এই সময় বসে না থেকে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে যান। সাথে সাথে তিনি 'এসওএস' ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে থাকেন, যা হতে পারে এসব শিশু ও কিশোরদের হারানো পরিবারের বিকল্প।

পরিবার

কাজী তানিয়ার বিয়েতে তার শিশুপল্লীর পরিবার

এসওএস এর সূচনার ইতিহাসটা খুব মধুর ছিল না। তৎকালিন কর্তৃপক্ষের অনেকেই ধারণাটির মানে বুঝে উঠতে পারেন্‌নি। তখন হারম্যান মেইনার এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর কিছু বন্ধু। এই বন্ধুরাই তাকে যথাযথ সাহায্য করেছিলেন। মাত্র ৬০০ অস্ট্রিয়ান মুদ্রা নিয়ে ১৯৪৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এসওএস-কিন্ডারডফ। একই বছরে ‘ইমসট’তে প্রথমবারের মত উন্মোচিত হয় "এসওএস শিশু পল্লীর" ফলক। এই সময় খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়ার কারনে তিনি পড়াশোনা না চালানোর মত কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই "এসওএস শিশু পল্লী" প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন।

শিশুপল্লী এবং মমতাময়ী ‘মা’

SOS Children's Villages এ চারটি উপাদান নিয়ে তৈরি হয় প্রকল্প। একজন মা, একটি বাড়ি, কজন ভাইবোন ও একটি পল্লী। মায়ের কথাটা শুনে অবাক লাগতে পারে অনেকের। বাংলাদেশে Hermann Gmeiner শিশু পল্লির ছয়টি শাখা আছে, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া ও সিলেট। এক জন মা, ১২ জন ভাইবোন নিয়ে একটি পরিবার। এরকম ১০/১২ টি পরিবার নিয়ে একটি পল্লী। প্রতিটি শাখায় প্রায় ১০০ শিশু সার্বিক সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে। প্রতি ১২টি শিশুর দায়িত্বে যে ‘মা’, বা এসওএস মাদার থাকেন, তা অনেকটা হারম্যান মেইনারের সেই মমতাময়ী বড় বোনেরই এক ছায়া। এসব শিশুকে সপ্তাহে সাত দিন, চব্বিশ ঘন্টা মায়ের মতো আগলে রাখেন তারা। মা যে কেউ হতে পারেন না। এখানে মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গেলে তার স্বামী থাকা যাবে না, তবে সন্তান থাকতে পারবে। অষ্টম শ্রেণী থেকে এসএসসি পাশ নারীরা সাধারণত ‘মা’ হিসেবে এখানে থাকেন। বছরে একবার, ১৫ দিনের জন্য তারা নিজেদের পরিবারের কাছে যেতে পারেন। বাকি সময়টা তাদের কেটে যায় এই শিশুপল্লীতেই।

মা

কাজী তানিয়া বেড়ে উঠেছেন এই 'মা' এর যত্নে

বর্তমানে ১৩২টি দেশে ৪৩৮টি শিশু পল্লিতে ১,৩১,০০০ শিশু স্কুলে পড়াশুনা করছে। মায়ের আদর ও ভাইবোনের স্নেহের পরশে শিশু পল্লীতে তারা বড় হচ্ছে। উচ্চমানের শিক্ষা,  ভাল মানের খাবার,  বাসস্থান, খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধাসহ তারা বড় হচ্ছে। এম এ পর্যন্ত পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে। শিশুর যোগ্যতার কোন মাপ কাঠি নেই। কেবল এতিম বা পিতৃহারা হতে হবে। অসুস্থ, দুর্বল বা অন্য কোন কিছুই বাধা নয়। একদম নবজাতক থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা এখানে ভর্তি হতে পারবে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মান্তরের কোন সুযোগ নেই। যে যার ধর্ম নাম পরিচয় নিয়ে বড় হবে। SSC পাশ করার পর মা (যদি জীবিত থাকেন) ও আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। এম এ পাশ করা পর্যন্ত Hermann Gmeiner তার খরচ বহন করবে।

মাঠ

চট্টগ্রামের শিশুপল্লী, শিশুদের জন্য রয়েছে বিশাল মাঠ

কাজী তানিয়া নিজে বড় হয়েছেন চট্টগ্রামের শিশুপল্লীটিতে। এখানে জীবনের প্রথমভাগ কাটানোর পর অনেকেই কর্মক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে সমাজে। সমাজের ছিন্নমূল যে কোনো শিশুর জন্য তা হতে পারে একটি আদর্শ পরিবার। অনেকেই জানতেন না, এমন পরিস্থিতির শিশুদের জন্য কী করতে হবে। তারা এখন নিশ্চিন্তে যোগাযোগ করতে পারেন এসব শিশু পল্লীর সাথে, এই শিশুদের দিতে পারেন নিজেদের একটি পরিবারের স্বাদ।