কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

গর্ভধারিণী একজন মুসলিম মা। ছবি : সংগৃহীত

গর্ভবতী মা ও সন্তানকে নিয়ে সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ও কুসংস্কার!

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৫৮
আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৫৮

(প্রিয়.কম) সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাটি স্পর্শ করার আগেই যার কোল হয় তার প্রথম ও একমাত্র আবাস তিনি গর্ভধারিণী মা। ১০ মাস ১০ দিন অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করার পর একটি সন্তানকে পৃথিবী নামক রাজ্যে প্রসব করেন যিনি, তিনিই আমাদের মা। প্রায় প্রতিটি মায়ের স্বপ্ন গর্ভধারণ করা। গর্ভধারণের মাঝেই নাকি মা জাতির পূর্ণতা নিহিত। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, একজন নারীর এই গর্ভকালীন সময়কে ঘিরে আমাদের সমাজে তথা মুসলিম পরিবারগুলোতে নানাবিধ ভুল প্রথা ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। কোরআন-হাদিস তথা ইসলামে যার কোনো ভিত্তি বা গ্রহযোগ্যতা নেই। তবুও এগুলোকে সমাজের বসবাসকারী মুসলিমরা ইসলামের রীতি হিসেবেই মান্য করেন। গর্ভধারিণী মা ও সন্তানকে নিয়ে সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ও কুসংষ্কার নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন। চলুন তাহলে জেনে নেই, ইসলামী রীতি বা নিয়ম মনে করে গর্ভধারিণী মা ও সন্তানকে নিয়ে আমাদের সমাজে কী কী ভুল প্রথা ও কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে তা জেনে নেই এবং নিজেদের জীবন থেকে এসব কুপ্রথাকে বিদায় জানাই।

১. চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মহিলা কিছু কাটলে কি গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়? এটি একটি ভুল বিশ্বাস। কিছু মানুষ মনে করেন, চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী মহিলা কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়। কানকাটা বা ঠোঁটকাটা অবস্থায় জন্ম নেয়। এটি একটি ভুল বিশ্বাস। বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। শরীয়তে যেমন এর কোনো ভিত্তি নেই তেমনি বিবেক-বুদ্ধিও এ ধরনের অলীক ধারণা সমর্থন করে না। অতএব এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। 

২. গর্ভাবস্থায় আগের সন্তানের খৎনা করানো যাবে না- এটি একটি কুসংস্কার। কোনো কোনো এলাকার মানুষ মনে করে, মা যদি গর্ভাবস্থায় থাকেন তাহলে তার আগের সন্তানের খৎনা করানো যাবে না। করলে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হবে। এটি একটি কুসংস্কার মাত্র। এগুলো বিশ্বাস করা যাবে না। কোনো কোনো মানুষ তো এও মনে করে যে, চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময়ও গর্ভবতী নারী কিছু কাটাকাটি করলে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়। এ সবই কুসংস্কার।

৩. প্রথম সন্তান মারা গেলে কি পরের সন্তানের কান ফুটো করে দিতে হয়! এটি একটি কুসংস্কার। কিছু মানুষের ধারণা, প্রথম সন্তান যদি মারা যায়, তাহলে পরবর্তী সন্তানের কান ফুটো করে দিতে হয়; তাহলে সে আর মরবে না বা দীর্ঘজীবি হবে। অনেককে দেখা যায় কান ফুটো করে কানে একটি রিং পরিয়ে দেয়। এটি একটি কুসংস্কার। এর কোনো ভিত্তি নেই। সন্তান দেওয়া না দেওয়া যেমন আল্লাহর ইচ্ছা, তেমনি দেওয়ার পর বেঁচে থাকা না থাকাও আল্লাহর ইচ্ছা। সন্তানের দীর্ঘ হায়াতের জন্য আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে; তিনিই হায়াত মওতের মালিক। এর সাথে কান ফুটো করা না করার কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং এ ধরনের জাহেলী রসম থেকে বেঁচে থাকতে হবে এবং সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে।

৪. মেয়ে সন্তান হলে কানে আযান না দেয়া- এটি আমলগত একটি অবহেলা। নিয়ম হলো সন্তান ছেলে হোক মেয়ে হোক ভূমিষ্ট হওয়ার পর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া। কিন্তু দেখা যায়, অনেক মানুষ ছেলে হলে কানে আযান ইকামত দেয় কিন্তু মেয়ে হলে দেয় না বা শুধু আযান দেয় ইকামত দেয় না। এটা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তানের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। এছাড়া অনেকে তো এ আমলটির ব্যাপারেই অবহেলা করেন, যা একেবারেই অনুচিত।

৫. যে ঘরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় সে ঘর কি চল্লিশ দিন নাপাক থাকে? এটি একটি ভুল মাসআলা। কোনো কোনো এলাকায় মনে করা হয়, যে ঘরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় বা ভূমিষ্ঠ শিশুর মা যে ঘরে অবস্থান করেন সে ঘর চল্লিশ দিন পর্যন্ত নাপাক থাকে, এখানে নামায পড়া যাবে না। এটি একেবারেই অমূলক ধারণা, যা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। পাক নাপাকের সম্পর্ক তো নাপাকি লেগে থাকা না থাকার সাথে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া বা ভূমিষ্ঠ সন্তানের মায়ের অবস্থানের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই।

৬. বাসন চেটে খেলে কি কন্যা সন্তান হয়? একটি ভুল ভাবনা বা কুসংস্কার। এক ভাইকে বাসন চেটে খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হলে সে বলল, ‘প্লেট চেটে খেলে তো কন্যা সন্তান হয়’। আরেকজন মন্তব্য করলেন, চেটে খাওয়া তো অভদ্রতা ও দারিদ্রে্যর আলামত। (নাউযুবিল্লাহ) ধারণা দুটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, অর্থহীন ও নিতামত্মই মূর্খতা। দ্বীনী বিষয়ে গাফলত ও অজ্ঞতার কারণেই যে এ ধরনের কথাবার্তা মানুষ বলে থাকে তাতে কোনো সন্দেহ  নেই। কেননা সন্তান দেওয়া না দেওয়া বা কাউকে ছেলে সন্তান দেয়া, কাউকে মেয়ে সন্তান দেয়া তো সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন। বাসন চেটে খাওয়ার সাথে এর কী সম্পর্ক? আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আসমান যমীনের রাজত্ব আল্লাহ্রই; তিনি যা চান সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র দেন। অথবা তাদেরকে পুত্র-কন্যা উভয়ই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সবকিছুই জানেন, সব কিছুই করতে পারেন।’ (সূরা শুরা ৪২ : ৪৯-৫০) এ ধরনের ধারণার আরেকটি বাজে দিক হলো, তাতে জাহেলী যুগের দুর্গন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে। জাহেলী যুগে কন্যা সন্তানের কথা শুনলেই মানুষের মুখ কালো হয়ে যেত। (সূরা নহল ১৬ : ৫৮) আল্লাহ তো কন্যা সন্তানের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলে ব্যক্ত করেছেন।

আর সম্ভবত দ্বিতীয় মন্তব্যটি ঐ ভদ্রলোক এজন্য করেছেন যে, তার জানা নেই; বাসন চেটে খাওয়া রাসূলের সুন্নত। কারণ যার হৃদয়ে তিল পরিমাণ ঈমান আছে, বিষয়টি সুন্নত জানার পরও সে ব্যক্তি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। কোন্টা ভদ্রতা ও আদব-কায়দা আর কোন্টা অভদ্রতা ও বেআদবী তা তো রাসূলের কাছ থেকেই শিখতে হবে। হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ খানা খাবে সে যেন তার আঙ্গুল চেটে খায়। আর লোকমা (খাদ্যদ্রব্য) পড়ে গেলে সে যেন ময়লা দূর করে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা রেখে না দেয়। সাথে সাথে তিনি আমাদেরকে পাত্র চেটে খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কারণ, তোমাদের জানা নেই খাদ্যের কোন্ অংশে বরকত রয়েছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীস  ১৮০৩)

সূত্র : গবেষণা ম্যাগাজিন আল কাউসার

প্রিয় ইসলাম/সিফাত বিনতে ওয়াহিদ