কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

মিয়ানমারের ভিতরে স্কাই নিউজের দুই সাংবাদিক। ছবি: স্কাই নিউজ

মিয়ানমারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের যেমন দেখলেন দুই সাংবাদিক

জাহিদুল ইসলাম জন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স
প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪৯
আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪৯


(প্রিয়.কম) জেলেদের নৌকায় ভর করে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারে ঢুকেছিলেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজের দুই সাংবাদিক। সংবাদ প্রযোজক নেভালি লাজারাসের সঙ্গে সেই যাত্রার সঙ্গী হয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান মার্টিন স্মিথ। ফিরে এসে বিশেষ প্রতিনিধি এলেক্স ক্রোফোর্ডের সঙ্গে আলাপচারিতায় তারা বর্ণনা করেছেন রোহিঙ্গা দুর্দশার ভয়ঙ্কর চিত্র।

হৃদয়ভাঙ্গা অসহায়ত্বে রোহিঙ্গারা: নেভালি লাজারাস

দলের জন্য এটা ছিলো স্নায়ুতে চাপ ফেলা একটা যাত্রা। কিন্তু আমাদের তা করতে একমাত্র উপায় ছিলো নদীপথ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার পৌঁছানো।
তবে ওই পথ পাড়ি দিতে কেউই আমাদের সাহায্য করার সাহস পাচ্ছিলেন না। গ্রেফতার অথবা নৌকা পুড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে জেলেরাও সাহায্য করতে রাজি ছিলেন না। কয়েক সপ্তাহ চেষ্টার পর অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল যিনি আমাদের সাহায্য করতে চান। তবে আমাদের জন্যও একটা পরীক্ষা ছিলো ঠিক মাঝিকে খুঁজে পাওয়া। কারণ প্রতিসপ্তাহে বা প্রায়ই এই কাজে অভিজ্ঞ একজনকে ছাড়া যাওয়ার উপায় ছিলো না। ওই মাঝিকে জানতে হতো ধরা পড়া ছাড়া ভেতরে ঢোকা আর বাইরে বের হওয়ার রাস্তা। তাকে নিশ্চিত করতে হতো নৌকাটাও ডুববে না। কারণ আমরা জানি এরই মধ্যে নৌকা ডুবে ২০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

যদিও আমরা সবাই খুব ভালো সাঁতারু, তবু আমরা জানতাম মাছধরা নৌকা ডুবতে শুরু করলে সাঁতারের সুযোগও পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে যাত্রা শুরুর আগে উপকুল জুড়ে ছিলো গভীর অন্ধকার। নৌকা চলতে শুরু করলে চাঁদের আলোই ছিলো একমাত্র সম্বল। অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই আমরা কোথায় যাচ্ছি। ভরসা ছিলো একমাত্র নৌকার মাঝি।

মাঝি আর তার দলের সদস্যরা যখন আশেপাশের চারদিকে ওপর তীক্ষ্ন নজর রাখার চেষ্টা করছিলো, তখন আমরা সবাই চুপ থাকতে বাধ্য ছিলাম। অপরিচিত নৌপথে আমাদের কিছুই জানা ছিলো না। হঠাৎ করে ফ্লাশ লাইটের আলো নৌকার ওপর এসে পড়লো। মাঝিরা জানালো এটা ডাক পাঠানো আলো।

চারপাশে ভিড় করা অসংখ্য রোহিঙ্গাদের একাংশ। ছবি: স্কাই নিউজ
চারপাশে ভিড় করা অসংখ্য রোহিঙ্গাদের একাংশ। ছবি: স্কাই নিউজ

তীর থেকে কিছু দূরে নৌকা ভেড়ানো হলো। লাফিয়ে নৌকা থেকে নামতেই কোমরপানিতে পড়লাম আমরা। আর তখনই চোখে পড়লো হৃদয়ভাঙ্গা দৃশ্য। যতক্ষণ সেখানে ছিলাম সাহায্যের আশায় মানুষের অনবরত চিৎকার শুনে গেছি। কিন্তু তাদের সাহায্য করার কেউ সেখানে ছিলো না। আমাদের দেখে কেউ কেউ হয়তো সাহায্যের আশা করেছিলো, কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবেই সবাইকেই নিয়ে আসতে পারতাম না।

প্রত্যেকেই নিজেদের গল্প বলতে চাইছিলো। অসহায় সন্তানদের বারবার আমাদের দেখাচ্ছিলো। অসুস্থ আর আঘাত পাওয়া মানুষ নিজেদের কষ্টের কথা বলতে উদগ্রীব হয়েছিলো। হাজার হাজার মানুষ সেই উপকুলে সাহায্যের আশায় বসে ছিলো।

আরেকটা বিষয় আমাকে আঘাত করেছিলো। সেসব মানুষের অনেকের কাছেই ছিলো সদ্যজাত শিশু। এই অসহায় উপকুলেই তাদের জন্ম হয়েছে।

উপকুলে আশ্রয় নেওয়া অনেকের কাছেই ছিলো সদ্যোজাত সন্তান। ছবি: স্কাই নিউজ
উপকুলে আশ্রয় নেওয়া অনেকের কাছেই ছিলো সদ্যজাত সন্তান। ছবি: স্কাই নিউজ

অনাহার আর খাবার পানির অভাবের মধ্যেই তাদের জন্ম হয়েছে। নেই চিকিৎসার সুযোগ। দুই টুকরো বাঁশের ওপরে সামান্য একটু প্লাস্টিকের ছাউনি তাদের অন্যান্য জিনিস থেকে শুধু আলাদা করে রেখেছে।

তাদের প্রত্যেককেই দেখাচ্ছিলো দ্বিধান্বিত আর হতাশ। এটা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর যে এসমস্ত মানুষকে জোর করে এখানে পাঠানো হয়েছে। আর এখানে তারা হয়তো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।

তারা বারবার আমাদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিলো কিন্তু আমাদের সামর্থ ছিলো সামান্য। আমরা কিছুই করতে পারিনি। হতাশ হয়ে আমার রাগ হচ্ছিলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর। মানবিক সহায়তার সংগঠনগুলো কেন এসব হাজার হাজার মানুষের জন্য কিছুই করতে পারছে না?

এতটা ব্যর্থ তারা কীভাবে হতে পারে? এসমস্ত মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে তারা আরও বেশি কিছু কেন করছে না? এই বিপর্যয় কেন রাজনৈতিক ঠেলাঠেলির বিষয় হবে? এটা ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট।

ছবি তোলায় ব্যস্ত ক্যামেরাম্যান মার্টিন স্মিথ। ছবি: স্কাই নিউজ

ছবি তোলায় ব্যস্ত ক্যামেরাম্যান মার্টিন স্মিথ। ছবি: স্কাই নিউজ

সৈকতে হয়তো অনেক মৃতকেও আমরা দেখতে পেতাম। কিন্তু রাতের অন্ধকার থাকায় তা আমাদের দেখতে হয়নি। ২০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এটাই ছিলো আমার দেখে সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।

নারীরা হাহাকার করছিলো। কাঁদছিলো পুরষেরাও। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কাছ থেকে হয়তো তারা কোনো সাহায্য আশা করেছিলো। কিন্তু সেই সাহায়্যের আশাও আমাদের কাছে বাড়তি বোঝা ছিলো।

কিছুই যদি না বদলায়, কিছুই যদি না ঘটে, আমরা হয়তো হয়তো কখনওই জানতেও পারবো না সেই রাতে যাদের দেখেছিলাম তারা আদৌ বেঁচে আছে কিনা।

তাদের উদ্ধারে একটি  মুহুর্ত দেরি হয়ে যাওয়া মানে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আরেকটু কমে যাওয়া।

(নিউজ প্রোডিউসার নেভালি লাজারাস ২০ বছরের বেশি সময় ধরে স্কাই এশিয়া ব্যুরোর ভারতের নয়াদিল্লিতে কাজ করছেন। ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের নানা প্রান্ত।)

এক ক্যামেরাম্যানের চোখে : মার্টিন স্মিথ

আমরা আগেই জানতাম এটা কোনো সাধারণ গল্প হবে না। আমি জানতাম যে দৃশ্য আমরা দেখতে যাচ্ছি তার প্রভাব খুব ভয়াবহ। তাই প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো যেন ঠিকভাবে কাজ করে তা নিশ্চিত হতে চাইছিলাম। 

একারণে স্কাই টিমে একমাত্র আমিই ছিলাম যে অন্ধাকারেও সবকিছু দেখতি পাচ্ছিলাম। কারণ আমার কাছে ছিলো রাতে দেখার ক্যামেরা। আর অবিশ্বাস্যভাবে তা কাজও করছিলো চমৎকার।

দুই-তিন ফুট দূরে দাড়ানো মানুষগুলো বুঝতে পারছিলো না যে তাদের ভিডিও করা হচ্ছে। আর একারণে তাদের অনুভূতির প্রকাশও ছিলো শতভাগ সঠিক। আর অন্ধকারে তারা ভাবছিলো আমি সেখানে নেই। তাদের সামনে যে ক্যামেরা আছে তা তারা দেখতেও পারছিলো না।

জেলে নৌকায় দুই রোহিঙ্গা বালক। ছবি: স্কাই নিউজ
জেলে নৌকায় দুই রোহিঙ্গা বালক। ছবি: স্কাই নিউজ

ওই অন্ধকারের ভেতরেও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ওইসব মানুষদের অসহায়ত্ব। এই জায়গা থেকে চলে যেত ব্যাকুল ছিলো সেই মানুষগুলো। বাংলাদেশে ফিরে আসার সময় আমরা হয়তো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আসলাম। নৌকায় যতো মানুষ তোলা সম্ভব তত মানুষ নিয়ে আসতে চাইছিলেন নৌকার মাঝি। নিজের চোখে সেই দৃশ্য দেখার অনুভূতি সত্যিই আলাদা।

ফেরার পথে জেলে নৌকার পাটাতনে বসা এক মায়ের দিকে চোখ পড়লো। বয়সে তরুণ ওই মায়ের বোরকার আঁচল উড়ছিলো বাতাসে। সমুদ্রের পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছিলো চাঁদ। আর মানুষগুলোর যাত্রা ছিলো অনিশ্চয়তার দিকে।

(মার্টিন স্মিথ স্কাই নিউজের হয়ে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধ পরিস্থিতি সংবাদ সংগ্রহের অভিজ্ঞতার রয়েছে তার।)