কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।

এ দেশের রাজনীতিতে সঠিক মর্যাদা কেউ পায় না, শেখ সাহেবও পান নাই: শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০১৭, ০০:৪৮
আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০১৭, ০০:৪৮

(প্রিয়.কম) বায়ান্ন থেকে একাত্তর- বাংলাদেশের সকল আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী- শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। এক সময় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এই সহযোগী তার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে দল বদলিয়েছেন বেশ কয়েকটি। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকলেও, শারীরিক অসুস্থতা এবং দলে কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়ার কারণে অনেকটাই অভিমানে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। রাজধানীর গুলশান এভিনিউ’য়ের নিজ বাড়িতে অনেকটা নিভৃতেই কাটে তার দিন। সম্প্রতি এই বর্ষীয়ান নেতার সঙ্গে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কথা হয় প্রিয়.কম এর। 

প্রিয়.কম: আপনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা করেছিলেন কিভাবে?

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: আমি তখন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়ি। ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের স্কুলে রাজনীতি বা আন্দোলন করার কোনো সুযোগ ছিল না। এই প্রথা ভেঙে, আমিই প্রথম সেখানে ধর্মঘট শুরু করি। সেন্ট গ্রেগরিতে সে সময় প্রিন্সিপাল ছিলেন ব্রাদার জেমস। তিনি আমাকে এইসব রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিলেন। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এক্সপেল লেটার দেখিয়ে বললেন- সেন্ট গ্রগরি থেকে এক্সপেল করা মানে জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অন্য কোনো স্কুলে এরপর আর ভর্তি হওয়া অসম্ভব। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায়, উত্তেজিত না হয়ে ব্রাদার জেমসকে জানালাম- ওরা আমাদের উপর উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইছে, অথচ এ দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে; আমাদের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না, একটা ভিনদেশি ভাষাকে আমাদের মেনে নিতে হবে- আপনিই বলেন ব্রাদার, এটা কি অন্যায় না? তিনি আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বললেন- অবশ্যই এটা অন্যায়, বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা উচিৎ। কিন্তু এটা স্কুল, এই কম্পাউন্ডের মধ্যে তোমরা এসব করতে পারবে না।

আমিও তখন ব্রাদারকে কথা দিলাম, স্কুল কম্পাউন্ডে আর কোনো হৈচৈ করব না। স্কুলের ভেতর না করলেও; গেটের বাইরেই আমরা আন্দোলন করেছি, বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেদের নিয়ে ধর্মঘট পালন করেছি। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই ভাষার জন্য সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। ছাত্রদের মধ্যে তখন চরম উত্তেজনা কাজ করছিল। বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনের জন্য ধীরে ধীরে নিজেদের প্রস্তুত করছিল। সেন্ট গ্রেগরিতে পড়ার সময়, আন্দোলন বেগবান করতে তৎকালীন ছাত্রলীগের তিনজন নেতা আওয়াল সাহেব, মিজানুর রহমান সাহেব এবং আবদুল ওয়াদুদ সাহেব সেখানে প্রায়ই যেতেন। তারা সেখানে আন্দোলনের জন্য শক্ত, সামর্থ্য ও ত্যাগী ছাত্র খুঁজতে গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করলেন। মূলত তাদের সংস্পর্শে এসেই আমার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা শুরু। আর আমার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন ঢাকা কলেজের ইংরেজির প্রফেসর রশিদ। তিনিই আমাকে ’৫২ সালে অনেকটা হাত ধরেই কারাগারে নিয়ে যান।

প্রিয়.কম: তার মানে আপনার রাজনীতির শুরু ছাত্রলীগের হাত ধরেই ?

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: বলতে পারো। ছাত্রলীগের সাংগঠিক শক্তি তখন যে কোনো তরুণকেই আকৃষ্ট করার মতো যথেষ্ট ছিল। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। এখন যারা ছাত্রলীগ করে, তারা অন্ধকার যুগের সাধক।

প্রিয়.কম: বঙ্গবন্ধু’র সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত কবে থেকে?

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে আইডল ছিলেন। তখনও তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হোন নাই। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’, ‘লিডার’ বা ‘শেখ সাহেব’। এই রকম সাহসী একজন রাজনৈতিক উপমহাদেশে আর কয়জন ছিলেন আমার জানা নেই। তার সে কি দরাজ কণ্ঠ! কণ্ঠ শুনলেই স্তব্ধ হয়ে যেত সব। দলের কর্মীদের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। প্রতিটা কর্মীর নাম তিনি মুখস্ত বলে দিতে পারতেন। এখন যারা রাজনীতি করেন, তারা জানেনই না তার কোন ওয়ার্ডে বা কোন থানায় কোন কর্মীটা কাজ করে, তাদের নামই বা কি! কিন্তু শেখ সাহেব ১০ বছর আগে দেখা হওয়া কোনো কর্মীর নামও মুহূর্তেই বলে দিতে পারতেন। দলের নেতা-কর্মীদের কাছে এই জন্য তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন, উনাকে দেখার জন্য তো সবাই পাগল থাকত। আমার সঙ্গে বেশ ক’বার দেখা হলেও ঘনিষ্ঠ হয়েছি গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানের পর থেকে। সেখানে আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। লোকজনের মুখে সেই বক্তৃতার প্রশংসা শোনার পর ঢাকায় এসে উনি আমার খোঁজ করলেন, ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মুবিন আহমেদ আমাকে তখন শেখ সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। প্রথম দিনেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন- এখন থেইকা আমার কাছে সরাসরি আসবি, কাউকে নিয়া আসতে হইবো না। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার পকেটে হাত দিয়ে তিনি একশ টাকার একটা বাণ্ডিল ঢুকিয়ে দিলেন। এই রকমই ছিলেন আমাদের নেতা শেখ মুজিব।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

প্রিয়.কম: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আপনি। কেমন ছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপট ?

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: একদিন শেখ সাহেব আমাদের ডেকে বললেন- আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ স্বাধীন করা। তোরা আন্দোলন করতেছস ঠিক আছে কিন্তু দেশ স্বাধীন করার জন্য আমাদের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হইবো। আমরা তাকে বললাম- আমাদের কি করতে হবে বলেন, আপনি যা বলবেন আমরা তা-ই করতে প্রস্তুত আছি। উনি একটা লিফলেট তৈরি করলেন, তার এক বন্ধুর প্রেসে গিয়ে নিজেই মেশিনের প্যাডেল চালিয়ে লিফলেট ছাপালেন। আমরা সেই লিফলেট নিয়ে বিভিন্ন দেশের অ্যাম্বাসি এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে দ্রুত ফেলে চলে আসতাম। সে সময় ধরা পড়লে কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় আমাদের ফাঁসি অনিবার্য ছিল। দেশ স্বাধীন করার জন্য শেখ সাহেবের কথায় আমরা আস্তে আস্তে একত্রিত হয়েছি।

প্রিয়.কম: যুদ্ধের সময় ভারতীয় পার্লামেন্টের আপনার বক্তৃতা আলোড়ন তুলেছিল...

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: এমন একটা সময় আমি সেখানে বক্তৃতা করেছিলাম, যখন আমার বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার পরিবার, স্ত্রী-পুত্র কে কোথায়, তার কিছুই জানি না আমি। আমার অনুপস্থিতিতেই দেশের মাটিতে আমার নামে বিচার হয়ে মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে। আমার মানসিক অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ। আমাদের লিডার শেখ মুজিবও তখন পাকিস্তানের কারাগারে। এক কোটির উপর শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সে দেশের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে আমি বললাম- আমি জানি না আমার স্ত্রী-পুত্র কোথায় আছে, আমার বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আমার নেতা এখন বন্দী রয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, এমন অবস্থায় আমি আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি পার্লামেন্টের সিস্টেমে কথা বলতে পারলাম কিনা সেটা না দেখে, আমার অন্তরের জ্বালাটা দেখ। এই কথাগুলো বলার পর হাততালি পড়া শুরু হলো। কোনো বিদেশি মেহমান সেদেশের পার্লামেন্টে ১০ থেকে ১২ মিনিটের বেশি বক্তৃতা করার সুযোগ পান না, সেখানে আমি আড়াই ঘণ্টা আমাদের দেশের সে সময়ের সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করলাম। সেই বক্তৃতার পর পুরো ভারতজুড়ে আলোচনা চলল। আই বিকেম দ্য হটেস্ট কেক অব দ্য ইন্ডিয়া।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসসেন

প্রিয়.কম: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পঁচাত্তরে আপনার ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। জেলহত্যা মামলাতে আপনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: যারা এইসব অভিযোগ করে, তারা কেন আমার সামনে এসে করে না? আমি তো কোথাও এইসব শুনি নাই যে পঁচাত্তরের জন্য আমার নামে কেউ অভিযোগ করেছে! আমার নামে তো মামলা করেছিল, প্রমাণ করতে পেরেছে কিছু? আওয়ামীলীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতারা তো সেই মামলার সাক্ষ্য দিয়েছে, আমার নামে তো কেউ একটাও প্রমাণ পেশ করতে পারে নাই। যারা আমাকে নিয়ে এসব অপপ্রচার করে, তারা জেদের বশে করে। আমি আওয়ামীলীগের রাজনীতি করি না বলে করে। স্বাধীনতার পক্ষের এমন কোনো বাপের বেটাকে আমার সামনে নিয়ে আসো, যে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবে যে পঁচাত্তরের ঘটনায় আমার কোনো হাত ছিল।

প্রিয়.কম: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাহলে আপনি খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী সভায় যোগ দিলেন কেন? তিনি সেই হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী জেনেও তার মন্ত্রীসভায় শপথ পড়লেন!

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: মোশতাকের সাথে যাওয়াটা আমার ভুল ছিল, কিন্তু আমি তো তখনও জানতাম না যে সেও এই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। মোশতাক আমাদের কাছে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে কসম খেয়েছিল যে শেখ সাহেবের হত্যার সাথে তার কোনো যোগসূত্র নাই। তার চালাকি বুঝতে পারি আরও অনেক পরে, যখন সে ১৫ আগস্টকে ‘নাজাত দিবস’ ঘোষণা করতে চাইলো, তখন। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করি। ১৫ আগস্টকে আমরা শোক দিবস ঘোষণা করতে বলি। পরবর্তীতে এইসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আমি তার সরকার থেকে বের হয়ে গিয়ে পার্টি ভাগ করে ফেলি। যদি ষড়যন্ত্রকারীই হতাম, শেখ সাহেবের মৃত্যুর দিন ‘নাজাত দিবস’ পালন করাকে স্বাগত জানাতাম, এটা নিয়ে পার্টি ভাগ করে ফেলতাম না।

প্রিয়.কম: শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগে ফিরলেন না কেন?
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: আমি যখন আওয়ামীলীগ করি, শেখ হাসিনা আমার কর্মী হিসেবে কাজ করেছে। তার অধীনে আমাকে আওয়ামীলীগের রাজনীতি করতে হবে? আর এখন কে আছে আওয়ামীলীগে, যে প্রকৃত আওয়ামীলীগার? আমির হোসেন আমু আর তোফায়েল হোসেন ছাড়া তো আর কাউকে চোখে পড়ে না আমার। লতিফ সিদ্দিকী ছিল, সে তো আর দল-টল করে না মনে হয়। আর মতিয়া, ইনু? ওরা তো শেখ সাহেব মারা যাওয়ার পর ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে আনন্দ নৃত্য নেচেছিল। মতিয়া মুজিব ভাই এর চামড়া দিয়ে ঢোল বানাতে চেয়েছিল। তারা এখন শেখ সাহেবের মেয়ের মন্ত্রী, আপনজন!

প্রিয়.কম: পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলেন, এক সময় সেটাও ছেড়ে দিলেন? বর্তমানে রয়েছেন বিএনপির রাজনীতির সাথে।
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: এরশাদ সাহেব আমাকে বারবার কথা দিয়েও প্রধানমন্ত্রী করেননি। তিনি নিজের কিছু বিশেষ স্বার্থের জন্য আমার চেয়ে জুনিয়রদের প্রধানমন্ত্রী করেছেন। মওদুদ আমার জুনিয়র, কাজী জাফর আমার জুনিয়র। অথচ বারবার কথা দিয়েও তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেননি। যারা মূল্যায়ন করতে জানেন না, তাদের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করার ইচ্ছে হয়নি বলেই জাতীয়পার্টি ছেড়েছি। এরপরেই বিএনপিতে যোগ দিলাম।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

প্রিয়.কম: বিএনপি কি আপনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়িত করছে? গত কাউন্সিলের সময় দাবী ছিল আপনাকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করার, কিন্তু আপনাকে পুনরায় ভাইস চেয়ারম্যান করেই রাখা হল।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: এ দেশের রাজনীতিতে সঠিক মর্যাদা কেউ পায় না, শেখ সাহেবও পান নাই। যদি পেয়েই থাকতেন তাহলে তো আর তার এই করুণ পরিণতি হতো না।

সম্পাদনা: শামীমা সীমা।