কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত।

হুমায়ূনের নাটকের সাত জনপ্রিয় চরিত্র

রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান
লেখক
প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ২০:১৩
আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ২০:১৩

হুমায়ূন আহমেদ! বাংলাদেশের, বাংলা সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি। তার লেখনিতে জীবন্ত হয়েছে একের পর এক চরিত্র। যার লেখা নাটকের জন্য অপেক্ষা করতো সারাদেশের মানুষ। মনে হতো সারাদেশের মানুষ সেদিন ঘরকুনো। এমনকি তার লেখা সংলাপ হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় কোনো স্লোগান। এমনই শক্তি ছিল তার লেখনিতে। আজও দর্শকরা তার নাটক খুঁজে অন্তর্জালের দুনিয়াতে। হুমায়ূন আহমেদ তাই এ বাংলাতে তার সৃষ্টি দিয়ে অবিনশ্বর। যা কখনো হয়ে গেছে পাশের বাড়ির পরিচিত মুখ, বা গলির মুখের বখাটে, অথবা বাসার সাহায্যকারী হাত। লেখকের ৭০ তম জন্মদিনে আসুন হেঁটে আসি সেই চরিত্রগুলোর মধ্য থেকে সাতটি চরিত্রের হাত ধরে, যে চরিত্রগুলো বাংলা নাটকের দুনিয়াতে অমর এবং একাধারে জনপ্রিয়-

বাকের ভাই

হুমায়ূন আহমেদের লেখা নাটকের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে আসবে বাকের ভাইয়ের নাম। গলির মোড়ের বখাটে, যার চরিত্র অনেকটা শামুকের মতন। খোলসটা শক্ত হলেও মনটা ভীষণ নরম। দুজন অনুসারী তার চির সঙ্গী- বদি আর মজনু। শুধু বাকের ভাই নয়, নাটকের ক্লাইমেক্স আর ঘটনার কারণে বদি আর মজনুও যেন একটা সময়ে শহরের চেনা মুখে পরিণত হয়। হাতে চাবির রিং ঘুরানো বাকের ভাইয়ের প্রিয় গান- ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’ হয়ে উঠে চায়ের দোকানের নিত্য দিনের গান। বাকের ভাইয়ের জেলে ঢোকার পরিণতি কাঁদায়, ভাবায় দেশবাসীকে। এমনকি নাটকের একটি চরিত্রের মৃত্যুর পর কুলখানির দাওয়াতও পান লেখক হুমায়ূন আহমেদ! অথচ এই চরিত্রের কোনও বাস্তব রূপ নেই বা এ চরিত্রটি রক্তমাংসের নয়। চরিত্রটি ছিল হাতে লেখা- যাকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটির মুনা, মতি, বদি, মজনু, কুত্তাওয়ালী- এমন আরও অনেক চরিত্র যেমন বেঁচে থাকবে বহুদিন, তেমনি যতদিন বাংলা নাটকের দর্শক বেঁচে থাকবে, ততদিন বাকের ভাই হয়ে থাকবেন গলির মোড়ের সুপার হিরো।

ফরিদ মামা

দীর্ঘদেহী একজন মানুষ। গোল ফ্রেমের চশমা। নানা ধরনের বিষয় নিয়ে চিন্তিত তিনি। কখনো ইলিশ সমস্যা নিয়ে ভাবছেন, কখনো গৃহকর্মীর অযাচিত কর্মকাণ্ডে মহা বিরক্ত তিনি। নাটকে যিনি পরিচিত ফরিদ মামা হিসেবেই। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের এই মামার কাজের ফিরিস্তি যেমনই হোক, তার চরিত্র ছিল একজন স্পষ্টভাষীর চরিত্র। হয়তো লেখক ইচ্ছে করেই এই চরিত্রকে একটু পাগলাটে করে রেখেছিলেন। তা না হলে স্বৈরাচার সরকারের আমলে হালকা রসে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু সংলাপ তাকে দিয়ে বলিয়ে ফেলাটা দুষ্করই হতো। তার কিছু সংলাপ এখনও সবার মুখে মুখে ফেরে যেমন- ‘কথার মধ্যে কথা বলা, আমি একদম পছন্দ করি না দুলাভাই’, ‘আপনি প্রতিভা চিনতে পারলেন না', ‘বেশী কথা বলা আমি পছন্দ করি না, ‘পাবলিকের মুখ তো আর বন্ধ করা যাবে না’ ইত্যাদি। তবে এরমধ্যে যে ডায়ালগটা জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়, তা হলো ‘তুই রাজাকার’। বিশেষ করে এ সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারর উষালগ্নে এই শ্লোগানের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। এই চরিত্রে আলী যাকেরের অসাধারণ অভিনয় তাকে আজও পাগলাটে ও প্রতিবাদী মামা হিসেবে সবার মনে গেঁথে রেখেছে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেও ছিলেন যে, মঞ্চে একটি ভাবগম্ভীর চরিত্রে অভিনয় করার সময়- যখন সারা হলে পিনপতন নীরবতা, তখন কোনও এক জায়গা থেকে কেউ একজন বলে উঠেন ‘মামা’! আর অমনি সারা হল ফেটে পরে অট্টহাসিতে!

নান্দাইলের ইউনুস

নাটকের নাম ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে’। চরিত্রের নাম ইউনূস। নান্দাইলের ইউনূস। গ্রামগঞ্জের রহস্যময় চরিত্রের এক লোক। মাথায় হনুমান টুপি। গলায় মাফলার। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন তিনি কে? গম্ভীরমুখে ইউনূস উত্তর দেন- ‘আমি কেউ না’। এই নান্দাইলের ইউনূস হলো পেশাদার খুনি, যে একটি গ্রামে যায় খুনের জন্য। কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে খুন করতে চলে আসে আরেকটা গ্রামে। চুপচাপ, শান্ত অথচ খুনির এই চরিত্রটি আজও গেঁথে আছে দর্শকের মাথায়। এমনকি আজও অনেকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়ের জায়গায় লেখা থাকে- ‘নান্দাইলের ইউনূস’। কারণ এই চরিত্রের রহস্য আর কিছুটা মানবিকতা, সে সময় দর্শকদের নাড়া দিয়েছিল ভীষণভাবে। তার একটি বিখ্যাত ডায়ালগও ছিল- 'অসুন্দর হয় মানুষ'। এ নাটকে ইউনূস চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। বাকের ভাই বা মীর্জার পাশাপাশি আজও তিনি হয়ে আছেন নান্দাইলের ইউনূস।

এলাচী

সাদা চোখের জমিদার পত্নী, যার চরিত্র অনেকটা পানির মতন। মনে হয় সহজ সরল, কিন্তু প্রয়োজনে কখনো কঠিন, কখনো বাষ্প, কখনো আবার বায়বীয়। ‘অয়োময়’ নাটকের শক্তিশালী চরিত্র মির্জার মেজো পত্মী তিনি। নিজের জায়গাটা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বড় বউ (লাকী এনাম) কে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন তিনি। নিজের বোনের সাথে স্বামীর ঘনিষ্টতা এড়াতে কূটকৌশলে পরাস্ত হন। শেষ অবধি ছোটবোন লবঙ্গের সাথে স্বামীর সংসার দেখে মনে মনে পুড়ে গেলেও চেহারার কাঠিন্য বজায় রাখে সব সময়। এমনকি যে কাশেম (আবুল হায়াত) এর জন্য একবার তিনি চিকিৎসা করাতে ডাক্তার পাঠিয়েছিলেন, তাকে প্রয়োজনে খুন করার নির্দেশও দেন এলাচী। সারা যাকের অভিনয় করে এই চরিত্রকে করে তুলেছিলের জীবন্ত। আজও সারার চোখে এলাচীকে খুঁজে পান দর্শক। অথচ এই চরিত্রে সারাকে মানাবে কিনা, এক সময়ে এ ধরণের ভাবনার অন্ত ছিল না নাটক সংশ্লিষ্টদের। অথচ আজ এলাচী মানেই সারা আর সারা মানেই এলাচী।

খাদক

একজন মানুষের কাজ আস্ত গরু খেয়ে ফেলা। আর তাকে দেখতে ভিড় করে সারা গাঁয়ের মানুষ। কখনো কখনো পাশের গ্রামের মানুষও চলে আসে। তাকিয়ে তাকিয়ে তারা গরু খাওয়ার শুরু আর শেষ দেখে। বিনিময়ে পায় কিছু উপহার, খাওয়া তো বটেই। আর হয়তো সামান্য টাকা। বেঁচে থাকার জন্য এ এক অদ্ভুদ পেশা। নাম খাদক। নাটকের নামও তাই। প্রফেসর মোজাম্মেল হক অভিনয় করেছিলেন এই চরিত্রে। যখন এই চরিত্র নিয়ে গাঁয়ের সবাই হাসাহাসি করে তখন বেমালুম ভুলে যায় লোকটির স্বাস্থের কথা। কেউ জানতে চায় না তার পারিবারিক অবস্থার কথা। বা দুঃখ বেদনা। সে এক অন্যরকম বিনোদনের খেলাতে মেতে উঠা মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা এই খাদকের গল্প নিয়ে আজও দর্শকের মনে বেঁচে আছেন এ অভিনেতা। আর ভিন্ন ধরনের চরিত্র লেখে মাথায় গেঁথে আছেন লেখক হুমায়ূন।

আনিস

একজন মোটা চশমা পড়া মেধাবী ছাত্র । এসএসসি ও এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা ছেলে। তবে হলে সিট পাননি বলে একটি পরিবারে পেয়িং গেস্টের মতোই থাকেন তিনি। ঐ পরিবারেরই দুই কন্যা কংকা ও তিতলির ভালোবাসাকে আনিস বুঝে না। সে তাদের কংকা ভাইয়া, তিতলী ভাইয়া বলে সম্বোধন করে। অবসরে ক্যাসেট বাজিয়ে পড়া মুখস্ত করে আনিস, যেন তার জীবনটাই পড়ালেখা। প্লাস্টিকের সাপ দেখে আধমরা আনিসকে নিয়ে দুইবোনের মানবিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়, আর আনিসের উপেক্ষা একটা সময় প্রধান দুই চরিত্রকেও ছাপিয়ে যায়। সূবর্ণা মুস্তাফা, আবুল হায়াতের পাশাপাশি জাহিদ হাসান ওরফে আনিস হয়ে উঠে পড়ালেখা পাগল প্রিয় চরিত্র। ‘আজ রবিবার’ নাটকের আনিস যেন আজও লুকিয়ে আছে পাশের বাড়িতে। যেন প্রতিটি সহজ সরল ছেলের চেহারাতেই খুঁজে পাওয়া যায় আনিসরূপী জাহিদের চেহারা।

রহিমার মা

গৃহকর্মীদের রোল মডেল হলেন এই রহিমার মা। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের অন্যতম চরিত্র তিনি, যার কারণে নাটকটি ছিল অনেক বেশি প্রাণবন্ত। বাড়ির সদস্যই যদি হন গৃহকর্মীরা, তবে কেন প্রয়োজনে অন্যান্য সদস্যদের মতন চশমা পড়তে পারবেন না, বা নিজের মন্তব্য সামনে রাখতে পারবেন না তিনি- এমন ঘটনাকে হাস্যরস দিয়ে সামনে তুলে আনা হয়েছে রহিমার মা চরিত্রের মাধ্যমে। এমন কী সহজ সরল ডাক্তারকে দিয়ে সালাম করানোর মাধ্যমেও লেখক প্রমাণ করেন, আসলে সাধারণ মানুষ সবসময় দেখে বাহ্যিকতা। একজন গৃহকর্মী চশমা পড়তে পারেন, বা নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারেন- এমনটাই ভাবতেই পারেননি ডাক্তার। হয়তো তিনি একটু নার্ভাসও ছিলেন। কিন্তু রহিমার মায়ের মাধ্যমে সামাজিক টানাপোড়েন সামনে এনে লেখক যুগের পর যুগ ধরে দর্শকের মনে রহিমার মাকে জীবন্ত করে রেখেছেন। আর তাই আজও মাহমুদা খাতুন অমর রহিমার মায়ের চরিত্রে। আর মনে গেঁথে আছে সেই ডায়ালগ- ‘জীবনে সাধ আহ্লাদ আছে না আম্মা?’

প্রিয় বিনোদন/গোরা