কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নিজেকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিরক্ত হয়ে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিনেত্রী অপর্ণা ঘোষ।

আত্মসমালোচনা বা আত্মালোচনা: ‘কী কী অযোগ্যতা থাকলে হাতুড়ে সাংবাদিক হওয়া যায়?’

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:৫৮
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:৫৮

‘কী কী অযোগ্যতা থাকলে হাতুড়ে সাংবাদিক হওয়া যায়?’ না আমার নয়, একজন অভিনেত্রীর প্রশ্ন এটি। একটি জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল খবর করেছে ‘সাংবাদিকতা আর মলম বিক্রি গুলিয়ে ফেলবেন না : অপর্না’ এমন শিরোনামে। খবরটি পড়তে গিয়েই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের নিয়ে, বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকদের বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি এমনটা বলেছিলেন, ‘মফস্বলে এখন আর সাংবাদিকতা নেই। দুই লাইন শুদ্ধ বাংলা লিখতে না পেরেও সেখানে কেউ কেউ সাংবাদিক।’ তার মতো একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এ কথা বলেছেন এবং যে কথার সত্যতা নিয়ে জোরালো কোনো প্রশ্নের উৎপত্তিও চোখে পড়েনি। সুতরাং কথাটার পুরোটা হয়তো মিথ্যেও নয়।

ওবায়দুল কাদের দেশের একটি প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদক, দলটি ক্ষমতায় এবং তিনি মন্ত্রী, না বুঝেই তিনি গণমাধ্যম সম্পর্কে এত বড় একটি মন্তব্য করবেন না, এটা আমরা অনিচ্ছাতেও মেনে নিতে পারি। কিন্তু সাংবাদিকতার অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজন অভিনেত্রীও সাংবাদিক এমন কী সম্পাদক সম্পর্কেও মন্তব্য করেন এবং সঙ্গতভাবেই সেটা নেতিবাচক। আর সেই নেতিবাচক মন্তব্য নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয় এবং সেই সংবাদের শেষে মন্তব্যে পাঠকরা তা সমর্থনও করেন! অবস্থাটা বুঝুন, সাংবাদিক আর সাংবাদিকতা দাঁড়িয়েছে কোথায়! 

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অবস্থা নিয়ে শংকার কথা অনেকেই বলেছেন, আমিও বলেছি। প্রীতিকর সাংবাদিকতা ছেড়ে ভীতিকর সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল একদল মানুষ। মানুষ সাংবাদিকদের বলা শুরু করেছিল ‘সাংঘাতিক’, সেই বলার গতি এখনও রুদ্ধ হয়নি। পুরানো কথা বলতে চাই না, কেন এবং কী কারণে সাংবাদিকরা ‘সাংঘাতিক’ হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা সবারই জানা। শুধু বলি, জীবনযাপনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যে শ্রম দেওয়া হয় সেটাই ‘পেশা’। সুতরাং পেশাদার হতে হলে শ্রমের মূল্য পাওয়া প্রয়োজন। ‘কোয়ালিটি’র সাথে ‘অর্থে’র সম্পর্ক বরাবরের। সুতরাং ‘কোয়ালিটি’ চাইলে পারিশ্রমিক দিতে হবে। কিন্তু আমাদের অনেক মিডিয়া কর্তারাই, ‘কোয়ালিটি’ নয় ‘কোয়ান্টিটি’ চান। ফলে ‘পারিশ্রমিক’ না পাওয়া পেশায় পেশাদার হওয়া কখনোই সম্ভব নয়, যেটা সম্ভব তা হলো ‘সাংঘাতিক’ হওয়া। 

এক্ষেত্রে যারা পেশাদার অর্থাৎ যাদের ‘সেলারি’ ‘হ্যান্ডসাম’। তাদের অবস্থা কী? তারাও কী ‘কোয়ালিটি’ চর্চা করেন? তাদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন অভিনেত্রী অপর্ণা ঘোষ। নাটকের চরিত্রের মৃত্যুকে সরাসরি তার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু গণমাধ্যমে। এসব মাধ্যমের শিরোনাম ছিল, ‘জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপর্ণা ঘোষ নিহত’। কী ভয়াবহ সাংবাদিকতা! এখানে সাংবাদিকতা তো দূরের কথা ন্যুনতম কমনসেন্সের প্রয়োগ নেই। যদি থাকত, তাহলে বুঝতো, এমন শিরোনামের ধাক্কা আপনজনের বুকে কতটুকু লাগে।

আধুনিক সাংবাদিকতায় চেষ্টা চলে শিরোনামেই খবরের মূলকথাটি সম্পর্কে ধারণা দিতে। ভূমিকায় সংক্ষেপে ঘটনাটির প্রায় সম্পূর্ণ ধারণাই দেওয়া হয়। ভূমিকার পরে বলা হয় বিস্তারিত। কারণটা এমন, ব্যস্ত মানুষ যেন শিরোনামেই একটি ধারণা নিয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারেন, আরেকটু সময় পেলে ভূমিকাতেই অনুভব করতে পারেন ঘটনাটির বিষয়ে। পরবর্তীতে সময় হলে মাথায় রাখা ধারণাটির বিস্তারিত যেন পড়ে নেন, এমনটাই সাংবাদিকতা এবং সম্পাদনার কাজ। কিন্তু শিরোনাম যদি হয় ‘অমুক নিহত’ তাহলে তো বিষয় ভয়াবহ।

মৃত্যু কোনো ‘ফান’ করার বিষয় নয়। পৃথিবীতে সকল ‘সিরিয়াস’ বিষয়ের সর্বাগ্রে ‘মৃত্যু’। মৃত্যুর খবরে যারা ‘রম্যতা’ নিয়ে আসেন, তাদের বুদ্ধির ‘দীনতা’ সেই শিরোনামের মতোই প্রকাশ্য। মৃত্যু নিয়ে রম্যের ধারণা আর যাই হোক, একজন ‘এথিকস’ মানা সাংবাদিকের মস্তিষ্কজাত হতে পারে না। 

‘প্রগলভতা’ আর সাংবাদিকতা যে এক জিনিস নয়, তা আমাদের অনেক ‘বড়’ সাংবাদিকরাই বুঝতে পারেন না। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘কার সাথে পর্দায় যেতে হয়, কার সাথে শয্যায় যেতে হয়’ এমন পার্থক্যের কথা। সাংবাদিকতাতেও কখন সিরিয়াস হতে হয়, কখন প্রগলভতা- তা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। যারা সাংবাদিকতার সর্বাগ্রে আছেন, যারা লিডিং, তাদের জন্য এর চর্চা আরও বেশি জরুরি। কারণ তাদের কাছ থেকেই নিচের সারিতে বা সিঁড়িতে যারা আছেন, তারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। না হলে যারা শিখতে চান, তারা ‘যদ্যপি গুরু’র মতোই গুরুজনের অনুগমন করবেন। শব্দটা ‘অনুগমন’ না বলে হয়তো ‘সহগমন’ বললে ভালো হতো, অন্তত তার সাথে ‘সহমরণে’র একটি মিল পাওয়া যেতো। কারণ এমন গুরুর সাথে বা পথে ‘গমন’ সেই শিরোনামের মতো ‘মরণে’রই নামান্তর। 

পুনশ্চ: ‘তেমনসব’ সাংবাদিক বিষয়ে ‘সাংঘাতিক’ শব্দটা বহুল প্রচলিত কিন্তু তেমনতর সম্পাদকদের ক্ষেত্রে কিছু প্রচলিত হয়নি কেন! সাংবাদিকদের দায়িত্ব লেখা, সংশোধন ও প্রকাশের দায়িত্ব সম্পাদকের, মূল দায়িত্বে তিনিই। তবে সাংবাদিকরাই কেন অপমানের ভাগী হবেন, ভাগ নিতে হবে সম্পাদকদেরও। ভেবে-চিন্তে আমি আর প্রবাসের খ্যাতনামা সাংবাদিক, বিশ্লেষক মাসকাওয়াথ আহসান বের করলাম, ‘সবখাদক’ শব্দটি। বর্তমানের সাথে এটা যায় তো, না কী যায় না?

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]