কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নাইজেল লং ও নাসির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

রিপোর্টার্স ডায়েরিঃ বিউটি অব চট্টগ্রাম টেস্ট

সামিউল ইসলাম শোভন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:২৮
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:২৮

(প্রিয়.কম, চট্টগ্রাম থেকে) ছোটবেলায় এক ডিটারজেন্ট পাউডারের বিজ্ঞাপনে সাদা পরী দেখেছিলাম। পিঠে পাখনা, হাতে জাদুর কাঠি। চাইলেই অপরিস্কার সব কাপড় পরিস্কার ও সফেদ করে দিচ্ছিল। খুব ডানপিটে আর শুভ্র। দূর থেকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাপারটাও অনেকখানি সেরকম। টিভির পর্দায় এ জিনিসের শানে নুযূল বুঝতে চাওয়া মুর্খতা। সাদা পোশাকের ক্রিকেটারগুলো যখন মাঠে খেলছিল, প্রত্যেককে অপ্সরীর মতো মনে হয়েছে। দূর্ভাগ্য, অপ্সরীরা পুরুষ হয় না।

সাগরপাড়ের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে প্রথম দিনে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া দল যখন মাঠে নামছে, তখনকার অনুভূতি অনেকটা এমনই। সফেদ পোশাকের মুশফিকবাহিনী কিংবা স্মিথবাহিনী যেন ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত্য, মাধুর্য। এই পুঁজিবাদের যুগে ক্রিকেটের বাজারদর বেড়েছে বটে, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের আবেদন কমেছে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে চার-ছয়ের বাড়াবাড়ির পাশাপাশি অর্থের ঝনঝনানি আছে, অভাবটা ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যের। বাজারের মূল্যে সেটা থেকে পিছিয়ে থাকলেও, সত্যিকারের ক্রিকেট কি তা এখনও টেস্টেই টের পাওয়া যায়। অনেকটা সেই প্রবাদ বাক্যের মতো, ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা’।

আপনি যদি টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখেন কিংবা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেন, তাহলে দু’রকম অনুভূতি মিলবে। কিন্তু প্রেসবক্স থেকে দেখার অনুভূতিটা একেবারেই আলাদা। এখানে যারা বসে সবাইকে ক্রিকেট দেখতে নয়, লিখতে বা ক্রিকেট বলতে পারতে হয়। কিন্তু এই জ্ঞানগর্ভ লেখালিখি সমালোচনার বাইরে গিয়ে যদি একটুখানি চোখ মেলে তাকানো যায়, সামনের সুবিস্তৃত মাঠের দিকে, যদি একেবারে বৃত্তের বাইরে থেকে চিন্তা করা যায়, তাহলে ভাল কিংবা খারাপ খেলার ব্যাপারটার চেয়ে খেলার অাভিজাত্যটা খুব করে টের পাওয়া যায়। বলা হয়, পাঁচদিনের টেস্ট ম্যাচ নাকি ক্রিকেটের যাবতীয় আইন থেকে শুরু করে ক্রিকেটীয় অলংকার, সবকিছুই দর্শনের কারণ হয়।

জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গেল চার সেপ্টেম্বর থেকে সাত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার অনেকখানি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিভাবে একটা ধসে যাওয়া ব্যাটিং লাইনআপকে খুঁটি দিলেন মুশফিকুর রহিম-সাব্বির রহমান। কিংবা শেষ বিকেলে নাসির হোসেনের গাঁথুনিটা কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছিল। অন্যদিকে, নাথান লায়নের বলে কিভাবে কুপোকাত হচ্ছিল বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা; সবকিছু।

মুস্তাাফিজুর রহমান ও ডেভিড ওয়ার্নার। ছবি: প্রিয়.কম

অনেকটা সুস্বাদু খাবার শেষ করার পরও হাত চেটে খাওয়ার মতো এই টেস্টে পারফরম্যান্স ছিল অজি ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও বাংলাদেশের বাঁ-হাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের নাথান লায়ন বরাবরই উপমহাদেশে সফল। তিনি খুব ভাল করবেন তা জানা কথা। কিন্তু ঢাকা টেস্টের পর চট্টগ্রামেও সেঞ্চুরি হাঁকালেন ওয়ার্নার। উপমহাদেশের রান খরা কাটানোর শপথ নিয়ে বাংলাদেশে আসা ওপেনার কাজটা করতে সফল হয়েছেন। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছেন ১২৩ রান। তার সঙ্গে এই টেস্টে মুস্তাফিজের গাঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সেটি হল, দুই ইনিংসেই মুস্তাফিজের বাউন্সারে সাজঘরের পথ ধরেছেন ওয়ার্নার।

সাম্প্রতিক সময়ে নিজের সহজাত পারফর‍ম্যান্স করতে না পেরে চাপে ছিলেন মুস্তাফিজ। বয়সে তরুণ সঙ্গে কম অভিজ্ঞতা নিয়ে এই চাপ সামলানোর অভ্যেস এখনও হয়নি তার। সঙ্গে অজিদের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে উইকেটশূন্য থাকার ঘটনা হয়তো আরও বিপাকে ফেলেছিল তাকে। দলের পেস আক্রমণের অন্যতম সেরা এই অস্ত্র এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রথম ইনিংসে চার উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে আরও একটি উইকেট। পুরনো শক্তির সেই কাটার দিয়ে যেভাবে ম্যাট রেনশ-ওয়ার্নারদের ফাঁদে ফেলছিলেন, তা চোখে লেগে ছিল অনেক সময়। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট আমূল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝা যায় এসব ছোট ছোট ব্যাপারগুলো দিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, ১১ বছর আগে রিকি পন্টিংদের বিপক্ষে খেলতে নেমে হাবিবুল বাশার সুমন-শাহাদাত হোসেনদের মধ্যে যে জড়টা ছিল, তা এবার অনুপস্থিত। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও পরিণত এই বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়েছে সমানতালে। তবে বড়রা প্রেসবক্সে বসেই বলছিলেন, এই ম্যাচে নাকি খারাপ খেলেছে অস্ট্রেলিয়া, তার চেয়েও খারাপ খেলেছে বাংলাদেশ। 

 

প্রেসবক্স থেকে গ্যালারির দুপাশ পুরোটা দেখা যায়। দলের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার পারদ হয়ে সমর্থকদের উত্তেজনাও ওঠানামা করছিল। নাথান লায়নের একের পর এক আঘাতে যখন দিশেহারা তামিম-সৌম্যরা, তখন বাংলাদেশের কেউ যদি একটা ভালো শট খেলছিল কিংবা একটা চার হচ্ছিল, গ্যালারিতে উল্লাসের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। এমনও হয়েছে, প্রথম ইনিংসে যখন বাংলাদেশের প্রথম চার ব্যাটসম্যান লায়নের বলে এলবিডব্লিউয়ের কবলে পড়ল, গ্যালারি ফাঁকা হতে থাকল। পরে যখন বড় জুটির পথে হাঁটলেন সাব্বির-মুশফিক, তখন আসনগুলো দ্রুত ভরছিল তা খালি চোখেই টের পাওয়া গেল!

মুস্তাফিজের মুখে কিছুটা হাসি থাকলেও প্রথম ইনিংসের পর এমন হতাশাতেই সময় কেটেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। ছবি: প্রিয়.কম

বাংলাদেশের সাত উইকেটের এই হারের ম্যাচে, জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়াম নতুনভাবে সেজেছিল। মজার ব্যাপার হল, স্টেডিয়ামের ছাদে উঠলে দূরে সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে  নোঙ্গর ফেলা বিশালাকৃতির সব জাহাজগুলোর দাঁড়িয়ে থাকা দেখে টেস্ট ক্রিকেটের ধীরগতির কথা মনে হয়। এসব দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে কখনও চোখ ঘুরাতে গিয়ে চোখে পরতে পারে কিম্ভুতকিমাকার কোন ব্যক্তিদের। শুরুতে ভয় পেতে পারেন, খেয়াল করলে দেখবেন, খুব আড়ালে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি আসলে একজন স্নাইপার। ম্যাচে যেন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, তা সামলাতে বিশাল অস্ত্র নিয়ে গোপনে পাখির চোখে নজর রাখছে।

প্রথমদিনের খেলা শেষে ঘটে গেলো নতুন ঘটনা। হোটেলে ফেরার পথে, অজি টিম বাসে কে বা কারা ঢিল ছুড়েছে, তাতে ভেঙে গেছে বাসের জানালার কাচ। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগেই দুপক্ষ থেকে মিটিং, তদন্ত কমিটি করে এলাহী কাণ্ড। ততক্ষণে রাতের মধ্যেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ান গণমাধ্যমে ফলাও করে খবরও ছাপা হয়। পরে তদন্তে বের হয়ে আসে, অজি টিম বাসের জানালার একটা অংশ ভেঙেছিল কোন এক শিশুর অনিচ্ছাকৃত ছোঁড়া ঢিলে! সবশেষে মনে হতেই পারে, এ যেন মশা মারতে কামান দাগার মতো অবস্থা!

চট্টগ্রাম টেস্ট হয়তো জয় দিতে পারেনি, কিন্তু যে অভিজ্ঞতা দিয়েছে, যে ভালোবাসা দিয়েছে কিংবা ক্রিকেট জ্ঞানের নতুন সংযুক্তি ঘটিয়েছে তা অমূল্য। তিন ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকে এটুকু বুঝতে কষ্ট হয়নি, টেস্ট ক্রিকেটের আবেদন ফেরানো সময়ের ব্যাপার। দুনিয়াব্যাপী ক্রিকেট ছড়িয়ে দিতে এই টেস্ট ফরম্যাটই হতে পারে ক্রিকেটের পোস্টার ও অ্যাম্বাসেডর।

প্রিয় স্পোর্টস/ শান্ত মাহমুদ