অভিনেতা তারিক আনাম খান। ছবি: সংগৃহীত
আজিমপুর থেকে বেইলী রোড পর্যন্ত হেঁটে রিহার্সেলে গিয়েছি: তারিক আনাম
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৯:১৭
(প্রিয়.কম) কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। বিনোদন জগতে বর্তমানে যারা প্রকৃত অর্থেই কেষ্ট অর্জন করেছেন, সেটি কিন্তু আপোষে ধরা দেয়নি। কোনো মহেন্দ্রক্ষণ কিংবা আলাদিনের প্রদীপ পাননি তারা। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই তৈরি করতে হয়েছে নিজের অবস্থান। কিন্তু কে রাখে সেই খবর! ঝিলিমিলি পর্দায় আমরা একজন ব্যক্তির অভিনয় সত্তাকেই দেখে থাকি। ভালো হলে তালি বাজাই, মন্দ হলে নাক সিটকে খিস্তিপাঠ করতেও বাদ রাখি না। কিন্তু আমরা কী জানি- আজ যে ক’জন অভিনয়শিল্পীর নামের পূর্বে প্রথিতযশা, কীর্তিমান কিংবা দিকপাল শব্দগুলো ব্যবহার করছি, তারা এক লাফে এ পর্যায়ে আসেননি। পারিবারিক অসম্মতি, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, সামাজিক বাধাসহ আরও কত যে বাধা পাড় হয়ে তারা আজকের এ পর্যায়ে এসেছেন, সেই ফিরিস্তি কেবল তারাই জানেন। সেই কাহিনি সংরক্ষিত আছে কেবল তাদের মনের গোপন কুঠুরিতে। ফেলে আসা দিন এবং জীবনের শুরুতে তারকাদের কষ্ট-ক্লেশের ঘটনা শুনতে প্রিয়.কম-এর বিশেষ আয়োজন ‘স্ট্রাগল’।
প্রিয় স্ট্রাগলের আজকের তারকা তারিক আনাম খান। তার নাট্যজীবনের প্রারম্ভিক বিষয়াদি, চেষ্টা, কষ্ট প্রভৃতি বিষয়ে আজ প্রিয়.কম-এর সঙ্গে কথা হয় তার। উঠে আসে তার বিষয়ে অজানা অনেক তথ্যাদি। ছোটবেলা থেকেই নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রতি ব্যাকুল ছিলেন তারিক আনাম। শখ ও আগ্রহের কমতি ছিল না বিন্দুমাত্র। একটা সময় এটিই হয়ে ওঠে তার পেশা। তবে শখটিই যে পেশা হয়ে উঠবে, শুরুতে এমনটি ভাবেননি তারিক আনাম খান।
তার এ শখটি পেশা হয়ে ওঠার মাঝখানের সোপানগুলো ছিল বেশ বন্ধুর। ১৯৯০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নাট্যকেন্দ্র’ নামের একটি নাট্যদল। তারও অনেক পূর্বে থেকেই নাট্যাঙ্গনে আনাগোনা ছিল তার। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেও। তখন নাটককে পেশা হিসেবে নেওয়া অনেক কঠিন বিষয় ছিল। নাট্যজীবনের প্রারম্ভের কথাগুলো এভাবেই ব্যক্ত করছিলেন প্রিয়.কম-এর কাছে। বলছিলেন, ‘এটিকে পেশা হিসেবে বিবেচনা করা খুব কঠিন ছিল। টিভি নাটক তো চালু হয়েছে অনেক পরে ১৯৬৫ সালের দিকে। তখন অবশ্য ফিল্মকে পেশা হিসেবে নেওয়া যেত। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বড় ছেলে। পড়াশোনায়ও ছিলাম ভালো। রোল এক, দুই কিংবা তিনের মধ্যেই থাকত। তখনকার বাবা-মায়েদের এবং ছাত্রদের লক্ষ্য থাকত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া।’
অভিনেতা তারিক আনাম খান। ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধের সময় অভিনেতা তারিক আনাম খানসহ আরও অনেক অভিনয়শিল্পীরা ছুটে যেতেন মুক্তি ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে তারা নাটক করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। পরিশেষে দেশ স্বাধীন হলো। তখন পরিস্থিতিটা একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করে তারিক আনাম প্রিয়.কম-কে বললেন, ‘এরপর যখন দেশ স্বাধীন হলো, নাটক সিরিয়াসলি টার্ন করল। মানুষের ভেতর নাটকের প্রতি আগ্রহ জন্মাল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হয়ে গেল, একটু টালমাটাল হয়ে গেল আরকি। মধ্যবিত্তের স্ট্রাগল বৃদ্ধি পেল। আমার পড়াশোনা করার খরচ নির্বাহ করা মুশকিল হয়ে গেল। যার ফলে নরমাল গ্র্যাজুয়েশন করলাম। তারপর মনে হলো, নাটককে যেহেতু ভালোবাসি, সেটিকে একটু সিরিয়াসলি নিই না কেন!’
তারপর হঠাৎ স্কলারশিপ দেওয়া শুরু হলো। কথায় কথায় আমাকে একজন বললেন, তুমি তো নাটক থিয়েটার করো, তুমি স্কুল অব ড্রামায় যাও না কেন? ওখানে তো অনেক ভালো। তখন আমি সেখানে গেলাম এবং যাওয়ার পরই ব্যাপারটা ঘুরে গেল। দেখলাম থিয়েটার একটা ভাস্ট ক্যানভাস, সিরিয়াস জিনিস। মানে- নাটক বিষয়ে একটা চ্যালেঞ্জ নিতে অনেক সাহস পেলাম। কারণ- তখন আমি জানি নাটক বিষয়ে। তিন বছর পরিশ্রম করার পর, আমার ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো।’
তবে এর পরপরই আবার স্ট্রাগলের মুখে পড়তে হয়েছিল তারিক আনাম খানকে। চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করবেন, নাকি অভিনয় করবেন- সেই দোটানায় পড়েছিলেন তিনি। তবে অভিনয়ই করার প্রতিই ঝোঁক ছিল তার। খ্যাতিমান এ অভিনেতার ভাষ্য, ‘আসলে অভিনয়টা তো আমি নিজেও করতে চাইতাম। তবে চলচ্চিত্রের সেই সময়কার অবস্থার মধ্যেও আমি জড়াতে রাজি ছিলাম না। কারণ আমরা একটু অন্য ধরনের চলচ্চিত্র, অন্য ভাবনাযুক্ত অভিনয়- এসব বিষয়াদির মধ্যে বড় হয়েছি। তারপর কিছু অফ-ট্র্যাকের ছবিতে কাজ করলাম। ‘সুরুজ মিয়া’, ‘ঘুড্ডি’, ‘লাল সবুজের পালা’ ইত্যাদি।
ব্যতিক্রমী ঘরানার ছবিগুলোকে তখন মেইনস্ট্রিম মুভি বলা হতো। হিরো ও ভিলেনের কনসেপ্ট ছিল একটু ভিন্ন ধাঁচের। তবে সেসময় কিছুটা অনাগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন তারিক আনাম। অনাগ্রহের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তারিক আনাম প্রিয়.কম-কে বলেন, ‘আমি খুব আগ্রহী হলাম না। ভাবলাম যে- চাকরিই করি। কেননা প্রাইভেট টেলিভিশন ছিল না, ছিল কেবল শিল্পকলা একাডেমী।’
কিন্তু অভিনয় বাদ দিয়ে চাকুরে হতে পারেননি তিনি। থিয়েটারে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু বারবারই অকৃতকার্য হচ্ছিলেন। সেসময় তাকে অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিল। স্মৃতিচারণ করে তারিক আনাম প্রিয়.কম-কে বলেন, ‘আমি অভিনয় করবই- এই ভাবনা থেকে আমি আমার রিহার্সেলের জায়গাতে, আজিমপুর থেকে বেইলী রোডের মহিলা সমিতি পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছি। এটা আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। তখন আজিমপুর থাকতাম। বাস সরাসরি যেত না। ওখান থেকে যেতাম গুলিস্তান, গুলিস্তান থেকে বাস বদলে রামপুরা বা শান্তিনগর মোড়ে নেমে সেখান থেকে থেকে মহিলা সমিতির ওখানে যেতাম। এ রকম আরও অনেক অর্থনৈতিক অনেক কষ্ট গেছে। ভয়ংকর কষ্ট। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় নয়। এর জন্য কখনোই নিজেকে ছোট মনে হয়নি। অর্থকে কখনোই মূল মনে করিনি, এখনও করি না।’
কীভাবে দূর করলেন অর্থনৈতিক সমস্যা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তারিক আনাম প্রিয়.কম-কে বলেন, ‘টেলিভিশন নিয়ে চলা শুরু করলাম, বেশ কিছু টিভি নাটক করলাম। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করা শুরু করলাম, মানে অর্থ উপার্জন শুরু করলাম আরকি। তারপর ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপনে জড়ালাম। এটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পর থিয়েটারের করার জন্য সময় বের করতে পারলাম। তখন নাটকও করা গেল।’
এ তো গেল তার নিজের অর্থনৈতিক সংগ্রাম। পরিবার থেকে নাটক-থিয়েটার করার বিষয়ে কোনো বাধা আসেনি? জবাবে তিনি বলেন, ‘ভয়ংকর পারিবারিক চাপ ছিল। আমি তো পরিবারের বড় সন্তান, আবার ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিলাম। ফলে সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার একটা বিষয় ছিল আমার ওপর। কিন্তু আমি ছিলাম অভিনয়ে আগ্রহী। তাই পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। বাবা যখন দেখলেন যে আমি নাটকে মনোনিবেশ করেছি, তখন ভাইবোনদের ডেকে বললেন, ওকে একটু নজরে রাখিস। এ বিষয়ে আমি অনেক শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমি আমার বাবাকে এখন মিস করি। কেননা আমি এখন দর্শকের কাছ থেকে যতটুকু ভালোবাসা পাচ্ছি, সেটি তো বাবা দেখে যেতে পারেননি।’
‘আসলে নাটক করেও কিছু হওয়া যায়। আমি মনে করি যে, যে যাই বলুক- কেউ যদি অভিনয় বিষয়ে সিরিয়াস হয়, অ্যাফোর্ড দেয়, তাহলে অভিনয় করেও কিছু করা সম্ভব। এখন তো মিডিয়া আরও ফাস্ট হয়েছে। আমাদের সময় তো এটাকে সেভাবে গ্রহণ করা হতো না। এখন তো রূপটাই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কেউ চাকরি করতে আর কত টাকা উপার্জন করতে পারে! কিন্তু কেউ যদি মিডিয়ায় লেগে থাকে এবং ভালো কাজ করে, তাহলে অভিনয় করেও অনেক সাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তবে কাজটি ভালো জানতে হবে, কাজ ভালো জানাই হচ্ছে বড় কথা। এছাড়াও পরিশ্রমী হতে হবে। নিজেকে বুঝতে হবে। আমাদের সময় অভিনয় করে উপার্জন করা অনেক কঠিন ছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধুমাত্র প্রবল পরিশ্রম, ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার ওপর ভর করে এ পর্যন্ত আসা।’
অভিনেতা তারিক আনাম খান। ছবি: সংগৃহীত
অভিনয় অঙ্গনে আসার উদ্দেশ্যে কারো দুয়ারে ধর্না ধরতে হয়নি তারিক আনামকে। এ প্রসঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি প্রিয়.কম-কে বলেন, ‘আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখন আমার একজন সিনিয়ার আমাকে বলেছিলেন- কেউ যদি বলে আমাকে একটি সিনেমায় সুযোগ দিন, তার দ্বারা কোনোদিন অভিনয় সম্ভব না। যে বলে আমি অভিনয় করতে চাই, আমি এটিকে ভালোবাসি এবং আমি পরিশ্রম করতে রাজি আছি, তার দ্বারা সম্ভব।’
জীবনের শুরুতে আনাড়ি অবস্থায় অভিনয় করে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে কখনো নন্দিত বা নিন্দিত হয়েছেন কী? একটু হেসে তারিক আনাম বললেন, ‘প্রথম দিকে যা হয়েছিল, ছেলেটি পারে না কিছু- এ ধরনের কথা আমি কোনোদিন শুনিনি। ভালো পারে। তবে আমার মধ্যে কিছু জড়তা ছিল। যখন সিনেমা করা শুরু করলাম, গানে কাজ করলাম, তখন কিছুটা জড়তা কাজ করেছিল। তবে আমার প্রচণ্ড চেষ্টা ছিল। আর তাই সেই অর্থে সিনিয়রদের নিন্দার সম্মুখীন আমি হইনি। আমাদের আগের প্রজন্মে যারা ছিলেন, যেমন- গোলাম মুস্তাফা, নায়করাজ আব্দুর রাজ্জাক, তারা আমাকে স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখতেন এবং ভালো বলতেন। খুব ভালো বলতেন না হয়তো, কিন্তু ভালো বলতেন। গোলাম মুস্তাফা সাহেবের কথা মনে আছে। ভালো কাজ করাতে তিনি আমাকে প্রশংসা করতেন। আবার পছন্দ না হলে সেটির সমালোচনা করতেন। এগুলো সিনিয়রদের থেকে পেয়েছি। উৎসাহ পেয়েছি।’
প্রিয় বিনোদন/গোরা/শান্ত