কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

কলকাতার ফুটপাথ। ছবি: সংগৃহীত।

‘পার্পল ড্রিম’-বিমান থেকে ফুটপাতে (পর্ব ৪৫)

সজল জাহিদ
লেখক
প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:০৫
আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:০৫

 

(প্রিয়.কম) আচ্ছা আপনি বিমানে কোন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাচ্ছেন। আপনি কি ভাবতে পারেন যে বিমানের মতো সবচেয়ে বিলাসবহুল আর ব্যয়বহুল একটা দারুণ জার্নি শেষে আপনার ঠিকানা হতে পারে সরাসরি কোন ফুটপাথে? নাহ ফুটপাথে মানে এই নয় যে হেঁটে যাবেন বা কিছু সময় অতিবাহিত করবেন। মোটেই তেমন নয়। ফুটপাথে আপনি অবস্থান করবেন বিমান থেকে নেমে পরের পুরো একটি দিন! অথচ আপনার কাছে টাকা পয়সার কোনো কমতি নেই। আপনি অসহায় বা সম্বলহীন নন, তবুও আপনাকে বিমানের মতো বিলাসবহুল জার্নি শেষে ফুটপাথেই যদি থাকতে হয়। তবে কেমন হবে বলুন তো?

চলুন আজ ঠিক এমনই একটি গল্প শুনি বা বলি...

জীবন যে কখন, কাকে, কীভাবে কী শিক্ষা দেয় তার কোনো ঠিক নেই। জীবনে যে কখন, কী কারণে আর কেন, কী পরিস্থিততে দাঁড় করিয়ে দেয় সেটা কেউ জানে না। এই সুখে ভাসিয়ে দেবে, তো এই হতাশায় ডুবিয়ে দেবে, এই আলো ঝলমল, তো এই ঘুটঘুটে অন্ধকার, এই জনাকীর্ণ পরিবেশ। তো এই নীরব-নিস্তব্ধ আর সুনসান চারদিক, এই বর্ণীল তো এই ধূসর। হ্যাঁ এটাই জীবন। এভাবেই পদে-পদে বা বাঁকে-বাঁকে জীবন তার পথ-রঙ-রূপ আর ধরন পরিবর্তন করে। এটাই জীবন। কেউ দেখতে বা বুঝতে পারে, কেউ পারে না। যে দেখতে বা বুঝতে পারে সে সব রকম পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নিতে পারে, একটু হোঁচট খেলেও। আর যে পারে না, সে অতলে হারিয়ে যায় কখন নিজেই জানে না।

ভাইবারের বিপদ সংকেত পেয়ে শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম গিয়ে, পরে জম্মু হয়ে ট্রেনে কলকাতার টিকেট বাদ দিয়ে সাধ্যের বাইরে গিয়ে পরদিনের প্লেনের টিকেট কেটে ছোট্ট কিন্তু ঝকঝকে শ্রীনগর এয়ারপোর্ট এ চলে গেলাম ট্যাক্সির মতো বিলাসবহুল যানে।

আহ কী চমৎকার লাগছিল যে একা একা বিমান ভ্রমণের সবটুকু স্বাদ শুষে নিতে আর তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে। জানালার পাসের সিট, দূরের নীল আকাশ, ভেসে বেড়ানো মেঘের সমুদ্র, নিচে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ খেলানো পৃথিবী, মাথার আঁকাবাঁকা সিঁথির মত নদী, দূরের বরফ পাহাড়ের চূড়া, বিমানবালাদের সুরেলা কণ্ঠ, আকর্ষণীয় চাহনি, জোর করে হাসি, বোনাস হিসেবে এক ঘণ্টা জম্মু দেখা এরপর আবার দিল্লীর দিকে উড়াল দেয়া, দিনের আকাশে সন্ধ্যার আগমনী আভা, আকাশের সেজে ওঠা, সোনালী সন্ধ্যা হওয়া, মেঘেদের পাহাড় দেখা, একই সঙ্গে নিচে রাতের আঁধার আর উপরের আকাশে সূর্যের আলোর দুর্লভ দৃশ্য দেখা।

সবকিছু মিলে কেমন একটা মিশ্র মাদকতা মেশানো ছিল যেন। প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছিলাম তাড়িয়ে তাড়িয়ে। আকাশ-মাটি-পাহাড়-নদী-মেঘ-সন্ধ্যা-আঁধার আর আলো। ঠিক দেড় ঘণ্টা পরে রাত ৮.৪৫ এ জম্মু থেকে কলকাতা পৌঁছে গেলাম। প্লেন ল্যান্ড করার পরে লাগেজের ঘোষণা শুনে নেমে পড়লাম। লাগেজ নিয়ে, বাইরে গিয়ে দামী ট্যাক্সিতে না গিয়ে পাশের টার্মিনালের এসি বাসে উঠে বসলাম, নিউমার্কেটের আশেপাশে নামবো বলে। কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা চলে, মনের ভুলে হাওড়া চলে গেলাম। হাওড়া স্টেশন থেকে আবারও অনেকটা ঘুরে লোকাল বাসে আর হেঁটে যতক্ষণে এসপ্ল্যানেড পৌছালাম ততক্ষণে রাত ১০ পেরিয়ে গেছে! হোটেলের বাজেট ছিল প্রথমে ৫০০ টাকা। কোনক্রমে রাতটা পার করা। পরদিনই হালকা কেনাকাটা করে চলে যাবো বলে। কিন্তু টানা, পাঁচ-ছয়টি হোটেলে ঢুকে কোন সিট না পেয়ে, মনে মনে বাজেট বাড়িয়ে দিলাম ৫০০ থেকে ৮০০। রাতে একটু ঘুমোতে হবে, ভালো একটা গোসল দিয়ে। এরপর নিউমার্কেট আর এর আশেপাশে আরও কয়েকটি হোটেল গেলাম কিন্তু কোথাও কোনো সিট খালি নেই। ততক্ষণে বাজেট ৮০০ থেকে ১০০০ এ নিয়ে গেছি। রাতটা থাকতে হবে, ভালো একটা গোসল দিয়ে, একদম ঠাণ্ডা পরিবেশে। ১০টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে, কেনাকাটা করে, সিয়ালদাহ থেকে বনগাঁ লোকালে বনগাঁ গিয়ে, বর্ডার পার হয়ে সোজা ঢাকা। কিন্তু কোথাও হোটেল নেই! রাস্তায় রাস্তায় মানুষ বসে আছে। ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-শিশু। এসব দেখে, টানা তিন ঘণ্টা হেঁটে, ঘেমে নেয়ে জুবুথুবু অবস্থা। আর শরীরের অবস্থা কাহিল। সেই সাথে নিদারুণ ক্ষুধা। তাই আপাতত হোটেল বাদ। আগে খাওয়া। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে সাধারণত যেগুলোতে খাই। একটু হেঁটে রাস্তার মোড় পেরিয়ে অন্য এক হোটেলে খাসির মাংস আর গরম ভাত খেয়ে শান্ত হলাম কিছুটা। যাক আগে পেট তো ঠাণ্ডা হয়েছে। এবার না হয় আবারও একটু ঘুরে ঘুরে দেখা যাবে। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় না পেয়ে, দূরের কোথাও যাবো খুঁজতে, কিছুটা এগোতেই পড়লাম এক মাতালের পাল্লায়। মাতালরা আবার বেশ দয়ালু হয়ে থাকে। সেই মাতাল আমাকে হোটেল খুঁজে দেবার জন্য কয়েক জায়গায় নিয়ে গেল, একে ওকে ফোন করলো। মুশকিল হল এদের হাত থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যায় না। এদেরকে উপেক্ষা করলেই এরা ক্ষেপে গিয়ে ক্ষতি করে বসতে পারে। তাই চুপচাপ ওর কথা মতো হাঁটছিলাম পিছে পিছে।

একটু পর এক দালাল এলো, যে মাতালের সাথে পরিচিত। মাতাল সেই দালালকে নিজের ভাই আর আমাকে ওর দেশি ভাই পরিচয় দিয়ে রুম খুঁজে দিতে বলে চলে গেল। আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ভাবলাম। কিন্তু না, এবার আরও বড় ফ্যাসাদে পড়লাম। দালাল কোনোভাবেই আমাকে হাতছাড়া করে না। তার কাছে ৪ হাজার টাকায় ভালো রুম আছে আমাকে দেবে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছি। আর ভাবছি কীভাবে কাটানো যায়? এরই মধ্যে দালাল দুই দম্পতি পেয়ে তাদের দিকে মনোযোগ দেয়াতেই আমি আঁধারে হারিয়ে গেলাম, যেন খুঁজে না পায়। হেঁটে হেঁটে মারকুইস স্ট্রীটের বাস স্ট্যান্ডের পাশের বেদীতে গিয়ে বসলাম একটা ঠাণ্ডা পানি আর লিমকা নিয়ে। বসার পরে বুঝলাম আমি আর উঠতে পারবো না। এতোটাই অবসন্ন আর ক্লান্ত। সেখানে বসেই ঘামে ভেজা গেঞ্জি পরিবর্তন করলাম। পুরো বেদী শুধু নয়, দুই পাশের ফুটপাথজুড়েই শুধু বাঙালি বাবু আর দিদিদের নাজেহাল অবস্থা। ঈদের ছুটির সাথে আরও ছুটি মিলিয়ে সকল বাঙালি বাবু কলকাতায় আশায় এখানে আর কোনো হোটেল নেই। একটা ডরমেটরির খোঁজ পাওয়া গেল বেশ কিছুটা দূরে। অনেকেই সেখানে যাবে। আমি ঠিকানাটা জেনে রেখে, কাঁধের ব্যাগটা পেছনে গাছের সাথে রাখলাম। আর হাতের উইন্টার জ্যাকেটটা ভাঁজ করে পাশে রেখে ভাবলাম মাথাটা একটু রাখি। পরে উঠে যাওয়া যাবে। কিন্তু এরপর আর কিছু মনে নেই। কোথায় হারালাম আর কতটা হারালাম। কারণ সেই যে জ্যাকেটে মাথা রেখেছিলাম মনে আছে শুধু, পরে চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে। আমার শুয়ে থাকার পাশেই বাস দাড়িয়ে আছে, যাত্রীরা উঠছে আর আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে! যে জ্যাকেট মাথায় দিয়ে, পাশে ব্যাগ রেখে আর বুট পরেই ঘুমিয়েছিল।

কোন কিছু নিয়ে আমার তেমন কোনো ভয় ছিল না। শুধু সাইড ব্যাগের পাসপোর্ট আর টাকা ছাড়া। আর পাসপোর্টের পরে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল কেউ যদি আমার অনেক সাধনার উডল্যান্ড জোড়া নিয়ে যায়। তাই ওটা না খুলেই শুয়ে ছিলাম। নইলে হয়তো কেউ না কেউ নিয়েই যেতে পারতো। কারণ ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার সাধের ‘পার্পল ড্রিম’ ট্রিপের পার্পল ক্যাপটি নেই। ওটা কেউ খুচরো পেয়ে নিজের মনে করে নিয়ে গেছে।

আহ, এই হল আমার প্লেন থেকে ফুটপাথের স্মরণীয় গল্পটি।

তবে আর যাই হোক হোটেল খরচটা কিন্তু বেঁচে গেছে।

 

বিমান থেকে ফুটপাথের অনন্য অভিজ্ঞতার কারণে.....

পার্পল ড্রিমের অন্যান্য পর্বগুলি পড়ুন এখানে। 

 'পার্পল ড্রিম' - পূর্বকথা (পর্ব ১)

 'পার্পল ড্রিম'- দুশ্চিন্তা নিয়ে যাত্রা শুরু (পর্ব ২)

 'পার্পল ড্রিম'- তিস্তা একপ্রেস ও দুধ কুমারীর হাড়ি ভাঙা (পর্ব ৩)

 'পার্পল ড্রিম'- কলকাতার আলুসেদ্ধ গরম ও এক পশলা বৃস্টি (পর্ব ৪)

'পার্পেল ড্রিম'- কালকা মেইলের দিন-রাত্রি (পর্ব ৫)

'পার্পল ড্রিম'- কেন কালকা মেইলে? (পর্ব ৬)

'পার্পল ড্রিম'- স্বপ্নের টয় ট্রেনে (পর্ব ৭)

'পার্পল ড্রিম'-একটি মানবিক গল্প (পর্ব ৮)

 'পার্পল ড্রিম'- সুখের শহর সিমলা (পর্ব ৯)

'পার্পল ড্রিম'- সিমলা-একহাতে সুখ যার অন্য হাতে দুঃখ! (পর্ব ১০)

'পার্পল ড্রিম'- অলস শহর মানালিতে (পর্ব ১১)

 'পার্পল ড্রিম'- হোটেল ও আপেল বিভ্রাট (পর্ব ১২)

'পার্পল ড্রিম'- একটু বৃষ্টি, আর একটু মাতলামির গল্প (পর্ব ১৩)

'পার্পল ড্রিম'- বিয়াসের তীরে আলসেমিতে (পর্ব ১৪)

'পার্পল ড্রিম'-সেদিনও বৃষ্টি (পর্ব ১৫)

'পার্পল ড্রিম'- স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু (পর্ব ১৬)

'পার্পল ড্রিমবিয়াসের উৎপত্তি স্থল ও রোথাং পাসের রোমাঞ্চ (পর্ব ১৭)

'পার্পল ড্রিম'-কেলং-জিসপা না সারচু? (পর্ব ১৮)

 'পার্পল ড্রিম'-সারচুর সোনা পাহাড় ও নির্ঘুম রাত (পর্ব ১৯)

'পার্পল ড্রিম'-পাঙএকটি জনপদের গল্প (পর্ব ২০)

'পার্পল ড্রিম'- রুক্ষ ভালোবাসার শহর লেহ (পর্ব ২১)

'পার্পল ড্রিম'- পার্পল ড্রিম এর মামা বাড়ি (পর্ব ২২) 

'পার্পল ড্রিম'- পার্পল ড্রিম এর শ্বশুরবাড়ি (পর্ব ২৩)

'পার্পল ড্রিম'- ভ্রমণে নদীর আকর্ষণ! (পর্ব ২৪) 

'পার্পল ড্রিম'- ম্যাজিক্যাল ম্যাগনেটিক হিল! (পর্ব ২৫)

'পার্পল ড্রিম' সঙ্গম-ইন্দাস ও জান্সকারের! (পর্ব ২৬)

'পার্পল ড্রিম' স্বর্গের বিছানা থেকে শুভ সকাল (পর্ব ২৭)

'পার্পল ড্রিম'- পাহাড় থেকে লাফ! একটি স্বপ্ন পূরণ (পর্ব ২৮)

'পার্পল ড্রিম'- গার্লফ্রেন্ড না রয়েল এনফিল্ড! (পর্ব ২৯)

'পার্পল ড্রিম'- খারদুংলা টপ! ১৮,৩৮০ ফুট! (পর্ব ৩০)

'পার্পল ড্রিম’ - খারদুংলা চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশী! (পর্ব ৩১)

'পার্পল ড্রিম' নুব্রাভ্যালী থেকে তুরতুক (পর্ব ৩২)

'পার্পল ড্রিম' তুরতুক-বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদ (পর্ব ৩৩)

'পার্পল ড্রিম'- নুব্রাভ্যালী ও ক্যামেল সাফারির গল্প (পর্ব ৩৪)

'পার্পল ড্রিম'- ফুল কুমারীর গল্প (পর্ব ৩৫)

'পার্পল ড্রিম' -একটি কলা কাহিনী (পর্ব ৩৬)

'পার্পল ড্রিম' -নিশা, তুম বাড়ি মিঠি হো (পর্ব ৩৭)

'পার্পল ড্রিম' -নুব্রা থেকে প্যাংগং (পর্ব ৩৮)

'পার্পল ড্রিম'- প্যাংগং লেক (পর্ব ৩৯)

'পার্পল ড্রিম' - তিন আহাম্মকের গল্প (পর্ব ৪০) 

'পার্পল ড্রিম' -তুষার পাতের আশীর্বাদ (পর্ব ৪১)

'পার্পল ড্রিম'- কার্গিল-একটি যুদ্ধক্ষেত্র ভ্রমণের গল্প (পর্ব ৪২)

'পার্পল ড্রিম'-পতাকা ও একটি আক্ষেপ অনুভূতি (পর্ব ৪৩)

'পার্পল ড্রিম'-ভাইবারের ওয়েদার (পর্ব ৪৪)

 

সম্পাদনাঃ প্রিয় ট্রাভেল/ জিনিয়া

প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post