কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

কার্গিল। ছবি- সংগৃহীত

'পার্পল ড্রিম'- কার্গিল-একটি যুদ্ধক্ষেত্র ভ্রমণের গল্প (পর্ব ৪২)

সজল জাহিদ
লেখক
প্রকাশিত: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:১৪
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:১৪

(প্রিয়.কম) কার্গিল সম্বন্ধে প্রথম অল্প কিছু জানি স্কুল-কলেজে যে, এটি পৃথিবীর উচ্চতম আর একটি অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু কার্গিল নিয়ে প্রথম আগ্রহর জন্ম নেয় ভারতের একটি শ্বাসরুদ্ধকর সিনেমা লাইন অব কন্ট্রোল বা LOC দেখার পরে। এই LOC বা লাইন অফ কন্ট্রোল জম্মু কাশ্মীরের কার্গিল নামক স্থানের পাহাড় চুড়ার একটি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত। যা পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বিখ্যাত হয়ে ওঠে কার্গিল কনফ্লিকট বা কার্গিল যুদ্ধের কারণে। বলা হয়ে থাকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উচু যুদ্ধক্ষেত্র!

আর এরপর পুরো বাংলাদেশের প্রায় সবকটি জেলা দেখা শেষ হবার পরে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম এরপর সুযোগ পেলেই ভারতবর্ষ দেখে শেষ করে তারপরে অন্য কোন দেশ ঘুরব তখন থেকেই মনে মনে একদিন কাশ্মীর আর কার্গিল দেখার সুপ্ত বাসনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা অনেকটা অসাধ্যই ধরে নিয়েছিলাম, নানা রকম রাজনৈতিক, সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে।

কিন্তু এই বছরের শুরুতে যখন সিমলা-মানালি হয়ে লেহ-লাদাখ যাবার পরিকল্পনা করলাম তখন ঘুরে ফেরার পথ হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলাম সম্ভব হলে কাশ্মীরের কার্গিল বা লাইন অফ কন্ট্রোল (LOC) হয়ে ফেরার চেষ্টা করবো এবং সেখানে গিয়ে নিজ চোখে দেখার চেষ্টা করবো, পৃথিবীর অন্যতম উঁচু সেই যুদ্ধক্ষেত্র। যেটা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ আর গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। ১৯৯৯ সালের যে যুদ্ধে নিহত হয়েছিল সবমিলে প্রায় ২০০০ এর উপরের মানুষ, ১০০০ এর উপরে সৈন্য! আর প্রায় ৩০০০ এর মত আহত হয় সেই সময়ে।

লেহ থেকে যেদিন ফিরছিলাম সেদিন মনে মনে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল যে সম্ভব হলে আর অনুমোদন পেলে আজকে অনেক দিনের ভেবে রাখা কার্গিল এর লাইন অফ কন্ট্রোল দেখবো নিজ চোখে। ঘুরে দেখবো নিহত সেনাদের জন্য সেখানে গড়ে ওঠা কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল। তাই গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম কার্গিল দেখবো ঠাণ্ডা মাথায়। ভোরে রওনা হয়ে কার্গিল পৌঁছালাম প্রায় দুপুরে। একবার ভাবলাম ড্রাইভার কি ছেড়ে আসলো নাকি সেই লাইন অফ কন্ট্রোল? না ছেড়ে আসেনি। কয়েকটি পাহাড়ি বাঁক, বড় বাজার, কার্গিল শহর, সিন্ধু নদী পেরিয়ে আমাদের গাড়ি এসে থামলো কার্গিল ওয়ার মেমরিয়ালের সামনের গেটে।

যেখানে কোন টিকেট লাগেনা, তবে দেশী হোক বা বিদেশী তাদের নিজ নিজ আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট দেখিয়ে, এন্ট্রি করে, চেক করে ঢোকানো হয় ভিতরে। বিশাল সুরক্ষিত লোহার গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা অন্যরকম অনুভূতি ঘিরে ধরবে আপনাকে। চারপাশ ঝকঝকে, তকতকে করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা রঙের রঙিন ফুল আর মখমলের মত মিহি সবুজ ঘাস দিয়ে। হাঁটার জন্য টাইলস বসানো মসৃণ রাস্তা। যেখানেই চোখ যাবে দেখতে পাবেন ১৯৯৯ সালের যুদ্ধে ব্যবহৃত যুদ্ধ সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা হয়েছে সযত্নে।

হেঁটে একটু সামনের গিয়ে বিস্তীর্ণ বেদীতে সমবেত হবার পরে আপনাদেরকে সেই কার্গিল যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দেবে আর্মির কোন একজন ক্যাপ্টেন বা মেজর পদমর্যাদার কেউ। উচ্চস্বরে, জোরালো কণ্ঠে, ভক্তি ভরে, আর দৃঢ়ভাবে। যেখানে প্রতিটা শব্দের উচ্চারনে আপনি খুঁজে পাবেন, দেশপ্রেম, নিহত সৈনিকদের প্রতি নিখাদ শ্রদ্ধা, তাদের পরিবারের প্রতি প্রগাড় ভালোবাসা, দেশের সীমানা ও মাটির প্রতি সত্যিকারের টান, যে কোন মুহূর্তে যে কোন সময়ে নিজের জীবন বাজি রাখার মত সাহস আর একজন সাহসী সৈনিক হিসেবে নিজের প্রতি নিজের অহংকার!

পতপত করে উড়তে থাকা, জ্বলজ্বলে জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে বলা প্রতিটা কথায় প্রচণ্ড আত্নবিশ্বাস আর শত্রু দেশের প্রতি সীমাহীন ঘৃণা আপনার মাথা অবনত করে দেবে, সিনা চওড়া করে দেবে, গর্বে ভরে উঠবে বা উঠতে বাধ্য করবে আপনার মনপ্রাণ। যা নিজের অজান্তেই নিজের দেশের প্রতি বাড়িয়ে দেবে আপনার মমতা, ভালোবাসা আর দেশপ্রেম। ভালোবেসে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে উড়তে থাকা বিশাল, জ্বলজ্বলে, আর সদা অহংকারের জাতীয় পতাকার দিকে।

দেয়ালের ওপারে পাহাড়ে পাহাড়ে আর্মিদের ক্যাম্প, বর্ডার, নিরাপত্তা আর সবসময়ের জন্য সতর্ক অবস্থান। আর দেয়ালের এপারে ফুলের মাঝে, গাছের ছায়ায় ছায়ায় নিহত সৈনিকদের সারি সারি সমাধি আপনাকে ব্যথিত করে তুলবে মুহূর্তেই। আর আফসোসে পোড়াবে কেন আমার দেশের সৈনিকদের এমন সমাধি নেই, যা দেখলেই চোখ ছলছল করে উঠে শ্রদ্ধা জাগাবে, দেশের প্রতি তাদের আত্মনিবেদন বাড়াবে ভালোবাসা আর দেশপ্রেম। কেন কোন জায়গায় আমাদের এতো ভালোবাসার একটি পতাকা এভাবে ওড়েনা সব সময়? যে মাথা অবনত করে দেবে শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়? যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে একটুকু ক্লান্ত বোধ করবনা?

দেশের প্রতি ওদের সবার ভালোবাসা, দেশপ্রেম আর শ্রদ্ধা এতোটা আর এমন যে, যা আপনার আমার মত সাধারণ ভ্রমণকারীকেও দেশ, দেশের মানুষ, জাতীয় পতাকা আর দেশপ্রেমে জাগ্রত করে তোলে মুহূর্তেই!

কার্গিল যেতে হলে সবচেয়ে সহজ পথ হল প্লেনে বা ট্রেনে করে দিল্লী হয়ে প্রথমে শ্রীনগর। শ্রীনগর থেকে গাড়িতে করে সোনমার্গ আর যোজিলা পাস হয়ে কার্গিল ২০০ কিলোমিটার। যেতে আসতে সারাদিন চলে যাবে পাহাড়ি, আঁকাবাঁকা আর ঝুঁকিপূর্ণ পথে। মাঝে উপরি হিসেবে পাবেন সোনায় সোনমার্গ আর প্রায় বরফে আচ্ছাদিত যোজিলা পাস।

 

পার্পল ড্রিমের অন্যান্য পর্বগুলি পড়ুন এখানে। 

 'পার্পল ড্রিম' - পূর্বকথা (পর্ব ১)

 'পার্পল ড্রিম'- দুশ্চিন্তা নিয়ে যাত্রা শুরু (পর্ব ২)

 'পার্পল ড্রিম'- তিস্তা একপ্রেস ও দুধ কুমারীর হাড়ি ভাঙা (পর্ব ৩)

 'পার্পল ড্রিম'- কলকাতার আলুসেদ্ধ গরম ও এক পশলা বৃস্টি (পর্ব ৪)

'পার্পেল ড্রিম'- কালকা মেইলের দিন-রাত্রি (পর্ব ৫)

'পার্পল ড্রিম'- কেন কালকা মেইলে? (পর্ব ৬)

'পার্পল ড্রিম'- স্বপ্নের টয় ট্রেনে (পর্ব ৭)

'পার্পল ড্রিম'-একটি মানবিক গল্প (পর্ব ৮)

 'পার্পল ড্রিম'- সুখের শহর সিমলা (পর্ব ৯)

'পার্পল ড্রিম'- সিমলা-একহাতে সুখ যার অন্য হাতে দুঃখ! (পর্ব ১০)

'পার্পল ড্রিম'- অলস শহর মানালিতে (পর্ব ১১)

 'পার্পল ড্রিম'- হোটেল ও আপেল বিভ্রাট (পর্ব ১২)

'পার্পল ড্রিম'- একটু বৃষ্টি, আর একটু মাতলামির গল্প (পর্ব ১৩)

'পার্পল ড্রিম'- বিয়াসের তীরে আলসেমিতে (পর্ব ১৪)

'পার্পল ড্রিম'-সেদিনও বৃষ্টি (পর্ব ১৫)

 'পার্পল ড্রিম'- স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু (পর্ব ১৬)

'পার্পল ড্রিমবিয়াসের উৎপত্তি স্থল ও রোথাং পাসের রোমাঞ্চ (পর্ব ১৭)

'পার্পল ড্রিম'-কেলং-জিসপা না সারচু? (পর্ব ১৮)

 'পার্পল ড্রিম'-সারচুর সোনা পাহাড় ও নির্ঘুম রাত (পর্ব ১৯)

'পার্পল ড্রিম'-পাঙএকটি জনপদের গল্প (পর্ব ২০)

'পার্পল ড্রিম'- রুক্ষ ভালোবাসার শহর লেহ (পর্ব ২১)

'পার্পল ড্রিম'- পার্পল ড্রিম এর মামা বাড়ি (পর্ব ২২) 

'পার্পল ড্রিম'- পার্পল ড্রিম এর শ্বশুরবাড়ি (পর্ব ২৩)

'পার্পল ড্রিম'- ভ্রমণে নদীর আকর্ষণ! (পর্ব ২৪) 

'পার্পল ড্রিম'- ম্যাজিক্যাল ম্যাগনেটিক হিল! (পর্ব ২৫)

'পার্পল ড্রিম' সঙ্গম-ইন্দাস ও জান্সকারের! (পর্ব ২৬)

'পার্পল ড্রিম' স্বর্গের বিছানা থেকে শুভ সকাল (পর্ব ২৭)

'পার্পল ড্রিম'- পাহাড় থেকে লাফ! একটি স্বপ্ন পূরণ (পর্ব ২৮)

'পার্পল ড্রিম'- গার্লফ্রেন্ড না রয়েল এনফিল্ড! (পর্ব ২৯)

'পার্পল ড্রিম'- খারদুংলা টপ! ১৮,৩৮০ ফুট! (পর্ব ৩০)

'পার্পল ড্রিম’ - খারদুংলা চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশী! (পর্ব ৩১)

'পার্পল ড্রিম' নুব্রাভ্যালী থেকে তুরতুক (পর্ব ৩২)

'পার্পল ড্রিম' তুরতুক-বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদ (পর্ব ৩৩)

'পার্পল ড্রিম'- নুব্রাভ্যালী ও ক্যামেল সাফারির গল্প (পর্ব ৩৪)

'পার্পল ড্রিম'- ফুল কুমারীর গল্প (পর্ব ৩৫)

'পার্পল ড্রিম' -একটি কলা কাহিনী (পর্ব ৩৬)

'পার্পল ড্রিম' -নিশা, তুম বাড়ি মিঠি হো (পর্ব ৩৭)

'পার্পল ড্রিম' -নুব্রা থেকে প্যাংগং (পর্ব ৩৮)

'পার্পল ড্রিম'- প্যাংগং লেক (পর্ব ৩৯)

'পার্পল ড্রিম' - তিন আহাম্মকের গল্প (পর্ব ৪০) 

'পার্পল ড্রিম' -তুষার পাতের আশীর্বাদ (পর্ব ৪১)

 

সম্পাদনাঃ প্রিয় ট্রাভেল/ জিনিয়া

প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post।