কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

মতামত দানকারী শরিয়াহ স্কলার। বাম থেকে একিউএম ছফিউল্লাহ আরিফ, মুফতি ইউসুফ সুলতান, ড. মোহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ ও মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেমি। ছবি : প্রিয়.কম

অনলাইনে কোরবানির পশুর ক্রয়-বিক্রয় 'জায়েজ' না কি 'না জায়েজ'? শরিয়াহ স্কলাররা যা বললেন...

মিরাজ রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ২৯ আগস্ট ২০১৭, ১২:৪৩
আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০১৭, ১২:৪৩

(প্রিয়.কম) ২৩ আগস্ট বুধবার জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে। এই হিসেব অনুযায়ী আগামী ০২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালিত হবে। আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। অন্যান্য বছরের মতো এখন প্রায় সব মুসলমানের মাথায় একটাই চিন্তা- সাধ ও সাধ্যের মিল ঘটিয়ে কোরবানির জন্য ভালো একটি পশু ক্রয় করা। ইদানিং বাংলাদেশে উট কোরবানি দেওয়ার একটি প্রবণতা দেখা গেলেও কোরবানির জন্য বাংলাদেশিদের মূলত পছন্দ গরু। এছাড়া ছাগল ও ভেড়াও কোরবানি হয়।

একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে কোরবানির বাজার থেকে ৪০ লাখ ৬১ হাজার গরু, ২১ লাখ ৯০ হাজার ছাগল এবং ১ লাখ ৫৮ হাজার অন্যান্য পশু বিক্রি হয়েছিল। এই হিসেব এদিক-সেদিক হতে পারে, তবে মূল পরিমাণটা খুব বেশি উঠানামা করবে না। মানে হলো বাংলাদেশে প্রতি বছর কোরবানি উপলক্ষে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ পশু বিক্রি ও জবাই করা হয়।

কোরবানি উপলক্ষে হাটে গিয়ে গরু, ছাগল বা ভেড়া কেনায় এক ধরনের তৃপ্তি ও আনন্দ খুঁজে পায় বাংলাদেশি মুসলিম সমাজ। হাঁটে গিয়ে কোরবানির পশু কেনা এবং বাসায় নিয়ে আসার সময় সারা পথ ধরে ভাই দাম কতো? কত দাম দিয়ে কিনলেন গরুটা? এমনসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটাও যেন এক প্রকার ঈদ আনন্দ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই প্রচলনের হালে এসে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির ছোয়া। অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি ও ক্রয়কেন্দ্রিক সফলতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠিত অনলাইন শপ শুরু করেছে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি।

এবারে কোরবানিকে সামনে রেখে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আগের তুলনায় আরো বেশি ও বড় আকারে অনলাইনে কুরবারির পশু বিক্রয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মুসলিমদের থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে আসছে। আর তা হলো- অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি এবং তা ক্রয় করা জায়েজ না কি না জায়েজ? এভাবে অনলাইন থেকে কোরবানির পশু ক্রয় করা এবং তা কোরবানি দেওয়ার মাঝে কোনো সমস্যা নেই তো? অনেকেই জানতে চাচ্ছেন- এর সমাধান কী? বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ ইসলামি আইন ও শরিয়াহ বিশেষজ্ঞের সাথে। চলুন তাহলে জেনে নেই শরিয়াহ স্কলাররা এ বিষয়ে কি বলেছেন।

১. বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল জনাব একিএম ছফিউল্লাহ আরিফের সাথে তিনি বলেন, ‘কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা সকল সামর্থবানের উপর আবশ্যক বা ওয়াজিব। কোরবানির জন্য যে সকল পশু জবেহ করা যায় তা হলো- উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল। এগুলো প্রচলিত হাট বাজার থেকে কেনার পাশাপাশি টেকনোলজির যুগে অনলাইনে কেনা-বেচা হচ্ছে। এই অনলাইনে কেনাবেচা করা সহজ হওয়ায় তার প্রতি জনগণের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ই-কমার্স সাইট, কৃষক, খামারি থেকে শুরু করে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও। এখানে কেনাবেচাটি প্রত্যক্ষভাবে না হয়ে পরোক্ষভাবে (হুকমী) হয়। শর্তাবলির আলোকে লেনদেন করা হলে ইসলামী শরিয়তে এ বেচাকেনা বৈধ হতে পারে- ১. ক্রয়বিক্রয়ে ইজাব কবুল থাকতে হবে। ২. বিক্রীত পশুটি বিক্রেতার মালিকানাধীন থাকতে হবে। ৩. গরু/ছাগলের ছবির সাথে তার সকল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে হবে। পণ্যে কোন দোষক্রটি থাকলে তা উল্লেখ করতে হবে। ৪. ডেলিভারি চার্জ/সার্ভিস চার্জ/পরিবহন খরচ কে বহন করবে তা উল্লেখ করতে হবে। ৫. গরু/পশু চাক্ষুষ দেখার পর তা গ্রহণ অথবা ফেরত দানের শর্ত/সুযোগ রাখা। কারণ নেটে দেখার সাথে বাস্তব দেখার মিল নাও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহককে বিক্রেতার যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে হবে। ৬. টাকা পাঠানোর পদ্ধতি ডকুমেন্টারি করা। ৭. পশু হস্তান্তরের তারিখ, সময় ও স্থান উল্লেখ করতে হবে। ৮. লেনদেনের মাধ্যম চেক/নগদ উল্লেখ করতে হবে। ৯. ক্রেতা ও বিক্রেতার নিকট একে অপরের মোবাইল, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা সংগ্রহে থাকাটা সমীচীন হবে। ১০. লেনদেনে সুদের সংশ্লিষ্টতাসহ কোন প্রতারণা, মিথ্যাচার ও অস্পষ্টতা থাকলে তা শরিয়াহসম্মত হবে না।’

২. আরো কথা হয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ইথিক্সভেঞ্জারের শরিয়াহ-টেক কনসালটেন্ট, মালয়েশিয়াতে অবস্থানকারী বিশিষ্ট শরিয়াহ স্কলার মুফতি ইউসুফ সুলতানের সাথে। বিষয়টি তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,‘ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির জন্য বিক্রিত পণ্য পরিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট হতে হয়। অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পন্য যেহেতু সামনে নেই, তাই পরিপূর্ণভাবে সকল স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করতে হয়। গরু-ছাগল ও অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব নয়। তাই এতে ধোকাবাজি থাকার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।  যে কোনো পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শরীয়তের মূলনীতি হলো, তা এমনভাবে সুনির্দিষ্ট করতে হবে যেন কোনো প্রকার অনিশ্চয়তা না থাকে। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রয়ে নিম্নোক্ত বিষয় লক্ষণীয়- ১. পশুর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া - যেসব বিষয় বাজারে সরাসরি গরু ক্রয়ের সময় জিজ্ঞাসা করা হয় এবং যেসব বিবরণের উক্ত পশুটিকে অন্যান্য পশু থেকে আলাদা করা যায়। ২. পশুর একাধিক ছবি ও ভিডিও দেয়া। ৩. পশু দেখার পর বিবরণ অনুযায়ী না পেলে তা ফেরত দেয়ার সুযোগ রাখা। কারণ পশুকে সরাসরি দেখা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে সুনির্দিষ্ট করা অসম্ভব। উপরোল্লিখিত নিয়মাবলী অনুসরণ করা হলে ইনশা'আল্লাহ বিক্রয় বৈধ হবে।’

৩. মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের প্রথা আধুনিক বিশ্বে নতুন নয়। উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেও এর প্রসারতা লক্ষ্য করার মতো। এ মাধ্যমে ব্যবসার প্রসারতার সাথে সাথে এর শরীয় বৈধতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কিছু শর্ত সাপেক্ষে এভাবে অর্থাৎ অনলাইনের মাধ্যমে পন্য ক্রয়-বিক্রয় বৈধ। যথা:-১. ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ যেন প্রতারিত না হয়। কারণ, রাসূল (সা.) মদিনার বাজারে আটার ঝুড়ির ভিতরের হাত দিয়ে যখন দেখতে পেলেন বাইরে শুকনো আটা থাকলেও ভিতরে ভেজা তখন বলেছিলেন, যে আমাদের সাথে প্রতারণা করল সে আমাদের (উম্মতের) অন্তর্গত না। (সহিহ বুখারি) ২. ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বাধীনতা থাকতে হবে। বিশেষ করে, “খিয়ারে রুইয়াত” অর্থাৎ পণ্য দেখার পর কোন দোষ-ত্রুটি ধরা পড়লে ক্রেতার কোন ধরনের ক্ষতি হওয়া ব্যতিত সেই পণ্য ফেরত দেয়ার অধিকার নিশ্চিত থাকা। ৩. পণ্য ও দামের ভিতর কোন ধরনের গরমিল না থাকা। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, যে পশু সেটা গরু হোক কিংবা ছাগল হোক তার যে ছবি এবং বর্ণনা অনলাইনে দেয়া থাকবে প্রকৃতপক্ষে তার সাথে মিল থাকা চাই। সেটা রং, সাইজ ইত্যাদিতেও হতে পারে। ৪. সবচেয়ে ভালো হয় যদি, পণ্য হাতে পেয়ে দাম পরিশোধের ব্যবস্থা থাকে। কারণ, বিক্রেতার চেয়ে ক্রেতার এ ক্ষেত্রে প্রতারিত বা ঠকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই, ক্রেতা দেখার পরে দাম পরিশোধ করতে পারলে অনেকাংশে তা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

পরিশেষে বলব, ইসলামের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সকলের কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে কেউ নিশ্চিত লাভবান হবে আর কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হবে এমন সব লেনদেন থেকে মুক্ত রেখে উভয়ের কল্যাণ সধিত হয় সেজন্য বিভিন্ন শর্তারোপ করে থাকে। তাই, ইসলামের বিধি-বিধানগুলো সঠিকভাবে মেনে এ ধরণের ব্যবসা করতে কোন দোষ নেই, বরং ভালো বলে আমরা মনে করি।‘

৪. আরো কথা হয় গাজীপুরস্থ জামিয়া সাবিলুর রাশাদের প্রিন্সিপাল মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেমির সাথে। তিনি জানান, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগে মানুষের হাতের নাগালে সবকিছু। জীবনের মান ও গতি পাল্টে গেছে। কেনাবেচায়ও এর প্রভাব পড়েছে। প্রায় সব পণ্যই অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায় এখন। সামনে কোরবানি। কোরবানির জন্তুও অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। শরীয়তে এ ধরনের কেনাবেচার হুকুম কী?

আসলে শরীয়তের নীতিমালা অত্যন্ত ব্যাপক, গুছালো ও আধুনিক; যা সব যুগের সঙ্গেই মানানসই ও উপযুক্ত। কেনাবেচার ক্ষেত্রে শরীয়ত যেসব নিয়মকানুন দিয়েছে সেসব পাওয়া গেলেই অনলাইনে গরু-ছাগল ও অন্যান্য পণ্য কেনাবেচা বৈধ হবে। অন্যথায় বৈধ হবে না। কেনাবেচার সব শর্ত ও নিয়ম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে বিক্রয় সংঘটিত ও বৈধ হওয়ার জন্য পণ্যের উপস্থিতি শর্ত কিনা এ বিষয়টি এখানে প্রধান আলোচ্যবিষয়। কারণ, অনলাইনে পণ্য সরাসরি দেখা হয় না; কেবল ছবি দেখা যায়। এ কথা স্বীকৃত যে, পণ্য নির্দিষ্টকরণ ও নির্ধারণের সবচেয়ে শক্তিশালী পদ্ধতি হচ্ছে দেখা ও ইঙ্গিত করা। একারণে পণ্য যখন চুক্তিকারী দুপক্ষের সম্মুখে উপস্থিত থাকে এবং ইঙ্গিতের মাধ্যমে নির্দিষ্টকরণ পূর্ণ হয় আর ক্রেতা পণ্যটি দেখে পছন্দ করে তখন কেনাবেচা আবশ্যক হয়ে যায়।

আর যদি পণ্য অনুপস্থিত থাকে তখন সুস্পষ্টভাবে তার গুণাগুণ বর্ণনার দ্বারা ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয়। যেমনটি বায় সালামের মাঝে হয়ে থাকে। গুণ বর্ণনার মাধ্যমে ক্রয়বিক্রয় সংঘটিত হওয়ার পর পণ্যটি দেখার পর যদি বিবরণের সাথে মিলে যায় তাহলে চুক্তি আবশ্যক হয়ে যাবে। অন্যথায় ক্রেতার জন্য জমহুর ফুকাহার মতে চুক্তি ভঙ্গের স্বাধীনতা থাকবে। যাকে ফিকহী পরিভাষায় খিয়ারুল খুলফ বলে। হানাফীগণের মতে ক্রেতার এক্ষেত্রে খিয়ারুর রুইয়ত বা দেখার অধিকার থাকবে। অর্থাৎ দেখার পর পণ্য গ্রহণ বা বর্জনের এখতিয়ার থাকবে। [বিস্তারিত দ্রষ্টব্য খিয়ারুল ওয়াসফ, খিয়ারুর রুইয়া]

তদ্রুপ মডেল ও নমুনা দেখে কেনাবেচা করার বিধানও অনুরূপ। মোটকথা, অনলাইনে গরু-ছাগলসহ সব বৈধ পণ্য কেনাবেচা করা যাবে। তবে গুণাগুণের সঙ্গে অমিল হলে ক্রেতা ইচ্ছে করলে পণ্যটি ফেরত দিতে পারবে। এক্ষেত্রে পূর্বেই পরিবহন খরচ ও অন্যান্য বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। নইলে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে ঝগড়া ও বিবাদ সৃষ্টি হতে পারে। বিবাদ সৃষ্টি হলে কেনাবেচা অবৈধ হয়ে যাবে। আরও বিস্তারিত জানতে আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যার (কেনাবেচা) অধ্যায় এবং বিভিন্ন আরবি ওয়েবসাইটে ইন্টারনেটে কেনাবেচা সংক্রান্ত আলোচনা দেখা যেতে পারে।’

 

প্রিয় ইসলাম/শামীমা সীমা