কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

তারেক মাসুদ ও প্রসূন রহমান। ছবি: সংগৃহীত।

আমরা জীবন যাপন করি, তারেক মাসুদ সিনেমা যাপন করতেন: প্রসূন রহমান

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০১৭, ২১:২৭
আপডেট: ১২ আগস্ট ২০১৭, ২১:২৭

(প্রিয়.কম) আগামীকাল ১৩ আগস্ট বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের প্রয়াণ দিবস। ২০১১ সালের এই দিনে কাগজের ফুল নামের একটি সিনেমার লোকেশন দেখে ফেরার সময় মানিকগঞ্জের ঘিওরে নামক এক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হোন তিনি। গুণী এই নির্মাতার প্রয়াণ দিবসে প্রিয়.কম কথা বলে তার দীর্ঘদিনের সহযোগী-সহযোদ্ধা লেখক এবং নির্মাতা প্রসূন রহমানের সঙ্গে।

প্রিয়.কম: দীর্ঘদিন কাজ করার সূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাকে, কাল তার প্রয়াণ দিবসে কিছু স্মৃতি প্রিয়.কমের পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরুন।

প্রসূন রহমান: আমরা এক সাথে দীর্ঘ সময় কাজ করেছি, স্মৃতি আসলে অনেক। প্রতিটা স্মৃতিই গুরুত্বপূর্ণ। আগামীকাল বিকালে শিল্পকলা একাডেমীতে তারেক ভাই স্মরণে তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা ২০১৭’ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে আমি পাঁচ মিনিটের একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তাকে স্পেশাল ট্রিবিউট দিচ্ছি। উনি এত মেধাবী একজন মানুষ ছিলেন, যার প্রতিটা কথাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আলাদা করে একটা-দুইটা স্মৃতি বলাটা বেশ কঠিন, তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই সুন্দর এবং স্মরণীয় স্মৃতি।

প্রিয়.কম: মৃত্যুর দিন কাগজের ফুল নামের একটি চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখে ফিরছিলেন তিনি। সেই সিনেমাটি এখন কী অবস্থায় আছে?

প্রসূন রহমান: কাগজের ফুল তারেক ভাই এর নিজের পরিকল্পনার একটা বড় প্রজেক্ট, তারেক ভাই চলে যাওয়ার পর এই দায়িত্ব ক্যাথরিনের উপর এসেছে, উনি একটু গুছিয়ে কাজটি করার জন্য সময় নিচ্ছেন। ফুলকে গুছিয়ে প্রেজেন্ট করতে যত সুন্দর প্রস্তুতি লাগে, ভালো আয়োজন লাগে, যত্ন লাগে- ক্যাথরিন সেই চেষ্টাটাই করছেন। একটা সুন্দর সময় নিশ্চয় এটা আমাদের সামনে আসবে।

প্রিয়.কম: সিনেমাটি কি নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে?

প্রসূন রহমান: না, এটা প্রিপারেশন পর্যায়ে আছে। এখনো ঘোষণা দেওয়ার মতো জায়গায় আসেনি। আমরা আশা করছি ক্যাথরিন যথা সময়ে প্রিপারেশন নিয়েই এর কাজে নামবেন।

প্রিয়.কম: সরকারী অনুদানের পরও সিনেমার কাজ এখনো শেষ হচ্ছে না কেনো? কি কি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে বলে মনে করেন?

প্রসূন রহমান: কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বিষয়টা হচ্ছে একটা ভালো কাজের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার, যেহেতু তারেক ভাই এর পরিকল্পনার কাজ, আর তিনি নেই, ফলে তার কাজটার প্রতি আরো যত্নবান হতে অনেক প্রস্তুতির দরকার। আমাদের দিক থেকেও ক্যাথরিনকে অনেক সহযোগীতা করা প্রয়োজন।

প্রিয়.কম: তিনি কী সেই সহযোগীতাগুলো পাচ্ছেন?

প্রসূন রহমান: প্রথম কথা হলো বাংলাদেশে ক্যাথরিনের থাকা দরকার। তারেক ভাই যেহেতু নেই, কাজের জন্য যেই অফিস প্রয়োজন সেটা মেইন্টেইন করতে যে অর্থ প্রয়োজন, কিংবা ক্যাথরিনকে এখানে থাকতে হলে তার যে আর্নিং দরকার সেই সুযোগটি তাকে আমরা করে দিতে পারছি না। তার পরিবারের সবাই অধ্যাপনা করেন, জীবিকার প্রয়োজনে এখন ক্যাথরিনকেও আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে হচ্ছে। আমরা যদি তাকে এখানে একটা কাজের সুযোগ করে দিতে পারতাম; তারেক মাসুদের নামে একটা ইনস্টিটিউট করতে পারতাম কিংবা অন্য কোনো ইনস্টিটিউটের মাধ্যমেও ক্যাথরিনকে রেখে দিতে পারতাম- তাহলে ক্যাথরিনের মেধাকে আমরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। ক্যাথরিনের এখান থেকে নেওয়ার কিছু নেই, কিন্তু আমরা ক্যাথরিনের কাছ থেকে নিতে পারতাম অনেক- সেই সুযোগটা আমরা হারাচ্ছি।

প্রিয়.কম: সেই রকম কোনো উদ্যোগ কী নেওয়া হচ্ছে?

প্রসূন রহমান: আমার জানা মতে, সে রকম কোনো উদ্যোগ নাই। তারেক ভাই এর প্রযোজনা সংস্থা অডিওভিশনকে তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট করা হয়েছে। সেখান থেকে তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করা হচ্ছিলো; কিন্তু যেহেতু কোনো আয়ের মাধ্যম নেই, ফলে এটা মেইন্টেইন করতেও ক্যাথরিনের কষ্ট হচ্ছিলো। এই ট্রাস্টের উদ্যোগে আরো কিছু কাজ করার পরিকল্পনা ছিলো- যেমন তারেক ভাই এর সমাধিস্থল ফরিদপুরে একটা লাইব্রেরিসহ একটা কম্পাউন্ড করার প্রিপারেশন ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এই কাজগুলো সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে ক্যাথরিনকে আমরা কোনো সহযোগীতা করতে পারছি না। কলকাতায় সত্যজিত ফিল্ম ইনস্টিটিউট হয়েছে, আমরা যদি সেই আদলে তারেক মাসুদ ফিল্ম ইনস্টিটিউট করতে পারতাম তাহলে হয়তো ক্যাথরিনকে এবং তার মেধাকে ব্যবহারের সুযোগ পেতাম। এটি একটি ভালো উদ্যোগ হতো হয়তো তারেক ভাই এর কাজগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে।  

প্রিয়.কম: তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতি উনার আলাদা এক মমত্ববোধ ছিল, আপনি নিজেও হয়তো তা অনুভব করেছেন। তরুণদের নিয়ে তার আশাবাদ কী ছিল?

প্রসূন রহমান: তরুণরা যেমন উনাকে পছন্দ করতেন, উনিও তরুণদের সান্নিধ্য বেশ ভালোবাসতেন। আমাদের এখানে তো ইন্সপায়ার করার মানুষ অনেক কম, নতুনদেরকে সবাই সুন্দরভাবে স্বাগত জানান না। শুধু চলচ্চিত্রই নয়, তিনি মনে করতেন সবকিছু তরুণরাই এগিয়ে নিয়ে যায়। তারেক ভাই যেটা বলতেন- সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মকে হস্তান্তর করে যাবে। আর তরুণরাই এই অগ্রযাত্রায় অগ্রগামী হয়ে আলোর প্রজ্জ্বলনকে দীর্ঘায়িত করে।

প্রিয়.কম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার টিকে থাকা বেশ কঠিন একটা বিষয়, তিনি সেই চ্যালেঞ্জটাই গ্রহণ করেছিলেন, কেমন  ছিল তার সেই যুদ্ধ?

প্রসূন রহমান: শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা চ্যালেঞ্জ ফেস করেই এগিয়ে যায়। একজন স্বাধীন নির্মাতার কাছে অর্থ উপার্জনের চেয়ে স্বাধীনতার গুরুত্বটাই বেশি, সে তখন প্রতি মুহূর্ত চ্যালেঞ্জ ফেস করে এগিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে হয়তো প্রতিবন্ধকতাটা একটু বেশি। তারেক ভাই যেটা বলতেন- “আমাদেরকে সহযোগীতা করতে না পারো, অন্তত বাধা দিয়ো না, আমাকে আমার মতো এগিয়ে যেতে দাও”। কিন্তু এখানে একজন স্বাধীন নির্মাতাকে আমরা সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলছি, এটা আমাদের অবকাঠামোগত ব্যর্থতা। তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়, পৃথিবীর অনেক দেশের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তার সিনেমা টেক্সট ফিল্ম হিসাবে পড়ানো হয়, বাংলাদেশে তার ফিল্ম কোনো সিনেমা হলে রিলিজ হয় না। আমাদের হলগুলোতে শিল্পসম্মত এবং সৃজনশীল চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

প্রিয়.কম: তার নির্মিত সব চলচ্চিত্রগুলো জীবন ঘনিষ্ঠ সব বিষয় নিয়ে, একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তার স্বপ্নকে কীভাবে দেখেছেন?

প্রসূন রহমান: তিনি সব সময় মুক্তির কথা বলতেন, আত্মউপলব্ধির কথা বলতেন। তার সব ছবিতেই দেখবেন মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। যে কোনো সমাজ সচেতন নির্মাতারই কাজ সেটি, উনিও তাই করে গেছেন। তার আরো অনেক ভালো কাজের স্বপ্ন ছিল,পরিকল্পনা ছিল, বেঁচে থাকলে তার আরো অনেক বিশ্বমানের কাজ দেখতে পেতাম আমরা।

তারেক মাসুদ

প্রিয়.কম: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন, যমন- মাটির ময়না, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, নারীর কথা। ব্যক্তিগত আবেগে তাড়িত হওয়ার কারণেই নাকি দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আলাদা টান?

প্রসূন রহমান: তিনটা বিষয়ের প্রতি তারেক ভাই এর ভীষণ দূর্বলতা ছিল- মুক্তিযুদ্ধ, নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। একটা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উনি মনে করতেন এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা উচিৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ।

প্রিয়.কম: প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা জীবন দর্শন আছে, তারেক মাসুদের মতো উচ্চতার একজন নির্মাতার জীবন দর্শন নিশ্চয় আর দশটা মানুষ কিংবা সচরাচর যে সব নির্মাতাদের দেখি, তাদের তুলনায় আলাদা...ব্যক্তি তারেক মাসুদকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

প্রসূন রহমান: আমরা জীবন যাপন করি, তারেক মাসুদ সিনেমা যাপন করতেন। তিনি অার ক্যাথরিন একই স্বপ্ন লালন করতেন। চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের সমস্ত ভাবনা ছিল। চলচ্চিত্রে সৃজনশীল ধারার আজ যা দেখি তার সবকিছুর পেছনেই তাদের দুজনের অনেক অবদান আছে।

প্রিয়.কম: আপনি নিজেও একজন নির্মাতা, ‘ফেরা’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তার জীবনকে কেন্দ্র করে, কী মেসেজ ছিল সেখানে?

প্রসূন রহমান: তারেক ভাই সব সময় এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেন যে আমার কাছে মনে হয়েছে তার সব কথাই ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজন আছে। এই প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে এর কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা আমি করেছি। তিনি চলে যাবেন আমরা তো আর সেটা জানতাম না, তবে শেষ সময়টা তার সব কথা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। সমাজ-রাজনীতি, চলচ্চিত্রসহ প্রায় প্রতিটা বিষয় নিয়ে তার নিজস্ব ভাবনা ছিল, পরিকল্পনা ছিল। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো হইয়েছে যে এটা যে সিরিয়াস ওয়ার্ক অব আর্ট- এটা আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেকভাবেই। শিল্পের সবগুলো জায়গা যেখানে এসে মিলিত হয়, সেটা চলচ্চিত্র। সব থেকে মেধাবী এবং শিক্ষিত মানুষের কাজ হচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাতা। ফলে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার জগতের সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। ফেরাতে তারেক ভাই এর একদিনের একটা জার্নি দেখানো হয়েছে, এটা আসলে সমগ্র তারেক মাসুদকে ধারণ করে না। তিনি তার বাবা-মা এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, সেখানেই ফেরার পথে গাড়িতে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। ভিডিওটি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ছিল, সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য চল্লিশ মিনিট নিয়ে ফেরা তৈরি করা হয়। সমগ্র জীবনকে ধারণ না করলেও, তারেক ভাইকে জানার জন্য ফেরা  এক্টি উল্লেখযোগ্য কাজ।

প্রিয়.কম: আমাদের দেশে যে কোনো শিল্পী বা গুণী মানুষ চলে যাওয়ার পর কিছুদিন তাদের নিয়ে আলোচনা চলে, এক সময় আমরা ভুলে যেতে শুরু করি। জন্ম বা মৃত্যু দিবস ছাড়া আর কোনো বিশেষ কোনো গুরুত্ব তাদের থাকে না বললেই চলে। তাদের সংগ্রহের ব্যাপারেও এক ধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। তারেক মাসুদের কাজগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানেন কী?

প্রসূন রহমান: ট্রাস্টকে ক্যারি করা যেহেতু ক্যাথরিনের জন্য কষ্টের হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ফিল্ম আর্কাইভে কিছু কাজ যাচ্ছে, আমাদের তো আর কিছু নেই যেখানে এসব সংগ্রহ করা যায়। ট্রাস্ট্রের উদ্যোগে একটা সংগ্রহশালা হতে পারতো, যদি ক্যাথরিন এখানে সার্ভাইব করতে পারতেন। চলচ্চিত্র আর্কাইভে হয়তো আমরা একটা কর্নার পাবো বলে আশা করতে পারছি। 

প্রিয় বিনোদন/গোরা