কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

পেইন্টিং: কারমেন গুয়েদেজ

প্রীতম চক্রবর্তীর 'অন্দরমহল'

প্রিয় ডেস্ক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:২৭
আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:২৭

(প্রিয়.কম) প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য আজ থাকছে তরুণ লেখক প্রীতম চক্রবর্তীর ছোট গল্প 'অন্দরমহল'

 

অন্দরমহল

সন ১৮৮০। উদয়পুরের জমিদার আদিত্য নারায়ণের নায়েব রাধাকান্ত ভীষণ চিন্তিত। আজ জমিদারবাবু সকালে ঠিকমত কিচ্ছু খেতে পারেননি। তাকে দেখতেও কেমন ছন্নছাড়া লাগছে। জমিদারের মন কি খারাপ? তার কি কোনো অসুখ হয়েছে? না না উনার সাথে একবার কথা বলে দেখা দরকার।

 

-জমিদারবাবু, প্রণাম।

-হুম।

-আজ্ঞে কিছু কথা ছিল।

-বলে ফেল রাধাকান্ত।

-মহলে এসে খবর পেলাম আপনি নাকি খাওয়াদাওয়া ঠিকমত করছেন না? তা আপনি এভাবে অনিয়মে থাকলে তো শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ইশ কত্ত শুকিয়ে গেলেন এ কয় দিনে...

 

জমিদার আদিত্য নারায়ণ তার বিশাল বপু নাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে নায়েবমশায়ও যেন একটু বেশি সোজা হয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করল।

 

-বুঝলে নায়েবমশায় মনটা ভাল নেই, বড্ড উদাস। শরীর তো চলে মনের কথায়, কি বল? মন ভাল না থাকলে শরীর তো ভাল থাকার কথায় না।

-হে হে হে (তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে রাধাকান্ত বলতে লাগল) তা ঠিক বলেছেন। মন আগে ভাল করা দরকার। চলুন না, একটু আশপাশটা ঘুরেফিরে দেখে আসি।

-মন্দ বলনি।  চল, অনেকদিন আমার প্রজাদের দেখি না। তাদের তো আমাকেই দেখতে হবে। কি বল?

-তা ঠিক বলেছেন। আপনি না দেখলে প্রজাদের আর কে দেখবে? আপনিই তো তাদের মা বাপ। তাহলে আপনি সজ্জিত হয়ে আসুন, আমি ঘোড়সওয়ার প্রস্তুত করছি।

-ঠিক আছে, যাও।

 

জনাপঞ্চাশেক পেয়াদা পেছনে হাটছে। সবার সামনে জমিদার আদিত্য নারায়ণ তার সাদা রঙের ঘোড়ায় মৃদু গতিতে এগিয়ে চলেছেন। তার পাশে আরেকটি ঘোড়ায় রাধাকান্ত।

-কেমন লাগছে জমিদারবাবু?

-হুম, ভালই। প্রকৃতির সান্নিধ্য আসলেই দেহমনের জন্য উপাদেয়। মন ভাল হতে শুরু করেছে নায়েবমশাই। তোমার তুলনা নেই।

-হে হে হে।

জমিদার হাত তুলে বললেন, হাসি থামাও। ওই মেয়েটি কে?

-(একটু অপ্রস্তুত হয়ে নায়েব জবাব দিল)কোন মেয়ে?

 

জমিদার আঙুল তুলে দেখাল মেয়েটিকে। মেয়েটি মাথা দুলাতে দুলাতে যাচ্ছিল। জলভর্তি কলসি তার কাখে নেয়া, মাথার দুপাশে দুই বেণী। চোখে গাঢ় কাজলের রেখা।জমিদারের বহর দেখে সে থমকে দাঁড়াল।

 

- (নায়েব বলে উঠল) ওই মেয়ে? ও তো আমাদের মনুচাষার মেয়ে। নাম হীরণ। ভাল গান গাইতে পারে শুনেছিলাম। (মেয়েটির দিকে তাকিয়ে), এই হীরণ শুনে যা।

হীরণ ভয় পেয়ে গেল। তার গলা শুকিয়ে আসছে। জমিদারের মানুষ তাকে ডাকবে কেন? সে কলসি ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। মাটির কলসি খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে রইল।

 

- আরে বেয়ারা মেয়ে তো দেখি, আমি ডাকলাম শুনল না। এই মেয়ে দাড়া, এই মেয়ে.....

-নায়েবমশাই

-আজ্ঞে জমিদারবাবু?

-মন বড্ড বেশি উদাস হয়ে গেল যে,  আজ রাতে তো  গান না শুনলে আমার ঘুম আসবে না।

-গান না শুনলে মানে?...........  ও আচ্ছা, আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। আপনি কোনো চিন্তাই করবেন না। আপনি মহলে ফিরে চলুন। আমি আপনার মন ভাল করার ব্যবস্থা করছি।

 

মনু চাষা তার দাওয়ায় বসে হুকা টানছিল। হীরণ দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।

-কীরে মা, এম্নে কোথা থে এলি? হাপাচ্চিস ক্যা? বলরে মা।

-বাবা, জমিদারের নোক আমারে ডেকেচিল। আমি পালিয়ে এচি।

 

মনু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, তার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করল। সে বেশ চিন্তিত। কিছুক্ষণ পরে নায়েব রাধাকান্তের গলার হাক শোনা গেল। তার পেছনে জনাদশেক পেয়াদা।

 

-কইরে মনু?

-আজ্ঞে?

-তোর মেয়েতো বেশী ভীতুরে। আমি ডাকলাম, সে কলসি ফেলে চলে এল। জমিদারবাবু বড়ই দুঃখ পেয়েছে রে। আমি তাকে বুঝিয়েছি।  সমস্যা নেই, তিনি রাগ করেননি। তোর মেয়ে ভাল গান জানে শুনে তিনি বেশ খুশিই হয়েছেন। নে মেয়েটাকে তৈরি কর। আজ তিনি তোর মেয়ের গান শুনবেন। তোর তো কপাল খুলে গেলরে মনু। জমিদারের অন্দরমহলে তোর মেয়ে গাইবে। আর শোন কাল সকালে গিয়ে আমার কাছ থেকে পাচটা কলসের দাম নিয়ে নিবি। জমিদারবাবু নিজেই তোকে দিচ্ছেন। কই মেয়েকে তৈরি কর।

 

-(মনু হাতজোড় করে রাধাকান্তের সামনে বসে পড়ল) বাবু, মা মরা মেয়ে আমার।  দয়া করগো বাবু, দয়া....

- আহ, আমি জানতাম এমনই করবি হারামজাদা। এই, তোরা কি দেখছিস? মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আয়। 

 

হীরণ যখন তার বাবাকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছিল, তার বাবাকে তখনও তারা মারছিল।

 

-শোন মেয়ে, আমার নাম জাহানারা। আমি এই অন্দরমহলের দেখাশোনা করি। জমিদার সবাইকে এখানে আসার সুযোগ দেন না। তোমাকে তার মনে ধরেছে। আজ রাতে তিনি তোমার গান শুনবেন বলেছেন। এই নতুন শাড়িটা পড়ে নাও। এহ, গায়ে কি দুর্গন্ধ! কয়দিন স্নান করিস না, হারামজাদী? যাহ স্নান করে আয়, আমি তোকে সাজিয়ে দিচ্ছি।

 

ধাক্কা খেয়ে হীরণ উঠে দাঁড়াল।  সে কেমন যেন ভরসাহারা দৃষ্টিতে চারদিক দেখছে। তার চোখে এখনও তার বাবার চেহারাটা ভাসছে। তারা কি বাবাকে ছেড়ে দিয়েছে?  নাকি এখনো মারছে?

 

জাহানারার মেয়েটাকে খুব ভাল লাগল। কি সুন্দর চেহারা। সাজালে একদম প্রতিমার মত লাগবে মেয়েটাকে। সে ঠিক করল, হীরণকে তার মনের মত করে সাজাবে আজ, ঠিক যেমন করে মা তার মেয়েকে সাজিয়ে দেয়।

 মেয়েটার কথা ভেবে জাহানারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাত বছর আগের সেই রাতের কথা মনে হল তার, যেদিন সে প্রথম এই অন্দরমহলে পা দিয়েছিল।

 

-পরদিন সকালে সবাই দেখল, নতুন শাড়িতে পেচানো হীরণের দেহটা অন্দরমহলের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে।

 

সন ২০১৭,

আজ হীরণের ২৩ তম জন্মদিন। তার বাবা মেয়ের জন্মদিনে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এলেন উদয়পুরের জমিদারবাড়িতে। একসময় এই জমিদারদের নাকি খুব প্রতাপ ছিল।  মেয়ে অনেকদিন ধরেই বায়না করছিল। শহর থেকে দূরে তাই আসা হচ্ছিল না। আজকের দিনটা বিশেষ। তাই আজ মেয়ের আবদার রাখা যেতে পারে।  সাথে হীরণের মাও ছিল। তিনিও বেশ খুশি। হীরণ তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। মেয়ে খুশি থাকলে তারাও খুশি।

 

ঘুরতে ঘুরতে তারা মহলের মাঝামাঝি একটা কক্ষে চলে এল। এই ঘরের বাইরে লেখা আছে,” জমিদারদের অন্দরমহল হিসেবে ব্যবহৃত”।  হীরণের ঘরটা বেশ পছন্দ হল। সে তার মাকে বলে উঠল,

"ইশ, কি সুন্দর ঘর।  আগে মনে হয় আরো সুন্দর ছিল। এখানে যারা থাকত তারা কতই সুখী ছিল, তাই না মা? ইশ! এমন একটা মহলে আমি থাকতে পারতাম!!"

মনুচাষার মেয়ে হীরণের আত্মা এ ঘরেই ছিল। সেই আত্মাও আজকের হীরণের কথা শুনে আতকে উঠল।

প্রিয় সাহিত্য/সিফাত বিনতে ওয়াহিদ