কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ছবি: পেইন্টিংটি সংগৃহীত

প্রমিথ রায়হান-এর গল্প 'দৃষ্টিভঙ্গি'

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:৪৪
আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:৪৪

(প্রিয়.কম) আজ প্রিয় পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো প্রমিথ রায়হান-এর গল্প 'দৃষ্টিভঙ্গি' ।

মার্কিন বংশোদ্ভুত স্ত্রীর সাথে শরতের এক মিষ্টি কোমল বিকালে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো, খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু মাথার নিচ থেকে বালিশ সরে যাওয়াতে কোন এক সময়ে দেওয়ালের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিলো, সেই সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকবার কারণে দেওয়ালের সাথে মাথায় বাড়ি খেয়ে স্ত্রীর সাথে প্রেমময় সময় কাটানো থেকে বিরত হতে হয় বলে আতিকুলের বিরক্তির সীমা থাকেনা। তার মনে পড়ে স্বপ্নে যেমন শরৎকাল দেখছিলো আসলে এখন তা নয়। আগষ্ট মাসের শেষের সপ্তাহ, সেই হিসাবে এখনো বর্ষাকাল।

 

ছেলে বাড়ি ফিরবে- সংবাদটি শোনার পরপরই রাহেলা বেগম পুত্রের ঘর নিঁখুতভাবে গুছিয়ে দিয়েছে। আতিকুল বাড়িতে না আসলে সচরাচর এই ঘর গোছানোর কোন প্রয়োজন হয়না। তাই ধুলো ঝেড়েঝুড়ে, ধোয়া ফরসা বিছানার চাদর বিছানো থেকে শুরু করে এমনকি বাথরুমে নতুন টুথপেস্ট, সাবান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। সাদা-হালকা নীল বিছানার চাদর টানটান করে বিছিয়ে দেওয়া, কিছু পুরনো বইয়ের সমাহারে একটা ছোট্ট আকৃতির বইয়ের শেলফ, শেলফ থেকে দক্ষিণে একটা পড়ার টেবিল, তার পাশেই ল্যাম্প। হালকা নীল রঙের দেওয়ালের দিকে চোখ ফেরানোটা একটু কঠিনই বটে। কসরত করে চোখ ফিরিয়ে নিলে তা যখন প্রতিস্থাপিত হয় ছাই রঙা জানালার গ্রিলকে আড়াল করা সবুজ-লালের পর্দার উপর, সৌন্দর্যবিবর্জিত মানুষের মাঝেও তখন কাব্যভাব জেগে উঠতে বাধ্য। গল্প-উপন্যাস দূরে থাক, পাঠ্যবইয়ের বাইরে জীবনে একখানা কবিতাও কখনো পড়েনি আতিকুল। স্বপ্নভঙ্গ, তা থেকে নিদ্রাভঙ্গের পর নিজের ঘরের দিকে সমগ্র তাকিয়ে তাই আতিকুল সাহিত্যবিমুখতার জন্য বিমর্ষ অনুভব করে।

 

‘আতিকুল, আর কতো ঘুমাবি বাপ আমার? দশটা তো বেজে গেলো। তোর পছন্দের সেমাই বানাইছি। তাড়াতাড়ি এসে খেয়ে নে।’ সকালের নাশতার মানসম্পন্ন পরিবেশনের জন্য রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকা রাহেলা বেগমের কন্ঠস্বরে শহরবাসী পুত্রের প্রতি মমতার প্রকাশ স্পষ্ট।

 

বাথরুমে ফ্রেশ হতে যাবার আগে জননীর সোহাগের প্রত্যুত্তরে আতিকুল কোন জবাব দেয়না। দরজা বন্ধ করতে করতে বিস্তৃত হাসিতে তার গাল সামান্য ব্যথা করে। তার প্রতি মায়ের এই তীব্র ভালোবাসার সময়কাল খুব বেশী নয়। বড়জোর তিন বছর হবে। মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে পাঁচ বছর আগে শহরে গিয়েছিলো চাকরীর খোঁজে। আতিকুল কখনোই চালাক-চতুর ছিলোনা। বরং দুই পুত্রের মধ্যে কণিষ্ঠ পুত্রকে নিয়েই রাহেলা বেগমের সর্বদা দুশ্চিন্তা ছিলো। ছোটকাল থেকেই আতিকুল একটু হাবাগোবা স্বভাবের বলে নিজের স্বামীর উপরে সুযোগ পেলেই ঝাল ঝাড়তো রাহেলা বেগম। ছোট ছেলে বাপের মতো মিনমিনে স্বভাবের হয়েছে এমনটাই ছিলো তার অভিমত। আতিকুলের পিতা হাফিজুল ইসলাম নিজেও ছোট ছেলের স্বভাবচরিত্রে সীমাহীন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন বলে স্ত্রীর খোঁটা গায়ে মাখতেন না। তাছাড়া নিজের অন্তর্মুখী চরিত্রের জন্য আতিকুল কম হেনস্থা হয়নি। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে মারপিট থেকে শুরু করে নিজের মামাতো ভাই, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই- যে যখন সুযোগ পেয়েছে আতিকুলের উপরে নিজেদের আধিপত্য দেখাতে পিছপা হয়নি। এই নিয়ে রাহেলা বেগমের ক্রোধ এবং বিদ্রুপের কোন সীমা ছিলোনা। সারাজীবন স্বামীকে এমনটা দেখে এসেছে, তা নিয়ে কম জ্বালা তাকে পোহাতে হয়নি। এখন যদি ছোট ছেলেটাও এমন হয় তাহলে সে কোথায় যাবে? বড় ছেলে তরিকুলের সাথে আতিকুলের বয়সের পার্থক্য বারো বছরের। রাহেলা বেগমের আকাঙ্খিত ধূর্ত স্বভাবের হলেও বড় ছেলেটা আবার হয়েছে চূড়ান্ত স্বার্থপর। সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেছিলো। ক্যাপিটাল কিভাবে পেয়েছিলো সে খবর পর্যন্ত তারা বাপ-মা কেউ জানতো না। তিন বছরের মধ্যে ধাই ধাই করে তরিকুল পয়সা কামাতে শুরু করলো। বাড়ির কাছে হিশাম মিয়ার দোকান থেকে একটা বিড়ি খাওয়ার আগেও যাকে অনেক হিসাবনিকাশ করতে হতো সেই কিনা দুই হাতে কামানো শুরু করবার পর থেকে বাপ-মায়ের সামনে মাতাল হয়ে যাকে খুশী তাকে গালাগাল করতে সংকোচ বোধ করেনা। শেষমেষ বিয়েশাদী করে অল্পদিনের মধ্যেই নিজের বাড়ি করে আলাদা হয়ে যেতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি। নিজের বাপ-মায়ের কথা দূরে থাক ছোট ভাইটার কথা পর্যন্ত একটিবার ভাবলো না। ভাবলে কি চাকরীর জন্য আতিকুলকে ঢাকায় গিয়ে দুই বছর ধরে পচতে হতো? পাঁচ বছর আগে যখন ঢাকায় গিয়ে আতিকুল রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলো। বাপ-মাকে ছেড়ে একা একা নিজের চাচা-মামাদের বাসাতেও থাকেনি। সেখানে কিনা এখন এই ঢাকা শহরে করেকম্মে একা একা খেতে হবে? প্রথম বছরটা তো গেলো ঢাকা শহরের হালচাল বুঝতে বুঝতেই। অতি অল্প ভাড়ার একটা মেসে কোনভাবে চাষা স্বভাবের লোকজনের সাথে থাকতো। মদ খেয়ে হইহল্লা করা, তাস খেলতে খেলতে পরস্পরের সাথে হাতাহাতি করা আর মেয়েমানুষ নিয়ে কুৎসিত রঙ্গরসিকতা করা- এই নরকের মধ্যে আতিকুলকে টানা দুই বছর থাকতে হয়েছিলো। ঢাকা শহরে বসবাসের তৃতীয় বছরের শুরুতে তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে লরা এসেছে বাংলাদেশে। ঢাকা শহর দেখবে বলে। লরা আতিকুলের বন্ধু শাফায়েতের কি সূত্রে যেন আত্মীয় হয়। সেই সময়ের মধ্যে আতিকুল ঢাকা শহরের আদ্যপান্ত চিনে নিয়েছে। শার্টপ্যান্ট কিনতে বঙ্গবাজার কি ঢাকা কলেজের ফুটপাথের দ্বারস্থ না হয়ে ইয়েলো-ওয়েস্টেকস থেকে কেনে। ইংরেজী যা বলে তা এভারেজ বাঙ্গালীদের একসেন্ট থেকে ঢের ভালো। মোদ্দাকথা ঢাকা শহরের অলিগলি আতিকুল খুব ভালো চিনে গেছে ততোদিনে। এই অবস্থায় লরার মতো কাউকে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাতে তার কি সমস্যা হতে পারে? লরাকে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে আতিকুল তার সাথে খুব জমিয়ে ফেললো। লালবাগে পেস্তা বাদামের শরবত খাওয়া থেকে শুরু করে গুলশানের চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ফ্রাইড রাইস উইথ বিফ কারী- কমফোর্টের অভাব আর যাই হোক আতিকুলের হয়নি। তাছাড়া পোশাকআশাকও তার বেজায় পরিপাটি। নিঁখুতভাবে চুল আচড়ানো, শার্টের পকেটে ধবধবে সাদা রুমাল থেকে শুরু করে নিজের গেটআপের সাথে ম্যাচ করে পরা হালকা নীল রঙের সানগ্লাস, লরাকে দিব্যি পটিয়ে ফেললো। সেই প্রেম এতোটাই তুঙ্গে উঠলো যে নিজের বাপ-মায়ের সাথে এক প্রকার বিদ্রোহ করেই দুই বছরের প্রেম শেষে লরা আতিকুলকে বিয়ে করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করলোনা। এরপর একটা হার্ডওয়ারের ব্যবসা শুরু করে জমাট ব্যবসায়ী হতে আতিকুলকে আর কেই বা বাধা দিতে পারে? ছেলের তড়িৎগতির এই বিস্ময়কর রুপান্তরের কারণেই যে বাড়িতে আসলে সেমাই বানাতে তার মায়ের কোন আপত্তি থাকেনা এই সত্য আতিকুল ভালো করেই বোঝে।

 

ডাইনিংরুমে সেমাই খেতে খেতে জননীর অস্থির চাহনী আতিকুলের মনোযোগ এড়ায়না।

‘কি হইছে মা? কিছু বলবা?’

‘শোন বাবা, আজকে সন্ধ্যার সময় তোর বড় মামা আসবে। বাসায় থাকিস। তোর সাথে কি যেনো জরুরী কথা আছে।’

 

তার প্রতি মায়ের নব্য জাগ্রত ভালোবাসা নিয়ে আতিকুলের কোন রাগ নেই। বরং শৈশব থেকে যা চেয়েও পায়নি এখন তার বাড়াবাড়ি দেখতে আতিকুলের বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু তাই বলে জননীর অহেতুক এই স্বজনপ্রীতির ভার সে কেনো নেবে? ছোট থেকেই তো সে দেখে আসছে নিজের স্বার্থের বাইরে এক পাও তার বড় মামা এখলাসউদ্দীন কখনো আগায় না। এরকম এক লোকের প্রতি এতো দরদ দেখানোর কি আছে? আতিকুলের বাবার মৃত্যুর পরে রাহেলা বেগম বেশ অর্থকষ্টে পড়েছিলো। তখন এখলাসউদ্দীনের কাটা কাপড়ের জমজমাট ব্যবসা। দুই ছেলেকেও আলাদা ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছিলো। কই তখন তো বোনের বিপদে একটা পয়সা দিয়েও সাহায্য করেনি। সেই সময়ে আতিকুল বলতে গেলে বড় ভাই তরিকুলের হাতেপায়ে ধরে টাকার জন্য সাহায্য চেয়েছিলো। তার বড় ভাইটা বরাবরই বদমাইশ স্বভাবের। অনাত্মীয় হোক কি নিজের ছোট ভাই হোক, তার সামনে মাথা নিচু করে সাহায্য চাইছে এমনটা দেখলেই তৃপ্তির হাসি হেসে করুণা করার ভঙ্গিতে সামান্য সাহায্য করতো। ততোদিনে তার বড় ভাই সিমেন্টের ব্যবসার সাথে সাথে কনস্ট্রাকশন বিল্ডিঙের ব্যবসাতেও বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়েছে। টাকাপয়সা করে কি দেমাগ হয়েছে দেখো- নিজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত আপন দাদী, চাচার সাথে দেখা করতে দেয় না। তা ভাতিজা-ভাতিজীদের প্রতি আতিকুলের হৃদয়ে কি কম ভালোবাসা সঞ্চিত আছে? ছয় মাস আগেও যখন বাড়ি এসেছিলো ভাতিজা রুহুলের জন্য মার্কিন খেলনা পিস্তল এবং ভাতিজী তানিশার জন্য বার্বি ডল কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। যতো যাই হোক বড় ভাইকে তো আর সে পর করে দিতে পারেনা। তাছাড়া আতিকুল নিজে এখন বেশ বড় মাপের শহুরে ব্যবসায়ী- এই সত্যের সাথে পরিচয়ের পর থেকেই তরিকুল ছোট ভাইয়ের প্রতি ধীরে ধীরে মমতা অনুভব করতে শুরু করছে। কিন্তু বড় মামা এখলাসউদ্দীনের মধ্যে এখনো পর্যন্ত আতিকুল এরকম কোন সমীহই দেখেনি। তার মা তো সবই জানে। জানেনা? তারপরেও আহ্লাদ দেখো। বড় ভাই একবার বাসায় এসে ধন্য করে দিয়ে যাবে তার জন্য কতো রকমের প্রস্তুতি! বোনকে প্রয়োজনে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য না করলে কি হবে লোকটার আলগা ন্যাকামীর শেষ নেই। যখনই বোনের বাড়িতে আসবে ঠিকই পোলাও-খাসীর মাংস খেয়ে যাবে আর রান্নার আলগা প্রশংসা করে যাবে। অথচ তার বয়স হয়েছে সাতষট্টি, এইসব রিচ ফুড তার জন্য পুরোদস্তুর হারাম। তবুও বুড়ার জিভের লোভ কমেনা। আর এই নবাবের জন্য কিনা তার সন্ধ্যার সময়ে বাড়িতে থাকা লাগবে। রান্নাঘর থেকে কোন গন্ধ এখনো পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে সেদিকে এক পা না দিয়েও আতিকুল বিলক্ষণ জানে যে এখলাসউদ্দীনের জন্য আজকে রাতে ভালো খানাদানার বন্দোবস্ত করা আছে। তার মাতৃদেবী প্রয়োজন হলে সর্বস্বান্ত হয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে পর্যন্ত নেমে যেতে রাজি তবুও বড় ভাই বাড়িতে এলে ভালোমন্দ না খাইয়ে তাকে ছাড়তে রাজি নয়। এরকম মা যার কপালে জোটে তার ভাগ্যে নিজের অসহনীয় মামাকে সহ্য করে কথাবার্তা বলা ছাড়া আর কিই বা করার থাকতে পারে?

আজকে সন্ধ্যায় সে বাড়িতে থাকবে- মাকে আশ্বস্ত করে টানা ঘুম দেওয়ার পর পর খেয়ে নিয়ে আতিকুল বাড়ি থেকে বের হলো। যেই কয়েকদিন সে বাড়িতে আছে প্রতিদিনই কিছু না কিছু সময়ের জন্য সে হাঁটতে বেরোয়। আজকে বেরোবার আগে ভাইবারে লরার সাথে দশ মিনিটের মতো কথা বলে নিয়েছে। দুইদিন পরে লরা আমেরিকায় তার কাপড়ের ব্যবসার অগ্রগতি দেখতে যাবে- তাই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। স্বামীর এখানে সময় বেশ ভালো কাটছে জেনে লরা বেশ আনন্দিত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল হৃদয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। নীল আকাশে মেঘগুলো কি সুন্দর মিশে আছে! কয়েকদিন বেশ ভ্যাপসা গরম ছিলো। আজকে মিহি বাতাস দিচ্ছে। লরার সাথে কথাবার্তার পরে বাড়ি থেকে বেরোবার আগে সিগারেটের প্যাকেট ভুল করে ঘরে ফেলে এসেছে। তাই দুপুরের খাওয়ার পরে এখনো পর্যন্ত সিগারেট খাওয়া হয়নি। আশেপাশে কোন সিগারেটের দোকান চোখে পড়ছেনা। দুই একটা দোকান যাও পাওয়া গেলো সেখানে সিগারেটের লেশমাত্রও নেই। চিপস আর মোজো দিয়ে ভর্তি। আধাপাকা রাস্তা বলে বেশ সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। পায়ের স্যান্ডেল একটু এদিক-সেদিক হলেই ছিঁড়ে যাবে। আতিকুল নিজের উপরে বেশ বিরক্তবোধ করে। আরে এখন কি আর সেই দিন আছে? একটা কেনো দশজোড়া স্যান্ডেল সে কিনে বাড়িতে ফেলে রাখলে কার কি বলার থাকতে পারে? নিজের প্রতি সে বড্ড বেশী উদাসীন- এই ভেবে আতিকুল কিঞ্চিত বিষণ্ণ হলো।

 

হাশমত মিয়ার চায়ের দোকানে সিগারেট খুঁজতে এসে আতিকুল বিস্মিত হলো। কে ভেবেছিলো উৎপল, সামি, আর ইউসুফ এসে এখানে জম্পেশ আড্ডা দিতে বসবে? হাশমত মিয়াকে যখন চায়ের সাথে তিনটা গোল্ডলিফ দেওয়ার কথা বলেছিলো তখনো সে খেয়াল করেনি। একটু ভিতরে গিয়ে বসতেই সবার আগে উৎপলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে আর তাদের এড়িয়ে যাবার সুযোগ কোথায়?

‘কিরে তুই বাড়িতে আসলি কবে?’ বরাবরের মতো স্তিমিত গলায় উৎপল প্রশ্ন করে।

‘বেশী দিন না, ধর এক সপ্তাহ হবে। আইসাই দম ফালানোর কোন সুযোগ পাইতেছিনা। নাইলে তোদের লগে বইতে পারতাম।’ বলেই আতিকুল দ্বিধান্বিত হয়। এক্সকিউজটা কি কিঞ্চিত লেইম হয়ে গেলো?

‘শালা, আমাদের মধ্যে তুই ই উঠে গেলি। তোকে তো আর কয়দিন পর থেইকা আমরা স্যার কইয়া ডাকুম বইলা ঠিক করছি।’

ইউসুফের খোঁচা মারার স্বভাবটা এখনো গেলোনা। আতিকুল বড়ই বিব্রতবোধ করে। তারা সবাই স্কুলের বন্ধু। তখন থেকেই দেখে আসছে যে সুযোগ পেলেই মানুষকে খোঁচা মারা ইউসুফের এক স্বভাব। আতিকুল গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেই জবাব দেয় ‘তাই বলিস। তা তোর চাকরীর কি অবস্থা?’

‘চলতেছে। বাঁইচা আছি আর কি। তোর কথা শুনি। উন্নতি-তরক্কি কেমন? পুত্রের সাফল্যে আন্টি খুশী তো?’

উফ, কথায় কথায় খোঁচা না মারলে ইউসুফের ভাত হজম হয়না। বন্ধুর এই বক্র প্রবণতাকে আতিকুল কখনোই অনুমোদন করতে পারেনি। আরে বেটা বুঝলাম তুই স্কুলে আমাদের সবার মধ্যে সবচেয়ে বেশী মেধাবী ছিলি। এমনকি তাদের অংকের স্যার জ্যোতিনাথ পর্যন্ত ইউসুফের প্রতিভা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। জ্যোতিনাথ স্যারের এক মেয়ে ছিলো নাম আরতী। পুরা টাউনজুড়ে এরকম দ্বিতীয় কোন সুন্দরী নেই। জ্যোতিনাথ স্যারের কাছে ছেলেপেলে যে প্রাইভেট পড়তে যেতো তার অনেকগুলো কারণের প্রধান একটা কারণ আরতীকে একনজর দেখা। অথচ ইউসুফ শালাকে দেখো, এইসব নিয়ে কোনকালে মাথাই ঘামায় নি। জ্যোতিনাথ স্যার তাকে এতো করে অনুরোধ করতো প্রাইভেটে পড়বার জন্য। কিন্তু পিতার সমান পূজনীয় শিক্ষকের অনুরোধকে ইউসুফ থোড়াই কেয়ার করতো। মুখে কিছু বলতো না তবে তার সিদ্ধান্ত বদলানো যাবেনা এই নিয়ে সংশয়ের তিলমাত্রও সে কখনো রাখেনি। এতো ঘাড়ত্যাড়া হলে কি চলে? স্কুলে থাকবার সময়ে আতিকুল ইউসুফকে নিয়ে বড়ই বিব্রত থাকতো।হ্যাঁ এই কথা সত্য যে ইউসুফ কখনোই আতিকুলের মিনমিন স্বভাব নিয়ে তাকে বিরক্ত করতে আসেনি। এমনকি মারামারি পর্যন্ত না। কিন্তু সেটাই আরো বেশী করে আতিকুলের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতো। তাকে ধরে কখনো মারধর করলেও আতিকুল ইউসুফের প্রতি নিজের চাপা বিদ্বেষকে ন্যায্য মনে করার কোন কারণ খুঁজে পেতো। কিন্তু শুধু মেধার কারণে ইউসুফকে নিয়ে আতিকুল বিড়ম্বনায় ভোগে কার কাছে এই কথা বলা যায়? তবে আনন্দের বিষয় হলো নিজের মেধা, সম্ভাবনা এইসব নিয়ে ইউসুফের পক্ষে কিছুই করা সম্ভবপর হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেও ইউসুফ বিসিএস ক্যাডার হতে পারলো না। সমাজসেবা অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার হয়ে আর চাকরীর বাইরে চিরাচরিত আঁতলামী করে বেড়ায়। প্রতিষ্ঠিত হবার দিকে ঝোঁক না থাকলে কি হবে, শালার আঁতলামী করার স্বভাব বহু পুরনো। সুযোগ পেলেই দেশ, জাতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি লেকচার ঝেড়ে দেবে। এই কারণে আতিকুল পারতপক্ষে ইউসুফের সাথে কথাবার্তা বলতে আগ্রহী হয়না। আর শালার একখানা দেমাগী মনও আছে বটে। লরার সাথে তার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিলো ঢাকাতে। বিয়েতে উপস্থিত বন্ধুবান্ধবদের ড্রেসকোড ছিলো কমপ্লিট স্যুট, আর মেয়েদের জন্য কালো শাড়ী। শুনে শালায় এককথায় বলে বসলো যে আসতে পারবেনা। তার নাকি এতো নিয়মরীতি মেনে বিয়েবাড়ীতে যেতে কোন আগ্রহ নেই। আস্ত হামবাগ একটা। ভেতরে ভেতরে আতিকুলের প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো। শালার, দুই পয়সার একটা চাকরী জুটিয়েছিস কোনভাবে তোর এতো কিসের অহংকার? এতো যে লেকচার দিয়ে বেড়াস, কোথাও তো মাস্টারীর চাকরীও জ়োটাতে পারলিনা। তাহলেও তো আতিকুল সকল বিরাগ ভুলে গিয়ে অন্যদের কাছে গিয়ে শিক্ষক বন্ধুর সুনাম করতে পারতো। কিছুই তো করলি না জীবনে, খালি এর ওর দোষ ধরে বেড়ালি। এই তো সেদিনও রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশাল এক আঁতেল মার্কা লেখা ফেসবুকে পোস্ট করে বসলো। যার ভাবার্থ আতিকুল সংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে যা ভাবে ঠিক তার বিপরীত। বলে কিনা মুসলমানপ্রীতি থেকে রোহিঙ্গা নিয়ে আহাজারী করা অর্থহীন। কোন না কোন ছুতায় প্রচলিত জনমতের বাইরে কিছু একটা বলতে পারলেই যেন তার বিশ্বজয় করা হয়ে যায়। আঁতেল কোথাকার। আসলে আঁতলামী করে নিজের ব্যর্থতা ঢেকে রাখতে চায়। সে কি আর আগের সে আছে? এই আতিকুল সবই বোঝে, জানে। ঢাকা শহরে আছে পাঁচ বছর। মানুষ তো সে কম দেখলো না। আঁতলামী বলো আর দেশজাতি উদ্ধার করা বলো- একবার নাম কামাইতে পারলে মানুষ পিছনে ফিরে থাকায় না। তখন কোথায় ভেসে যায় বাকি সব। আতিকুল একবার ভাবলো ইউসুফকে প্রয়োজনীয় কিছু পরামর্শ দেবে কিনা। আজকাল টক-শোতে মানুষজনের যাওয়া আসা ডালভাত হয়ে গেছে। আশিটা টিভি চ্যানেলে একশো ষাট টক-শো। লোকজন ধরাধরি করে ইউসুফকে কোন একটায় পাঠিয়ে দেওয়া আতিকুলের জন্য কি এমন কষ্টের কাজ? বন্ধুর জন্য বন্ধু তো এটা করতেই পারে। কিন্তু ইউসুফের কাছে কথাটা সে পাড়বে কিভাবে? বন্ধুকে তো কম দিন হলোনা যে সে চেনে। হেসেই উড়িয়ে দিবে। তখন আতিকুলের আরেক দফা অপ্রস্তুত হওয়া। গেল বার যখন বাড়ি এসেছিলো তখন ইচ্ছা করেই ইউসুফের সামনে স্মার্টফোন বের করে তা ব্যবহার করছিলো। শালা নিজে ব্যবহার করে মান্ধাতার আমলের এক সেলফোন। ছিনতাইকারীরাও যেই মোবাইল ছিনতাই করতে লজ্জা পাবে। অথচ হারামীর ঘাউড়ামি দেখো, চোখ সরু করে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এইসব লোককে সাহায্য করবে সেই সাধ্য আতিকুলের কই? কোরআনেই তো বলা আছে যারা নিজেদের কোন সাহায্য করেনা আল্লাহও তাদের কোন সাহায্য করেনা। এইসব ঘাড় গোঁজ করে বেঁচে থাকা ব্যাকডেটেড চিন্তার মানুষদের নিয়ে হয়েছে যা মুশকিল। কিছুতেই সন্তুষ্ট হয়না। এইসব দিক থেকে তার বড় মামা এখলাসউদ্দীনের মতো মানুষেরা আবার অনেক ফ্লেক্সিবল। তারা পুরনো দিনের মানুষ হলেও বাস্তবতা বোঝে। এই যে আজকে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হবে, আতিকুল নিশ্চিত জানে এখলাসউদ্দীনের গলার স্বর একসময়ে তার প্রতি ভক্তিতে নুয়ে পড়বে। ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠার কথা শুনে আরো একবার মাখো মাখো কন্ঠে প্রশংসা করবে। ভাগ্নের দীর্ঘজীবনের জন্য দোয়া প্রার্থনা করবে। বোনের হাতের রান্না খাসীর মাংস-পোলাও খেয়ে তৃপ্তির যে চোয়া ঢেঁকুর তুলবে তার মাঝে কোন খাদ থাকবেনা। এরকম মানুষের সাথে কথা বলেও সুখ। আতিকুল জীবনে এই প্রথমবারের মতো মামার প্রতি প্রসন্নবোধ করে।

 

এখলাসউদ্দীনের সাথে আসন্ন সাক্ষাতের আনন্দে মাগরীবের আজান দেওয়া মাত্রই আতিকুল বাড়ির উদ্দেশ্যে দ্রুতগতিতে পা ফেলতে আরম্ভ করে। মামাকে বসিয়ে রাখাটা একেবারেই উচিত হবেনা।

প্রিয় সাহিত্য/সিফাত বিনতে ওয়াহিদ