কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

অপরাজেয় বাংলা। ছবি- বিশ্বরূপ গাঙ্গুলি

'অপরাজেয় বাংলা'- ইতিহাস যেখানে কথা বলে!

আফসানা সুমী
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ২১:০৫
আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭, ২১:০৫

(প্রিয়.কম) অপরাজেয় বাংলা। একটি ভাস্কর্যের নাম। মাত্র ৩ জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন এমন একটি ভাস্কর্য। কিন্তু এই ৩ জন মানুষ শুধু সংখ্যায় ৩। বস্তুত তারা একটি সমগ্র জাতির কথা বলছে। সেই জাতি যা দীর্ঘদিন শোষিত হয়েছে নিজ দেশেরই আরেকটি অংশ দ্বারা। সেই জাতি বায়ান্নতে যাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল ক্ষমতাসীনরা, কিন্তু তারা সেটা হতে দেয়নি। এই জাতি পঞ্চাশের মন্বন্তর দেখেছে, একটি সফল গণ অভ্যুথানের  পথ পেরিয়ে এসেছে। দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় তারা জেনেছে, পৃথক রাষ্ট্র না হয়ে উপায় নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই তারা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তারা পা ফেলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে, তাদের চোখে নেই মৃত্যুর ভয়। তারা কেউ ছিল কৃষক, কেউ ছাত্র, কেউ গৃহিণী। সময় তাদের সবাইকে দাঁড় করিয়েছে এক কাতারে। তারা সবাই যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা। 

দুইজন পুরুষ এবং একজন নারীর ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে এই সবকিছু। যে বাংলার ইতিহাস জানে, একাত্তরকে জানে তার চোখে জল এনে দেবে ‘অপরাজেয় বাংলা’। নামের মতোই দৃপ্ত তার ভঙ্গি। ডানদিকের মূর্তিটি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে হাতে ধরে রেখেছেন রাইফেল, তিনি প্রতিনিধিত্ব করছে বিশাল জনগোষ্ঠীর। তার প্রতিকৃতিটির মডেল হয়েছেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু। এক হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর অন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন যে টগবগে সাহসী তরুণ তার মডেল হয়েছেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে যে সেবিকা এগিয়ে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সাথে অকুতোভয়ে, একাত্তরে নারীদের অবদানের একটি অংশের প্রতিচ্ছবি তিনি। এই সাহসী নারীর প্রতিকৃতির মডেল হয়েছেন হাসিনা আহমেদ। 

ইতিহাস-

অপরাজেয় বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসুর উদ্যোগে। তবে এর শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদান ছিল অনন্যসাধারণ। সেই অবদানকে চিরস্মরনীয় করে রাখতে উদ্যোগী হয় ডাকসু। এজন্য বটতলার কাছেই তৈরি করা হয় একটি ভাস্কর্য। এটির নকশা করেন শিল্পী আব্দুল লতিফ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতীক সেই ভাস্কর্যকে কে বা কারা রাতের আঁধারে ক্ষতিগ্রস্থ করে। হ্যাঁ, স্বাধীন দেশে ঘটেছিল এই ঘটনা! স্বাধীনতার পরের বছরই। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, ডাকসু ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মাববুব জামানসহ ডাকসু নেতৃবৃন্দ এবার উদ্যোগী হন এমনভাবে ভাস্কর্য নির্মাণে যার ক্ষতি করাও হবে দুঃসাধ্য। ৬ ফুট শক্ত মজবুত বেদির ওপর এবার তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিকৃতি। নাম দেওয়া হয় স্বাধীনতা ভাস্কর্য। এটি আর শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের প্রতীক থাকে না, বরং ভাস্কর্যটি হয়ে ওঠে সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রতীক।

তবে ভাস্কর্যটির যথাযথ নামকরণের কৃতিত্ব দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর। তিনি দৈনিক বাংলায় নিজ উদ্যোগে একটি প্রতিবেদন করেন এই স্থাপত্যটি নিয়ে। সেখানে তিনি এটিকে ‘অপরাজেয় বাংলা’ হিসেবে আখ্যা দেন। সেখান থেকেই নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে এই নামই প্রতিষ্ঠিত হয়। 

১৯৭২ এ নকশার কাজ এরপর ১৯৭৩ সালে মূল ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৯ সালে। ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট, ব্যাস ৬ ফুট। ভাস্কর্যের বেদীর উচ্চতা ৬ ফুট। ১৯৭৯ সালের মহান বিজয় দিবসে সকাল ৯টায় ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করা হয়।  

ভাস্করের কথা-

‘অপরাজেয় বাংলা’ এর স্থপতি চিত্রশিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। তিনি জন্মগ্রহণ করেন সিলেটে। বর্তমান চারুকলা ইন্সটিটিউটের নাম পাকিস্তান আমলে ছিল ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস এন্ড ক্রাফটস। এখানে চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭২ সালে লেকচারার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন তিনি যুক্ত হন ডাকসুর উদ্যোগে ভাস্কর্য নির্মাণের কাজে। তার হাতেই সৃষ্টি হয় কলা ভবন প্রাঙ্গনের এই অমর ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র নকশা।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সামনে অবস্থিত অসাধারণ মুরাল ‘আবহমান বাংলা’র নকশাটিও করেছিলেন আব্দুল্লাহ খালিদ। ১৯৭৪ সালে করেন এই কাজটি। ১৯৯৫-৯৬ সালে নির্মাণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধাণ দপ্তরের সামনের টেরাকোটাটি। এছাড়া অঙ্কুর, অঙ্গীকার, ডলফিন এবং মা ও শিশুসহ আরও উল্লেখযোগ্য কীর্তির নির্মাতা তিনি।চটতগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। 

জীবন তাকে তার কাজের সম্মাননা দিতে কখনো পিছপা হয় নি। তিনি পেয়েছেন শিল্পকলায় একুশে পদক- ২০১৭, শিল্পকলায় বাংলা দর্পন সম্মাননা- ২০১৬, শিল্পকলা পদক-২০১৪।

২০১৭ সালের ২২ মে  ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলার এই কৃতি সন্তান। আজ তিনি পৃথিবীর বুকে নেই। কিন্তু তার অমর সৃষ্টি আজও বলে তার কথা। আজ থেকে আরও হাজারো বছর বলে যাবে এমনটাই স্বপ্ন আমাদের।

অপরাজেয় বাংলা

‘অপরাজেয় বাংলা’র বর্তমান অবস্থা-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেও নাকি জ্ঞান অর্জন হয়। বর্তমান অবস্থাও কি তাই? ‘অপরাজেয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য এ কথা সবাই জানেন। কি এই ভাস্কর্যের পেছনের কথা, কি বলতে চায় এই ভাস্কর্য তা কি জানেন এখানকার শিক্ষার্থীরা? প্রিয়.কম থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন প্রাঙ্গনে যাই। সেখানে দেখা যায়, ভাস্কর্যটিকে ঘিরে আছে নানান পোস্টার। এছাড়াও ভাস্কর্যের পেছনে জ্বলতে থাকা তীব্র ভোল্টের বাতিটির কারণে সন্ধ্যা নামতেই আঁধারে তলিয়ে যায় এটি। বেদিতে অসংখ্য মানুষকে বসে থাকতে দেখা গেল যা সত্যিই দুঃখজনক। ভাস্কর্যটির ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে আগ্রহী ছিলেন না কেউই।

ভাস্কর্যটিকে দেখতে ঢাকার বাইরে থেকে তো বটেই দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকরা আসেন। বাংলাদেশে নির্মিত তাৎপর্যপূর্ণ ভাস্কর্যগুলোর মাঝে এটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সেই অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। থাকা প্রয়োজন ইতিহাস সম্বলিত বই এবং প্রচারণা। আমাদের ভাস্কর্য আমাদের সম্পদ। আমরাই একে আরও ফোকাসে নিয়ে আসতে পারি। এতে আমাদের ভবিষ্যত তো ইতিহাস জানবেই পাশাপাশি জানবে বাইরের পর্যটকরাও।

 

সম্পাদনাঃ ড. জিনিয়া রহমান 

প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post।