কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

ত্রাণ নিতে আসা রোহিঙ্গা শিশু জানুবি ও তার ভাই। ছবি: প্রিয়.কম

‘আর বর্মাত ন ফিরত চাই’

সামিউল ইসলাম শোভন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:৫০
আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:৫০

(প্রিয়.কম, উখিয়া কুতুপালং থেকে) এক হাতে ত্রাণের বড় বাক্স, অন্য হাত দিয়ে কোলের এক বছরের ভাইকে সামলানো। সাত বছরের ছোট্ট জানুবি যেন তাল খুঁজে পাচ্ছিল না। সুযোগ ছিল আরও একটি বক্স নেওয়ার। কিন্তু হায়! ভাইকে কোলে নিয়ে তা একেবারেই অসম্ভব। চোখেমুখে হতাশা আর রাজ্যের অসহায়ত্ব নিয়ে তাই তাকিয়ে ছিল ত্রাণের লাইনের দিকে।

জানুবির পরিচয়, সে রোহিঙ্গা শরণার্থী। আপদকালীন বাসস্থান উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণের ওপর ভর করেই পেটের ক্ষুধা মেটাতে হচ্ছে। বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে তার সাত সদস্যের পরিবার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সে মেজো। বড় বোনের বয়স ১২।

শুধু জানুবি নয়, তার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু এখন বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছে। যারা এখনও বুঝতেই শিখেনি, জীবন বা বাস্তবতা কী, অথচ তাদের জীবন বাঁচাতে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

 

জানুবি জানায়, তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের আর্মিরা। শুধু তাই নয়, তার পুরো গ্রামই পুড়িয়ে দিয়েছে। এতটুকু মেয়ে চোখের সামনে মরতে দেখেছ অনেককে। ভয় আর আতঙ্ক যেন এখনও তাড়িয়ে ফিরছে তাকে।

হাসোজ্জ্বল রোহিঙ্গা শিশু শরণার্থী। ছবি: প্রিয়.কম

বার্মিজ ভাষায় সে যা বলল তা বোঝা দায়। তাই সাহায্য নিতে হলো দোভাষীর। তারই বরাত দিয়ে জানুবি বলে, আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা (মায়ানমার আর্মি)। পাশের বাড়ির দুইজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি আর বার্মায় যেতে চাই না।

জানুবির বাবা রহমত আলী (৪১) জানান, পরিবার নিয়ে মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার কথা বলতেই নাকি সবাই কেঁদে ফেলে। বীভৎস সেইসব স্মৃতি শিশুমনে কতটা দাগ কাটতে পারে তা যেন চোখের ভাষায় উচ্চারিত হচ্ছিল। কিন্তু দেশ ফেলে এই এখানে থাকার ইচ্ছা নেই জানুবির বাবা-মার।

বাবা রহমত বললেন, ওখানে আমার ভিটেমাটি। জমিজমা সব আছে। নিজের বাড়ি ফেলে আর কতদিন এখানে পড়ে থাকব! আপনারা সবকিছু ঠিক করে দেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমরা দেশে ফিরে যাই।

জানুবির অসহায়ত্ব। ছবি: প্রিয়.কম

জানুবি জানিয়েছে, এখানে সে ভাল আছে। বাংলাদেশ থেকে খাবার পাচ্ছে, কেউ বা কাপড়ও দিচ্ছে। সবাই একসাথে রয়েছে। তাই এখান থেকে সে যেতে চায় না। যদিও ভয়টা আবারও সেই মিয়ানমারে আর্মিদের অত্যাচারের।

সে বলেছে, এখানে খেতে পারছি। আমার ভাইকেও খাওয়াতে পারছি। ওখানে যেতে চাই না। গেলে আবার বাড়ি পুড়িয়ে দেবে। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে।’ বলতে বলতে পায়ের ক্ষতটা দেখাল।

কিন্তু অভিযোগ, শুকনো খাবারই খেতে হচ্ছে। যদিও এমন পর্যায়ে দুটো খেতে পাওয়াও যেন ভাগ্যের ব্যাপার। জানুবির ভাষায়, সবসময় বিস্কুট, মুড়ি খাইতে দেয়। চাল খুব কম পাই। চাল পাইলেও তরকারি পাই না। আমার ভাত খেতে ইচ্ছে করে।

একটুখানি খাবারের জন্য ত্রাণের লাইনে হুড়োহুড়ি। ছবি: প্রিয়.কম

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিনে দেখা গেছে, শরণার্থীদের বিশাল একটি অংশ শিশু-কিশোর। যাদের গড় বয়স ছয় মাস থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রোগবালাই সম্পর্কে অজ্ঞতা, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া, টানা শুকনো খাবার খাওয়া; সবমিলিয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশু-কিশোররা। ফলে ভাইরাস ও ডায়রিয়াজনিত রোগের মহামারী দেখা যাচ্ছে সেখানে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৯০ ভাগই হলো নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশু রয়েছে শতকরা ৬০ ভাগ। এর মধ্যে ১১শ’র বেশি রোহিঙ্গা শিশু পরিবার ছাড়া অচেনাদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আর এসব শিশুর চোখের সামনেই তাদের বাবা-মাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা, মা-বোনদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ঘর-বাড়িতে আগুন দেওয়াসহ ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে মিয়ানমারের সেনারা।

প্রিয় সংবাদ/রিমন