কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

এস এম সুলতানের সাথে নাসির আলী মামুন। ছবি: সংগৃহীত।

'জীবিত অবস্থায় বহুবার এস এম সুলতানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে': নাসির আলী মামুন

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০১৭, ২১:২৮
আপডেট: ১০ আগস্ট ২০১৭, ২১:২৮

(প্রিয়.কম) কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ৯৩তম জন্মদিন আজ। বরেণ্য এই চিত্রশিল্পীর জন্মবার্ষিকীতে প্রিয়.কম কথা বলে তাঁর এক সময়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের সাথে। ১৯৭৬ সালে পরিচয়ের পর থেকে শিল্পী সুলতানের অত্যন্ত স্নেহভাজনে পরিণত হোন নাসির আলী মামুন। জন্মবার্ষিকীর এই দিনে প্রিয়.কমের কাছে সেইসব স্মৃতিচারণ করেন নাসির আলী মামুন।   

প্রিয়.কম: আপনি তো শিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তার পোট্রেট তুলেছেনও। পরিচয় পর্বটা বলবেন কি?

নাসির আলী মামুন: শিল্পকলা একাডেমী থেকে এস এম সুলতানের একটা একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, সেখানেই ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়।

প্রিয়.কম: তিনি তো শুনেছি জীবন যাপন সম্পর্কে ভীষণ উদাসিন ছিলেন

নাসির আলী মামুন: ব্যক্তি জীবনে তিনি উদাসীন ছিলেন কিন্তু শিল্পী এস এম সুলতান মোটেও উদাসীন ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শিল্প ঘনিষ্ঠ মানুষ। মাটির ও মানুষের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি যখন ছবি আঁকতেন, তার মতো এত অর্গানাইজ লোক বোধহয় আর একটাও থাকতো না। সে রকম মানসিক এবং বাহ্যিক পরিবেশ তিনি গড়ে নিতেন। তার অসংখ্য ছবি আঁকার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম এবং সেগুলো আমি দেখেছি। মানুষ মনে করে তিনি অনেক উল্টাপাল্টা জীবন যাপন করতেন, হঠাৎ হঠাৎ হয়তো কাজ করতেন। আসলে কিন্তু সে রকম না, তিনি অনেক গভীর চিন্তার মানুষ ছিলেন। কৃষি সভ্যতার প্রতি তার আলাদা টান ছিল, এর সাথে যুক্ত মমত্ববোধ অতুলনীয়। এ জন্য দেখবেন, তার ছবি কিন্তু সমকালীন অন্য কোনো শিল্পীর সাথে মিলে না।  

প্রিয়.কম: একজন মানুষ হিসেবে এস এম সুলতানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?

নাসির আলী মামুন: তিনি অত্যন্ত মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। মাটি এবং কৃষিকাজে যুক্ত মানুষের সাথে এত নিবিড় সম্পর্ক বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীর ছিলো না, এখনো নেই।

প্রিয়.কম: তিনি বয়সে ছোটদেরও ‘আপ্নি-ভাই’ সম্বোধন করতেন বলে শুনেছি, আপনার অভিজ্ঞতা কী?

নাসির আলী মামুন: হ্যাঁ। আমাকেও তিনি ‘আপনি’ করে বলতেন। কোনোদিনও ‘তুমি’ বলাতে পারিনি। শিল্পী হিসেবে তিনি অন্য উচ্চতার মানুষ, তাই মানুষকে তিনি সম্মান দিতে জানতেন, ভালবাসতেও।

প্রিয়.কম: তার মধ্যে ডুয়েল পারসোনালিটির একটা বিষয় ছিল বলে জেনেছি, একদিকে তিনি যেমন নম্র, অন্যদিকে তিনি প্রতিবাদী-অগ্নিমূর্তি। আপনি তার দুটো রূপের সাথেই নিশ্চয় পরিচিত?

নাসির আলী মামুন: তিনি ভীষণ ডুয়েল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। একই সাথে তিনি একবার মানবিক, আবার মুহূর্তেই তিনি প্রচণ্ড নিষ্ঠুর।

প্রিয়.কম: একই সাথে কীভাবে মানুষ দুটো চরিত্রের অধিকারী হোন?

নাসির আলী মামুন: কেনো না? মানুষের মধ্যেই তো থাকে এ রকম। মানুষ একই সাথে মানুষ হতে পারে, একই সাথে সাপও হতে পারে। একদিকে পাখি হতে পারে, পরমুহূর্তেই কুমির হতে পারে। যে কোনো নিরীহ বা ভয়ংকর পশু-পাখির রূপ মানুষ ধারণ করতে পারে। পাখি কিন্তু হান্ড্রেড পার্সেন্ট পাখি হয়ে জন্মাবে, সাপও সাপ হয়েই জন্মায়। কিন্তু মানুষের বিভিন্নন রূপ ধারণ করার ক্ষমতা আছে।

প্রিয়.কম: আপনি কি তাঁর এই রূপের সাথে পরিচিত?

নাসির আলী মামুন: ডেফিনেটলি। এ জন্য আহমদ ছফা এবং আমরা বলতাম – এস এম সুলতানকে ৭২ ঘণ্টার বেশি সহ্য করা যায় না। ৭২ ঘণ্টার বেশি তাঁর সাথে থাকাই যায় না। আমি অবশ্য এক সাথে আট-নয়দিন থেকেছি, কিন্তু মনে হয়েছে হয় সুলতান ভাই আমাকে খুন করবে, না হয় আমি তাঁকে খুন করবো- এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো।

প্রিয়.কম: এই রকম কেনো হতো?

নাসির আলী মামুন: ওনার জীবন যাপনের মধ্যেই কতগুলো কেমিস্ট্রি ছিল যা সাধারণ মানুষের মধ্যে নাই। উনি বোহেমিয়ান, আমরা তা না। বাংলাদেশে সব শিল্পী কি বোহেমিয়ান? না। শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষই সাধারণ জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত।

এস এম সুলতান

ছবিটি নাসির আলী মামুনের তোলা। 

প্রিয়.কম: শিল্পী হিসেবে তাকে কীভাবে দেখেছিলেন?

নাসির আলী মামুন: আমি ছোট্ট করে শুধু একটামাত্র বাক্যে বলতে চাই- তিনি আমাদের সময়ের; আমাদের কালের এমন একজন শিল্পী, যিনি একাই শুরু, একাই শেষ। তাঁর মতো কেউ আগেও ছিল না, আসবে কিনা সন্দেহ।

প্রিয়.কম: তার জীবন দর্শন এর সাথে নিশ্চয় আপনার সংযোগ হয়েছিল?

নাসির আলী মামুন: কিছুটা। কিন্তু অনেক সময় সেগুলো নেওয়া যেত না। তার জীবন দর্শন খুব গভীর ছিল। অনেক সময় সেগুলো ধর্মের বিরুদ্ধে এবং মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে চলে যেত। যেমন উনি মনে করতেন- মানুষ মূলত নিষ্ঠুর এবং অসভ্য। শুধু শিক্ষায় কিছু কিছু মানুষকে সভ্য করে তুলছে, তাছাড়া বেসিক্যালি মানুষ অসভ্য এবং ভীষণ স্বার্থপর।

প্রিয়.কম: মানুষের প্রতি উনার এই ধারণাই কি তাকে জীবজন্তুর কাছাকাছি এনেছে?

নাসির আলী মামুন: তিনি বলতেন জীবজন্তুর কোনো স্বার্থ নেই। বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বসবাস করে গেছেন। সাপ-বেজি-খরগোশ-বিড়াল-বনমোরগ-প্যাঁচা-দাঁড়কাকসহ আরো অনেক পশুপাখি তাঁর কাছে পোষ মেনে থাকতো। পশুপাখিরা নাকি তাঁর সাথে কথা বলতো এবং তিনিও ওদের সাথে কথা বলতেন।  

প্রিয়.কম: অধিকাংশ সময় তিনি গ্রামে সময় কাটাতে চাইতেন, আপনি সেখানেও গিয়েছেন, কাছ থেকে দেখেছেন- কেমন দেখেছিলেন লাল মিয়াকে?

নাসির আলী মামুন: হ্যাঁ অসংখ্যবার গিয়েছি চিত্রা নদীর পাড়ে তাঁর সেই গ্রামে। গ্রামের মানুষের সাথে একই সাথে তাঁর সুসস্পর্ক ছিল, আবার সন্দেহ-অবিশ্বাসের একটা ব্যাপারও কাজ করতো। মূলত তিনি মানুষকে অবিশ্বাস করতেন। তিনি ভাবতেন তারা তাঁকে মারতে চায়, তাঁরা বাড়ি দখল করতে চায়, আর্ট চুরি করে নিয়ে যেতে চায়, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে চায়। উনি যে উচ্চতার শিল্পী, সারাক্ষণ তো কাজে মগ্ণ থাকতেন। উনি তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন না, ফলে উনার চিন্তা, উনার জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। অন্য দশজন গ্রামের মানুষের সাথে উনার মিলতো না বলেই উনি সন্দেহ করতেন। কিন্তু গ্রামের মানুষরা তাকে পছন্দ করতেন, অনেকে পীরও মনে করতেন।

প্রিয়.কম: এস এম সুলতানকে কী তার সময়ে বা এখনো আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি?

নাসির আলী মামুন: বাংলাদেশের ইতিহাসে এস এম সুলতান দূরূহ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিংবদন্তিতূল্য একজন চিত্রশিল্পী। যিনি জীবিত অবস্থায় বহুবার তাঁর বন্ধুর বেশে, চিত্রশিল্পী বেশে, সাংবাদিকের ছদ্মবেশে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, নানা ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে করা হয়েছে। তিনি যাতে ছবি আঁকতে না পারেন, উনি যাতে ঢাকায় এসে কোথাও থাকতে না পারেন, উনি যাতে কোথাও প্রদর্শনী করতে না পারেন, চারুকলার বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের চত্বরে যেন উনি প্রবেশ করতে না পারেন- এই রকম বন্দোবস্ত করছিলেন আমাদের দেশের অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পীরা। কিন্তু আজকে দেখেন এস এম সুলতান কোথায় আছেন, আর তারা কোথায়? এস এম সুলতান বোহেমিয়ান, দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম, উনার কোনো ঘর-বাড়ি নেই, পরিবার নেই, কিছুই নেই। অথচ আজকে আপনাদের প্রজন্ম তাঁকে জানতে চায়। কিন্তু এখনো মৃত্যুর পরও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র জারি আছে।

প্রিয়.কম: তাঁর কাজ সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ কী নেওয়া হচ্ছে?

নাসির আলী মামুন: বাংলাদেশে কারো কাজ কি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে? কোনো সরকারই কি বাস্তবিক সে চেষ্টা করেছে?

প্রিয় বিনোদন/গোরা