কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

সাঁতার না পারা রোহিঙ্গা শিশু নবী ড্রামে ভেসে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। ছবি: সংগৃহীত

ড্রামে ভেসে বাংলাদেশে সাঁতার না পারা রোহিঙ্গা বালক

জাহিদুল ইসলাম জন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ২১:১৪
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ২১:১৪

(প্রিয়.কম) বছর তেরোর রোহিঙ্গা বালক নবী জীবনে সমুদ্র দেখেনি। জানে না সাঁতার। তবুও জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে ভর করে নাফ নদীতে ঝাঁপ দেয় নবী। আড়াই মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের শাহ পরীর দ্বীপে পৌঁছায় এই রোহিঙ্গা বালক।

সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালাতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা এখন এতটাই বেপরোয়া যে, তারা কেউ কেউ সাঁতরে নাফ নদী পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন। মাত্র এক সপ্তাহে তিন ডজনেরও বেশি রোহিঙ্গা তরুণ বাংলাদেশে পৌঁছেছে। তেলের ড্রাম ব্যবহার করে তারা নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছাচ্ছেন।

গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরহিত নবী বলেন, ‘আমি মৃত্যুকে ভয় পাই। ভাবছিলাম এটাই হয়তো আমার শেষ দিন।’

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসলেও দেশটির সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা মনে করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ জনগোষ্ঠী। মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। জাতিসংঘ বলছে, রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। গত আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধরা নতুন করে নিপীড়ন শুরু করলে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

তেলের ড্রাম ধরে ভেসে আসা আরেক যুবক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এতটাই নিপীড়িত যে, মনে হয়েছে পানিতে ডুবে মরা হয়তো এর চেয়ে ভালো হবে।’

নবীর মতো অনেকেই জীবন বাঁচাতে তেলের ড্রামে ভাসাকেই ভরসা করেছে। ছবি: হিন্দুস্তান টাইমস
নবীর মতো অনেকেই জীবন বাঁচাতে তেলের ড্রামেকেই অবলম্বন করে নাফ নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত 

নতুন দেশে নবী কাউকে চেনে না। হাসতে ভুলে গেছে, চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলতে যেন ভুলে গেছে এই শিশু। এখনও মিয়ানমারে থাকা বাবা-মা জানে না, নবী বেঁচে আছে কিনা।

মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকায় ছিল তার বাড়ি। পানচাষি বাবার নয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সে। কখনও যাওয়া হয়নি স্কুলে। দুই মাস আগে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যার পর নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় অভিযান শুরু করে, গুলি করে মানুষ হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ করে রোহিঙ্গা নারীদের। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের ঘরবাড়ি। নবী দেখেছে, তার গ্রামে একের পর এক বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত উপকূলের দিকে পালাতে শুরু করে নবীর পরিবার। অসংখ্য মৃতদেহ পেছনে ফেলে উপকূলে পৌঁছে শতশত রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশে আসার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে সে। নৌকায় করে তাদের সমুদ্র পার করে দিতে চাওয়া হয় টাকা। কিন্তু তখন আর কোনো সম্বলই অবশিষ্ট নেই নবীর কাছে।

প্রতিদিন কমে আসছে খাবার। চার দিনের মাথায় নবী বাবা-মাকে জানায়, কাছেই তো দেখা যাচ্ছে শাহপরীর দ্বীপ। সাঁতরেই পাড়ি দেবে সে।

দুই মাস আগে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন নবীর বড় ভাই। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, জানেন না বাবা-মা। এ অবস্থায় আরেক সন্তানকে ছাড়তে কোনোভাবেই রাজি ছিলেন তারা। নবীর বাব-মায়ের আশঙ্কা, নদীর তীব্র স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে সমুদ্রে। শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হন এই জেনে যে, নবী একা যাবে না। পরে অবশ্য ৩ নভেম্বর বিকেলে অন্য ২৩ জনের সঙ্গে রওনা দেয় নবী। নদীর পাড়ে তাকে বিদায় জানায় বাবা-মা। বিদায়ের সময় নবী মাকে বলে আসে, ‘দোয়া করবেন আমার জন্য’।

নবীসহ প্রত্যেকে তেলের ড্রাম বেঁধে নেয় বুকের সঙ্গে। আর প্রতি তিনজন একে অপরের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নেয়। সাঁতার না জানা নবী ছিল তিনজনের মাঝখানে। অবশেষে তারা ভেসে পড়ে নদীতে। আর নদীর স্রোত তাদের টেনে নিয়ে চলে বাংলাদেশের দিকে। এভাবে আসার পথে কখনো তৃষ্ণা মেটাতে, আবার কখনো ঢেউয়ের ধাক্কায় পানি খেয়েছে নবী। পাগুলো ব্যথায় কুকড়ে উঠেছে, কিন্তু পেছনে ফিরে দেখেনি নবী। সূর্য ডোবার পর নবীদের দলটি পৌঁছায় শাহ পরীর দ্বীপে। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে তখন বিধ্বস্ত তারা।

নবী এখন পরিবারহীন, একা। নবীর মতো আরও ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু নিঃসঙ্গ অবস্থায় বাংলাদেশে রয়েছে। বিড়বিড় করে নবীর শুধু একটিই চাওয়া, বাবা-মা আর শান্তি।

পরের দিন বিকেলে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ নদীর মাঝে আরও কিছু মানুষকে আবিষ্কার করে। তারাও নবীর মতোই হলুদ প্লাস্টিকের ড্রামে ভেসে বাংলাদেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। অবশেষে তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়।  

প্রিয় সংবাদ/শান্ত