কক্সবাজারের বালুখালির একটি রোহিঙ্গা শিবির। ছবি: প্রিয়.কম
জাতিসংঘের বিবৃতি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত করবে: সু চি
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:২৯
(প্রিয়.কম) রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমার। দেশটি বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদের এ বিবৃতি বিতাড়িত ৬ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে সর্বশেষ এ রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হয়। সে থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সর্বশেষ এ রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরুর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সর্বশেষ ৬ নভেম্বর সোমবার এ বিষয়ে বৈঠকে বসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। বৈঠক শেষে সর্বসম্মতভাবে দেওয়া বিবৃতিতে (প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট) রোহিঙ্গাদের প্রতি ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের ওপর বলগ্রয়োগ বন্ধের দাবি জানানো হয়।
জাতিসংঘের বিবৃতিতে রাখাইনে অতিমাত্রায় সামরিক আগ্রাসন বন্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানায় নিরাপত্তা পরিষদ। রাজ্যটিতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। আর তা রাখাইনে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হওয়া উচিত বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে জাতিসংঘকে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয় নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়নের ঘটনা আঞ্চলিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে বিবৃতিতে। একইসঙ্গে ৩০ দিন পর মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের এ বিবৃতির জবাবে ৭ নভেম্বর বুধবার দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দফতর থেকে আরেকটি বিবৃতি দেওয়া হয়। সু চির দফতরের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের যে আলোচনা চলছে, তাতে ‘মারাত্নক ক্ষতিকর প্রভাব’ ফেলতে পারে।
কেবল মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সমস্যা সমাধান করতে পারে, তাও জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।
মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তারা বাংলাদেশের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ মাসের ১৬-১৭ তারিখ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর মিয়ানমার সফরের কথা রয়েছে। তার একদিন আগে অর্থাক ১৫ নভেম্বর দেশটি সফর করবেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন।
সংঘাত শুরুর পর থেকেই রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফাইল ছবি
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা একটি নৃগোষ্ঠীর নাম যাদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইসলাম ও ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গাদের আদি আবাসস্থল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শত শত বছর ধরে রাজ্যটিতে বাস করা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে মিয়ানমার সরকার এ জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালাচ্ছে।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার সময়ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছিল। ১৯৬২-তে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে রোহিঙ্গারা। ১৯৭৪ সালে সামরিক জান্তা ‘বিদেশি’ আখ্যা দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করা হয় নাগরিকত্ব আইন। আর এই কালো আইনের মাধ্যমে অস্বীকার করা হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব। নাগরিকত্ব হরণ করে তাদের অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সাদা কার্ড নামে পরিচিত ওই পরিচয়পত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয় সীমিত কিছু নাগরিক অধিকার।
জাতিসংঘের সহায়তায় ২০১৪ সালে পরিচালিত আদমশুমারিতে রোহিঙ্গা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাধার মুখে পড়তে হয় রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। তাদের শুমারি বয়কটের ঘোষণার মুখে সামরিক জান্তা সিদ্ধান্ত দেয় রোহিঙ্গা হিসেবে নিবন্ধিত হতে গেলে অবাঙালি হতে হবে। ২০১৫ সালে সাংবিধানিক পুনর্গঠনের সময়ে আদমশুমারিতে দেওয়া সাময়িক পরিচয়পত্র বাতিল করে সামরিক জান্তা।
পদ্ধতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করা হয় মৌলিক অধিকার থেকে। চলাফেরা, বাসস্থান নির্মাণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, এমনকি চাকরির অধিকার থেকে আইনসিদ্ধভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের।
রাখাইন থেকে মায়ের সঙ্গে প্রাণে বেঁচে বাংলাদেশে আসা এক রোহিঙ্গা শিশু। ফাইল ছবি
চলতি বছরের গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৬ লাখ ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি। রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার এ ধারা অব্যাহত থাকলে শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, ১৫ অক্টোবর থেকে তা আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ নিয়ে কিছু এরিয়াল ফুটেজ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআইচসিআর। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, উখিয়ার পালংখালির কাছে নাফ নদী পার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় জাতিসংঘ মনে করছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে জাতিগত নিধনে নেমেছে।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশু রয়েছে শতকরা ৬০ ভাগ। এর মধ্যে ১১শ’র বেশি রোহিঙ্গা শিশু পরিবার ছাড়া অচেনাদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আর এসব শিশুর চোখের সামনেই তাদের বাবা-মাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা, মা-বোনদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ঘর-বাড়িতে আগুন দেওয়াসহ ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে মিয়ানমারের সেনারা।
প্রিয় সংবাদ/রিমন