মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। ছবি- সংগৃহীত
তানভীর করিমের এক স্থাপনা বলছে স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো গল্প
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:৪১
(প্রিয়.কম) মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ভাস্কর্য রয়েছে সারা দেশ জুড়েই। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য কমপ্লেক্সটি কোথায় জানেন কি? ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সাহচার্য পেতে ঘুরে আসতে পারেন সেখানে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সেখানেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার। ১৭ এপ্রিল এখনাকার এক গ্রামে হয় ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের তাৎপর্যপূর্ণ স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে ঠিক সেই স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিসৌধ।
গ্রামটির নাম বৈদ্যনাথতলা। স্মৃতিসৌধের পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের ম্যাপ। ম্যাপে একেকটি জায়গার চিহ্নিত করে সেখানকার যুদ্ধকালীন ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাস্কর্যের মাধ্যমে! সমগ্র কমপ্লেক্সটির নাম মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স।
আলাদা আলাদাভাবে ১১টি সেক্টর ভাগ করা হয়েছে বাংলাদেশের ম্যাপে, সেখানকার বিশেষ ঘটনাও জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভাস্কর্যে। সারা দেশে শুধু একাত্তরকে তুলে ধরে এতোবড় ভাস্কর্য কমপ্লেক্স দ্বিতীয়টি আর নেই। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি তানভীর করিম।
প্রতিটি ভাস্কর্যের সাথেই যথোপযুক্ত বর্ণনা রয়েছে। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মাস্টার প্ল্যান করেছে স্থাপত্য অধিদফতর। মানচিত্রের ডিজাইন বিআরটিসির। এটি বুয়েট আর্কিটেক্টদের একটি সংগঠন। তবে স্মৃতিসৌধটি আলাদাভাবেই ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আসুন জানি সৌধটির মানে-
রক্তলাল আয়তাকার মঞ্চ
স্মৃতিসৌধটি একটি সূর্যের মতো। প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল একটি লাল মঞ্চ। মঞ্চটির এই স্থানেই ইতিহাসখ্যাত মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। মঞ্চটি ২৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত।
স্মৃতিময় ২৩ দেয়াল
রক্তলাল মঞ্চটিকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে ২৩টি দেয়াল। যেন সূর্যের রশ্মি ছড়িয়ে গেছে চতুর্দিকে। ত্রিভূজাকৃতি এই দেয়ালগুলো ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। প্রথম দেয়ালটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। পরবর্তী দেয়ালের উচ্চতা ৯ ইঞ্চি ও দৈঘ্য ১ ফুট বেশি। ক্রমান্বয়ে প্রতিটি দেয়ালই এই আনুপাতিক হারে বেড়েছে। ৯ ইঞ্চি বৃদ্ধি দ্বারা বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করেছিল। শেষ দেয়ালের উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট। দেয়ালের নকশায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের অবর্ণনীয় চিত্র এটি।
বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে
আয়তাকার মঞ্চ আর ২৩টি স্মৃতি দেয়াল অবস্থান করছে ভূমি থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদীর উপর। বেদীতে আঁকা আছে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত। এই বৃত্তগুলো বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আঁকা হয়েছে। ১ লক্ষ বুদ্ধিজীবীর খুলির প্রতীক এটি।
মুক্তিযুদ্ধের শহীদ
বেদীর উপর রয়েছে অসংখ্য পাথর। এই পাথরগুলো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লক্ষ প্রাণের প্রতীক। পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের প্রতি জাতির দায়বদ্ধতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এই পাথরগুলো। পাথরগুলোর মাঝে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯টি জেলাকে বোঝানো হয়েছে।
১১ সেক্টর
স্মৃতিসৌধের বেদীতে ওঠার জন্য রয়েছে ১১টি সিঁড়ি। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের প্রতীক এই সিড়িগুলো।
বঙ্গোপসাগর
স্মৃতিসৌধের উত্তরদিকে দেখবেন আমবাগানসংলগ্ন জায়গাটি মোজাইক করা। এর দ্বারা আমাদের বঙ্গোপসাগরকে বোঝানো হয়েছে। ভৌগলিকভাবে সাগরটি বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থান করলেও স্মৃতিসৌধটির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষায় এটিকে উত্তর দিকে দেখানো হয়েছে।
রক্তের সাগর
স্মৃতিসৌধটির পশ্চিমে প্রথম দেয়ালের পাশ দিয়ে রক্তের প্রবাহ দেখানো হয়েছে। এটি শহীদের রক্তের প্রতীক। প্রতীকী রক্ত বয়ে চলা ঢালটিকে রক্তের সাগর নাম দেওয়া হয়েছে।
একুশ
স্মৃতিসৌধের মূল ফটকের রাস্তাটি এসে মিলেছে রক্তের সাগরের সাথে। এই রাস্তাটি একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতীক। সেই একুশ থেকেই যে আমাদের স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছে সেটাই যেন বলছে এই পথটি।
জনতার একতা
২৩টি স্মৃতি দেয়ালের ফাঁকে আছে অসংখ্য নুড়ি পাথরের মোজাইক। এই নুড়ি পাথরের দল ১৯৭১ এর বাংলাদেশের ৭ কোটি জনতার একতার কথা বলছে।
মুজিবনগরের এই স্মৃতিসৌধটি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের অনন্য প্রতীক। সৌধসংলগ্ন স্মৃতি কমপ্লেক্স একবার ঘুরে দেখার পর যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে যুদ্ধের ভয়াবহতা। আমরা তরুণরা যারা যুদ্ধ দেখিনি, শিশুরা যারা যুদ্ধের শুধু গল্পই শুনছে তাদের জন্য এই স্মৃতি কমপ্লেক্স যেন যুদ্ধের বাস্তব চিত্রায়ন।
প্রিয় ট্রাভেল/জিনিয়া/আরএ
প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post।
- ট্যাগ:
- ভ্রমণ
- ভ্রমণ
- মুক্তিযুদ্ধ
- তানভীর করিম
- মেহেরপুর