জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। ছবি: শামছুল হক রিপন; প্রিয়.কম।
সিসিইউতে নেওয়ার পর ভয় পেয়ে গেলাম, মন বলল সর্বনাশ: মোশাররফ করিম
আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:৪০
(প্রিয়.কম) অভিনেতা মোশাররফ করিম। তাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সকল মাধ্যমেই তিনি হাজির নিজ অভিনয় গুণে। তার সময়ের ব্যস্ততা এমনই ডালপালা গজিয়েছে, তাতে করে তাকে ব্যস্ততার একটি গাছই বলা যেতে পারে। সেই গাছের ফল কিন্তু মিঠা। মানে তার অভিনীত নাটক মানেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি এখন এতটাই জনপ্রিয় হয়েছেন যে, গত কয়েক বছর ধরে তিনি শুটিং ছাড়া কোথাও বের হতে পারেন না। প্রথম কারণটি হলো ব্যস্ততা। অন্যটি হলো জনপ্রিয়তা। শুটিং ছাড়া কোন ব্যক্তিগত কাজে বের হলে মোটামুটি তাকে ঘিরে ফেলে তার ভক্তরা। শুধু যে এদেশের ভক্তরা তাকে একবার দেখার জন্য ছুটে চলে আসেন, এমনটা ভাবলে ভুল। প্রায়ই কলকাতা থেকেও তার ভক্তরা চলে আসেন তাকে এক পলক দেখতে।
এসব নিয়েও তিনি তার সংসার জীবন, কর্মজীবন সবই ঠিকঠাক পার করছেন। জীবন চলে যাচ্ছে তার মত করে। বর্তমান এই সময়ের অভিনয়ের যাদুকর তিনি। যার অভিনয়ের যাদুতে মুগ্ধ হয়ে এমন কোন মানুষ নেই যে হাসেননি বা কাঁদেননি। কিন্তু তারপরও তিনি একজন মানুষ। আর সেই জায়গা থেকেই সম্প্রতি হয়েছে এক মহাকাণ্ড। শুটিংয়ে হুট করেই অসুস্থ হয়ে যান তিনি। আর এই খবরটি যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন তার ভক্তরা রীতিমত পাগলামি শুরু করে দেন। তার সেই অসুস্থতা ও তারপর আবার সুস্থ হয়ে ফেরার গল্পেই আমরা সেদিন মেতেছিলাম শুটিং বাড়ি নীলাঞ্জনায়। সেই আলাপনের কিছু কথা তুলে ধরা হলো প্রিয়.কম এর পাঠকের জন্য।
নীলাঞ্জনা শুটিং বাড়িতে ঢুকতে যাওয়ার আগেই গেটে থাকা মানুষটি বলল, 'মোশাররফ ভাই নাই। তিনটা গলি পরেই শুটিং চলতেছে, ওখানে যান। তাইলে পাইবেন।' আমি হাসি দিয়ে বললাম, 'ধন্যবাদ'। তিন গলি পেরিয়ে দেখা মিলল অভিনেতা মোশাররফ করিমের। মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, 'অবশেষে নীল বালকের সঙ্গে দেখা'। আমিও হাসি দিলাম। শুরু হয়ে গেল আমাদের কথোপকথন। তার আগে বলে নেই, তিনি আমাকে কখনও তুমি, কখনও আপনি আবার কখনও তুই করেও বলেন ভালোবেসে। আমাদের লাইভ কথাগুলোই প্রকাশ করা হলো।
প্রিয়.কম: কেমন আছেন আপনি?
মোশাররফ করিম: এইতো তোদের, আমার ভক্তদের দোয়ায় ভালোই আছি। এখন সুস্থ আছি, তাই শুটিং করতে এসেছি।
(এই বলতে বলতেই আবারও তাদের দৃশ্যধারণ শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দৃশ্যধারণ দেখলাম। মোশাররফের সঙ্গে অভিনয়ে ছিলেন তারিন। সাগর জাহানের পরিচালনায় তারা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় লেগে গেল। ভক্তদের সঙ্গে সেলফি তোলায় ব্যস্ত মোশাররফ করিম। তাও কিছুক্ষণ দেখে, মোশাররফ করিম হাত দিয়ে ইশারা দিলেন আমাকে। মানে হচ্ছে,তার দৃশ্য শেষ। এখানে আর থাকবেন না তিনি। আমরা আবার চলে যাচ্ছি নীলাঞ্জনায়)
প্রিয়.কম: (যেতে যেতে কথা হচ্ছে) বলছি আমি, আপনার শরীর কি বেশি খারাপ?
মোশাররফ করিম: নাহ এখন ঠিক আছি। তবে সেদিন অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। আর একটু ভয়ও পেয়েছিলাম। তা নীল বালক তোর নীলা কোথায়?
প্রিয়.কম: (মুচকি হাসি দিয়ে বললাম) এই তো ভালো আছে সে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখালাম শুটিং বাড়ি নীলাঞ্জনার মতো করে। (তিনি হাসি দিলেন) আচ্ছা ভাই, এই বাড়ির নাম নীলাঞ্জনা কেন রাখছে?
মোশাররফ করিম: নীল নিয়ে গবেষণা করে এখন আমাকে প্রশ্নটা করলি? ঠিক জানা নেই, তবে মনে হয় তোর মতো করে কেউ নীল ভালোবেসে তারপর নীলা বানিয়েছিল, তারপর হয়তো অঞ্জনা চলে এসেছিল। তাই হয়ে গেছে ‘নীলাঞ্জনা’। হাহাহা।
(কথা গুলো শেষ করেই হাসি দিয়ে তিনি বললেন, কি নীল নীল শুরু করলি। আয় নাস্তা করি। বসলাম সোফায়। টেলিভিশনে চলছে তারই অভিনীত অনিমেষ আইচের রচনা ও পরিচালনায় 'ডাক্তার' নাটকটি। তিনি, আমি ও আমরা মিলে নাটকটি দেখছি আর নাস্তা করছি। কিছুক্ষণ যেতেই শুরু হলো বিজ্ঞাপন। বদলে গেল চ্যানেল। অন্য চ্যানেলে গিয়েও দেখি তারই অভিনীত নাটক 'হাইপ্রেসার' বিজ্ঞাপন বিরতিহীন চলছে। এই চ্যানেলেই স্থির হলাম আমরা। কিছুক্ষণ দেখার পর মোশাররফ করিম বিড়বিড় করে যেন কি বলা শুরু করলেন। আমিও জিজ্ঞেস করে ফেললাম।)
প্রিয়.কম: ভাই কি যেন বললেন নাটক দেখে?
মোশাররফ করিম: বলছিলাম, অভিনয় শুধু ঠিক রাখলেই হয় না, লাইট, সাউন্ড, কালার এসবও ঠিক রাখতে হয়। (এর মধ্যেই অভিনেত্রী তারিন চলে আসলেন আমাদের মাঝে) তিনিও এসে নাটকে মনোযোগী হলেন। তার কিছুক্ষণ পরে মোশাররফ করিমের কানে গিয়ে বললাম, ভাই উপরে চলেন ইন্টারভিউ নিব। আজকে কি কথা বলতে পারবেন? তিনি বললেন, কেন নয়? চল উপরে। আমরা চলে গেলাম উপরে।
(দোতলায় উঠে গিয়ে শুরু হলো আমাদের সাক্ষাৎকারের মূল পর্ব। সাজানো, গোছানো, পরিপাটি চেয়ারে বসে গেলাম আমরা, টেবিলে রাখা একটা দেশীয় ম্যাগাজিনের বই)
প্রিয়.কম: শুটিংয়ে তো ফিরেছেন। কিন্তু গত ২৯ আগষ্ট আসলে পূবাইলে কি হয়েছিল আপনার?
মোশাররফ করিম: পূবাইলে!!! ও আচ্ছা মনে পড়েছে। আমার শারীরিক অসুস্থতা। আসলে আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তে অসুস্থ হয়ে যাই। আমি ওইদিন কিছুই খাই নাই। কিন্তু খালি পেটেই কফি খেয়ে ফেলেছিলাম বেশি। যে কারণে প্রেসার হাই হয়ে গিয়েছিল।
প্রিয়.কম: না খাওয়ার কারণ কি ছিল?
মোশাররফ করিম: আসলে তখন কাজের প্রচন্ড প্রেশার। ঈদের সময় নাটক নামাতেই হবে। তাই না খেয়েই শুটিং শুরু করছিলাম, কারণ তখন শুধু মাথায় ছিল কাজটা শেষ করতে হবে। আর কিছু খেলেই ঘুম চলে আসে আমার, ঘুমিয়ে গেলে তো সঠিক টাইমে কাজটা শেষ হতো না। আমি বলবো, দোষটা আসলে কারোরই না, দোষটা আমারই। কারণ আমি ভেবেছিলাম, যে করেই হোক কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। আর এটা ভাবতে গিয়েই শেষমেষ অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
প্রিয়.কম: এরপর পূবাইল থেকে উত্তরা আসা পর্যন্ত কি ঘটনা?
মোশাররফ করিম: সবাই আমাকে নিয়ে চলে আসলো উত্তরার একটি হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি হলাম। একটা টেনশন কাজ করল সবার মধ্যে। তারপর ডাক্তার প্রেশার মেপে বললেন, অনেক হাই হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে যাবে তবে সিসিইউতে নিতে হবে। সিসিইউতে নেওয়ার পর ভয় পেয়ে গেলাম, মনে মনে বললাম সর্বনাশ! পরে আবার চিন্তা করলাম, আসলে যেভাবে কাজ করি, সেইভাবে কাজ করা আসলে ঠিক না। এরপর ডাক্তার সবকিছু চেক করে বললেন, এখন সব ঠিক আছে। প্রেশার হাই হলেও হার্টে কোন প্রভাব পড়েনি। সব ঠিক আছে। একথা শুনে সবার মাথা ঠাণ্ডা হলো। তবে কোন কাজ করা যাবে না, সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে কিছুদিন।
প্রিয়.কম: সেক্ষেত্রে নতুন কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কি না?
মোশাররফ করিম: হ্যাঁ, নতুন সিদ্ধান্তটা হচ্ছে, যতই অনুরোধ করুক, এখন থেকে আর বেশি কাজ করা হচ্ছে না। পরিমিত কাজ করব, আর কেউ যদি অনুরোধও করে, তাও আমি রাখতে পারব না।
প্রিয়.কম: এরপর শুটিং ফিরে কি আর অসুস্থবোধ করেছেন?
মোশাররফ করিম: নাহ! আল্লাহর রহমতে এখন ভালো আছি। আমার অনেক দর্শক, যারা আমাকে এবং আমার অভিনয় পছন্দ করে তাদের ভালোবাসা প্রার্থনা সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা প্রার্থনা করেছে তাই আমি সুস্থ। তাদের অনেক ধন্যবাদ। আমার ভালোবাসা, অভিনয় সব কিছুই আমার ভক্তদের জন্য। এবং আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।
প্রিয়.কম: আপনি কি জানেন আপনার অসুস্থতার খবর শুনে অনেক ভক্ত কান্নাকাটি করেছে এবং আপনার পাশে থাকতে চেয়েছিল অসুস্থতার সময়ে? এই যে ভক্তের ভালোবাসা, এই ভালোবাসাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মোশাররফ করিম: আমি যে আসলে কি বলব মাঝেমাঝে বুঝে উঠতে পারিনা। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করে ফেলি আমি কি আসলে এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? তবুও আমার চাওয়া, ভাবনা, কল্পনারও বাইরে আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এতে আমি কৃতজ্ঞ। আমি তাদের সমানভাবেই ভালোবাসি। তাদের ভালোবাসাতেই এখনও অভিনয় করে যাচ্ছি। আমিও ভালো থাকি এবং আমার ভক্তরাও ভালো থাকুক।
প্রিয়.কম: আচ্ছা একটু আগে নিচতলায় আপনার প্রচার হওয়া নাটক দেখছিলেন খুব মন দিয়ে। তারপর কিছু একটা বলতেও চাচ্ছিলেন। আসলে বলেন তো ঘটনাটা কি?
মোশাররফ করিম: আসলে প্রথম কথা হচ্ছে, অভিনয় করেই ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই সে ভাবে সময়টা পাই না। কিন্তু ইউটিউবে একটু সময় পেলে নাটক দেখি। তবুও আমি বলবো, সে রকম ভাবে নাটক দেখার সময়টা হয় না। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে মালয়েশিয়াতে শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা নাটক দেখেছিলাম নাম হচ্ছে ‘জর্দা জামাল’। তো এই নাটকটা দেখে আমার ভালো লেগেছে। ও আচ্ছা! এবার মূল কথায় আসি। একটা নাটকে আসলে ভালো অভিনয় করলেই হবেনা। কিছু টেকনিক্যাল কাজ থাকে, যেমন লাইটের কাজ, কালারের কাজ, গ্রাফিক্সের কাজ, এডিটিংয়ের কাজ, সাউন্ডের কাজ। এরকম আরও নানা কাজ থাকে। এখন আমি শুধু অভিনয় ভালো করে গেলাম কিন্তু সাউন্ড ভালো হলো না, কালার ভালো হলো, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভালো হলো না, তো সেই নাটকটা দেখে তো আর দর্শক মজা পাবে না। এখন এখানে একটা কথা আছে, সেটা হলো এক্ষেত্রে কিন্তু বাজেটেরও ব্যাপার থাকে। কারণ একটি নাটকের এডিটিংও কিন্তু ভালো হওয়া চাই সবদিক দিয়ে। সেক্ষেত্রে তো টাকা লাগবে ভালো। নরমাল এডিটিংয়ের মানুষ দিয়ে তো আর ভালোটা পাওয়া যাবে না।
প্রিয়.কম: তাহলে শুধু অভিনয় নয়, একটি ভালো নাটক দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে তাতে অনেক বাজেটের ব্যাপারও আছে?
মোশাররফ করিম: অবশ্যই। যিনি ভালো অভিনয় করেন, যিনি ভালো নির্মাণ করেন, তিনি যদি ভালো সম্মানী নিতে পারেন তাহলে অবশ্যই একজন ভালো সাউন্ডম্যান, লাইটম্যান, ক্যামেরাম্যান, এমনকি একটি নাটকের পেছনে যারা কাজ করেন তাদের সবাইকে ভালো সম্মানী দেওয়া উচিত। আর এটা যে নতুন করে আমি বলছি তাও কিন্তু না। এখন অনেক ভালো বাজেটে ভালো নাটক নির্মাণ হচ্ছে। আর যেহেতু বড় বাজেটে নাটক নির্মাণ হচ্ছে, তাতে করে বোঝা যাচ্ছে তাহলে সবই সম্ভব। কারণ সেই ভালো বাজেটের নাটকটি দিয়ে তো ভালো ব্যবসাটাও হচ্ছে।
(কথায় কথা বেড়েই চলছে মোশাররফ করিমের সঙ্গে। ওদিকে চলে আসল চিনি কম ব্ল্যাক কফি। এবার কফি খেতে খেতেই আমাদের আবারও শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলা বিকেলে কথা শুরু হলো কিছুটা ব্যক্তিজীবন নিয়ে)
প্রিয়.কম: আপনি তো হাজার হাজার নাটকে অভিনয় করেছেন। আপনার অভিনয় দেখে মানুষ হাসে আবার কাঁদেও। তো আপনি নিজের নাটক দেখে কখনও হেসেছেন বা কেঁদেছেন?
মোশাররফ করিম: (হাহাহা) আসলে নাটক তো ওভাবে দেখিই না। তবে যতটুকু দেখি তখন হাসি কিংবা কান্না আসে না। দেখি পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি থেকে। কোন জায়গা ভুল হলো, কোন জায়গা আরও একটু ভালো করা যেত, এভাবেই নিজের অভিনয়টা দেখতে হয়। আর ওদিকে যদি দর্শকের জায়গাটা আমি ধরি, তখন এটা এভাবে বলতে হবে যে তাদের তো কোন টেনশন থাকে না। তারা নির্ভার দৃষ্টিতে নাটকটি দেখে। যার ফলে হাসে আবার কাঁদে। তবে আমার ক্ষেত্রে কখনও কখনও যেটা ঘটে- নিজের অভিনীত নাটকের দৃশ্য দেখে মনে হয়- ইয়েস! এটা ভালো করছি, আবার কখনও কান্নার দৃশ্য দেখে মনে হয় কান্নাটা ঠিক ছিল তো? এরকমই হয় আর কি! ওই যে 'জর্দা জামাল' নাটকটির কথা বলছিলাম, সেটা দেখে আমি পরিচালককে কল করেছিলাম, যদিও অনেক আগের নাটক কিন্তু বলেছিলাম, আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু দর্শকের জায়গাতে কেন যেন যেতে পারি না। নিজের অভিনীত নাটক দেখে পর্যবেক্ষণ করি, যার ফলে তেমন আনন্দটা আর থাকে না। কারণ পর্যবেক্ষক হলেই আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। দর্শকের সেই সরল মনটা আমাদের থাকে না। (কিছুটা হেসে শেষ করলেন প্রশ্নটির উত্তর)
প্রিয়.কম: আচ্ছা এবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটি প্রশ্ন করি। সেটা হলো, দর্শক তো অভিনয় দেখে হাসে, কাঁদে বা আনন্দ পায়। কিন্তু আপনার অভিনয়ের বাইরে ব্যক্তি জীবনে যখন আপনার কোন কারণে কান্না পায়, বা হাসি পায়, বা মন খারাপ হয়, তখন আপনি নিজেকে সামাল দেন কিভাবে?
মোশাররফ করিম: (একটু ভেবে কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলেন) হুমমম। এই বিষয়টা পত্রিকায় এত সহজে বলে দিব? এটা খুবই দামি বিষয়। (তখন আমি বললাম তাহলে আমরা কি আরেকদিন বসব? আমার কথা না শুনেই তিনি অন্য এক মোশাররফ করিম হয়ে গেলেন। আনমনা ভাবনা থেকে বলতে লাগলেন) বিষয়টা খুবই ব্যক্তিগত। একজন অভিনয় শিল্পী যে ব্যক্তিগতভাবে কতটা কোনঠাসা, সেটা আসলে কেউ বোঝার নেই। পর্দায় একজন অভিনয় শিল্পীর অভিনয় দেখে যে মায়ায় পড়ে যায় দর্শক বা চরিত্রের বিভ্রান্তিতে পড়ে, অভিনেতাটাকে পর্দায় দেখতে দেখতে দর্শক নিজের মতো করে একটা চরিত্র দাঁড় করিয়ে নেয়, যে এই অভিনেতাটা এমন। কিন্তু আদতে সেই মানুষটি তেমন না। মোটেও তেমন না। একদমই অন্যরকম। সেই মানুষটির ব্যক্তিজীবন আছে, দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, হাসি আছে, মন খারাপের সময় আছে, এমনকি সবই আছে। কিন্তু অনেক সময় দর্শক সেটা বোঝে না। সেও যে একজন সাধারণ মানুষ। শুধুমাত্র অভিনয়টা পারে বলে, অভিনয়টা করছে- সেটা অনেক সময় অনেকের মাথায় থাকে না। সেই মানুষটার যে স্বাভাবিক চাওয়াগুলো আছে, সেই ব্যাপারগুলোও কিন্তু মানুষ মানতে চায়না। এটা গেল একটা ব্যাপার। আর তুমি যেটা জিজ্ঞেস করেছো যে- ব্যক্তিজীবনে আসলে আমি কিভাবে দুঃখ, কষ্ট, হাসি, কান্না সামলে নেই? এটার উত্তর হচ্ছে, মানুষই বোধহয় একমাত্র প্রাণী, যে সব কিছু মানিয়ে নিতে পারে। হ্যাঁ আমারও আর সব মানুষের মতো দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, হাসি পায়, কান্না পায়। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সব মানিয়ে নিতে হয়। নিতে হচ্ছে। ওই যে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর লেখা একটা বই আছে না`মাপা হাসি চাঁপা কান্না'। জীবনটাও ওই রকম হয়ে যায়। আবার এটা যদি আমি আবার অন্য ভাবে বলি, যেমন আমার চিৎকার করে কান্না করতে মনে চাচ্ছে, কিন্তু আমার পরিবার আছে, সেই কান্নাটা হয়তো তাদের উপর গিয়ে প্রভাব ফেলবে। তাই তখন আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, আমি কি চিৎকার করে কাঁদব নাকি ওয়াশরুমটাই বেস্ট জায়গা হবে? পরিশেষে এতটুকুই বলব আমি অভিনেতা হলেও সাধারণ মানুষের বাইরের কেউ না।
প্রিয়.কম: নিজেকে আর কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন আপনি?
মোশাররফ করিম: হুমম! আমার অক্ষমতা আছে, আমি জয়ন্তদা’র মতো রসগোল্লা বা দই বানাতে পারব না, আমি ওমুকের মতো ছবি আঁকতে পারব না। আমি তমুকের মতো ভালো গান গাইতে পারব না। আমি পারব শুধু অভিনয়টা করতে। যেই কাজটা দিয়ে মানুষ আমাকে চিনে, আমাকে ভালোবাসে। তাই আমি শুধু ভালোবাসাটাই চাই। শুধু আমি কেন, অন্য কোন প্রাণীও যদি হয় তাকে যদি ভালোবাসা না দেওয়া হয়- তাহলে সে কি থাকতে পারবে? পারবে না কখনও থাকতে। তাই মানুষের এই ভালোবাসাটুকুই আমার ব্যাখ্যা। তবে আমিও যে একজন মানুষ, সেটা আমার ভক্ত কিংবা দর্শক সবার মধ্যেই থাকা ভালো। আর সব মানুষের মধ্যেই যাদু আছে। আর নিজেকে আসলে আমি এতটা স্পেশাল কিছু মনে করি না। আমি সাধারণ একজন মোশাররফ করিম।
প্রিয়.কম: আপনার অভিনয়ের সঙ্গে কিন্তু আরেকটা ব্যাপার চলে আসে যে, আপনি গান গাইতে পারেন। এমনকি গেয়েছেনও বেশ কয়েকটি গান। তবে সেটা শুধু নাটকের জন্য। (প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর দিয়ে দিলেন তিনি)
মোশাররফ করিম: একদমই না। আমি গান গাইতে পারি না। আর এটা নিয়ে আমার অনেক সময় রাগ হয়, মন খারাপ হয়। কেন আমি গানটা গাইতে পারি না। তবে প্রচুর গান শুনি। এখন যদি বলি মান্না দে'র কথা, তার উপর আমার ভীষণ রাগ হয়, কারণ হুট করে আমার সন্ধ্যা বেলায় ছাদের উপর গান গাইতে ইচ্ছে করল, 'তুমি কি সেই আগের মতো আছ, নাকি অনেকখানি বদলে গেছো, খুব জানতে ইচ্ছে করে’। তখন মান্না দে'র উপর আমার খুবই রাগ হয়। কারণ গানটার সুর সে এত কঠিন করেছে কেন? তখন আমি সেই কঠিন সুরটাকে আমার নিজের মতো করে যা-তা বানিয়ে গাইতাম। কারণ আমার গাইতে ইচ্ছে করত। তখন নিজেকে মানিয়ে নিতাম আচ্ছা তাহলে আমি যেটা গেয়েছি এটাই তাহলে সুর। যার ফলে গায়ক না হওয়ার কারণে আমি এই দুঃখটা পাই। আমি গায়ক হলে কিন্তু আমার মন খারাপের সময় চমৎকার একটা গান গেয়ে মনটা ভালো করে নিতাম। কিন্তু সেটা তো আর পারি না, পারি অভিনয় করতে। আর অভিনেতারা বোধহয় সেটা পারে না যে মনটা খারাপ হলো আর কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে অভিনয় করে নিলাম। তবে আমার মন খারাপ হলে একটা কাজ করতে পারি। সেটা হলো জীবনানন্দ দাসের রুপসী বাংলা কাব্যটা পড়ি। বইটা আমার মন খারাপের সময় ভীষণ কাজে দেয়। কবিতাগুলো আমি খুব ফিল করি। অনেক জটিলতা থেকে আমাকে মুক্তি দেয়।
প্রিয়.কম: দেশের বাইরে কি কোন নাটক আপনি অভিনয় করছেন?
মোশাররফ করিম: কথা ছিল ভারতে একটি কাজ করার জন্য। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে থাকতে হবে তাই আমি না করে দিয়েছি। সেটা আমি করছি না। কিছু ব্যক্তিগত কারণেও আমি পারব না করতে। আর আমি অনেকটা এমনই কুদরত। কারণ ওমুকটা করে আমি ওমুক হয়ে যাব। এইসব কাজ আমাকে টানে না। এটা আসলে আমাকে কোন ফিলিংও দেয় না। আমাকে বর্তমান আনন্দটাই বেশি আনন্দ দেয়। কারণ বর্তমান যে কাজটা আমি করছি সেটা যদি আমি ভালোভাবে না করতে পারি তাহলে বরং আমার কাছে বিরক্ত লাগে। আর দিক নির্দেশনা ভালো না থাকলে আসলে সে কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
(কফি ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কথা শেষ হচ্ছে না। তবে এবার এই প্রশ্ন দিয়েই শেষ করব লেখা। নয়তো পরিচালকের আবার দৃশ্য নিয়ে বিপাকে পড়ে যেতে হবে)
প্রিয়.কম: এবার প্রশ্নটি হচ্ছে আপনাকে এতদিন দেখে, কথা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে আপনার ভেতরে আসলে যে আত্মার বসবাস, সে-ই আসল অভিনেতা। আমার এই ফিলিংটা কি ঠিক আছে?
মোশাররফ করিম: হ্যাঁ, ফিলিংটা ঠিক, অনেকখানি ঠিক আছে। কিন্তু তৈরী হয়ে উঠার যে একটা ব্যাপার থাকে, সেটা কিন্তু এমনি এমনি হয়ে ওঠে না। আর এমনি এমনি হওয়া উচিৎও না। তোমার কাছে ধরা দিবে কি, তুমি যা ভালোবাস তাই তুমি চাও। আর তুমি যা চাও, তুমি তা। (কথার মাঝে বলে ফেললেন এই কি সব সুফিজম কথা বলছি রে!) তোমার চাওয়ার সেই সততা, সেটা লাগবে। তুমি কেমন করে চাও? সুন্দর করে চাও নাকি অসুন্দর করে চাও? সাধকের মতো চাও নাকি রাক্ষসের মতো চাও? যাই হোক, অভিনয়টা ভালোবাসি। একটা সময় চাইতে চাইতে ভেতরে বসে যায় সবকিছু। একটা চরিত্র ধরে ফেলা, সেটা কিন্তু এমনি এমনি হয় না। সেইটা ধরতে হলে একটা দীর্ঘ জার্নি আছে, একটা দীর্ঘ সময় লাগে, তুমি যা চাও ওই সংশ্লিষ্ট জিনিসের পেছনে একটা সাধনা আছে। এই যে নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, লেখালেখি, আঁকাআঁকি, ভালোবাসাবাসি, এই যে সংস্কৃতিটা আছে সেটার মধ্যে যে গড়াগড়ির অভ্যাসটা রয়েছে। যে আমি কিছুই হবো না, কিন্তু আমি এসবে গড়াগড়ি দিব। এটাই দরকার। হয়তো আমি কোন অভিনেতা নাও হতে পারি কিন্তু আমার সেই অভ্যাসটা হয়ে গেছে এসবে গড়াগড়ি দেওয়া। বরং মনের মধ্যে হতে আমি ওটা ফেলে দেই যে আমি আসলে কোনদিন কিছু নাও হতে পারি। এই গড়াগড়িতেই যখন তুমি যা চাও তখন তা তোমাকে বিস্মিত করে দিবে। আরে বাহ হয়ে গেছে তো, কোন ফাঁকে যেন! চাওয়ার ধরণটা হলো এই রকম। রবীন্দ্রনাথের ‘পরশ পাথর’ কবিতাটায় আছে পড়লে দেখবে, ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর’।
এর ব্যাখাটা দিয়ে শেষ করি। ক্ষ্যাপার সারা শরীরে শিকল। সমুদ্রের পাড়ে বসে পরশ পাথর খুঁজছে। কিভাবে খুঁজছে! একটা পাথর নেয়, শরীরে থাকা শিকলে পাথরটা ছোঁয়া দেয়, আবার ফেলে দেয়, আবার নেয় আবার ফেলে দেয়, কিন্তু গায়ে থাকা শিকলের দিকে তাকিয়ে দেখে শিকল তো আর সোনা হচ্ছে না। ক্ষ্যাপাও তো নাছোড়, সে পাথর নিচ্ছে আর শিকলে ছোঁয়া দিতেই আছে, আর পাথর ফেলে দিচ্ছে। এরপর কবিতার আরেকটা লাইনে আছে ‘এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ। খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু, বিশ্রাম না জানে কভু, আশা গেছে, যায় নাই খোঁজার অভ্যাস’। এটার মানে হলো ক্ষ্যাপা তো খুঁজে খুঁজে আশাই ছেড়ে দিয়েছে। ধুর এই শিকল আর সোনা হবেই না। কিন্তু ততো দিনে তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই সে ওটাই করতে থাকে শিকলের দিকে না তাকিয়েই। তারপর একদিন হঠাৎ দেখে শরীরের লোহার শিকল তো সোনা হয়ে গিয়েছে। তার মানে এই মাঝখানে সে পরশ পাথর পেয়েছিল কিন্তু পেয়েও সে হারিয়েছে। এখন সে আবার পরশ পাথর খোঁজা শুরু করছে। বুঝতে পারলা, সাধনার মধ্যেও ঝামেলা আছে, একফোঁটা এদিক সেদিক হওয়া যাবে না। মোদ্দা কথা আশা ছাড়া যাবে না। আশা রাখতে হবে যা তুমি চাও ওটা যদি পেতে চাও। আর লক্ষ রাখতে হবে সঠিক সময়ের। আমরা এতটা গ্রেট কেউই না। এত ব্যস্ত হওয়া যাবে না কোন কিছুতে। প্রক্রিয়াটা অনেক শান্ত, অনেক ধৈর্য্য নিয়ে থাকতে হবে, অনেক ভালোবেসে। এখন আমি যদি একটা নারীর সঙ্গে প্রেম বা ভালোবাসার কথাও বলি সেটাতেও তো তাড়াহুড়ার ব্যাপার না। তাই না! তাতে তো কোন স্বাদ নাই। আর তুমি যেটা বলছ যে অভিনয়ের সঙ্গে আত্মার একটা ব্যাপার। হ্যাঁ আসলেই তাই। কিন্তু সেই আত্মাকে নির্মাণের ব্যাপার আছে। অন্যেরটা তো আর বলা যাবে না, নিজের টা দিয়েই বলি- যাই করো বাস করো, ভালোবেসে বাস করো। পাগল না হয়ে বাস করো।
(কথা তখনও চলছে। এর মধ্যেই নির্মাতা সাগর জাহান চলে আসলেন। বললেন মোশাররফ ভাই চলেন, আপনার দৃশ্য আছে। বাকিটা পরে বইলেন। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে মধ্য দুপুরে শরতের নীল আকাশ খুঁজতে খুঁজতে বের হলাম নীলাঞ্জনা থেকে। হয়তো কথা হবে আমাদের আবারও কোন এক গভীর আলোচনা নিয়ে। তবে থাকবে না হয়তো এই শরৎ। থেকে যাবে না বলা অসংখ্য স্মৃতি।)
প্রিয় বিনোদন/সিফাত বিনতে ওয়াহিদ/শামীমা সীমা।