মালেক আফসারী/ ছবি: সংগৃহীত
প্রথম কথা হচ্ছে মৌলিক ছবি করা বন্ধ করতে হবে : মালেক আফসারী
আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ২০:১৬
(প্রিয়.কম) টিপ টিপ বৃষ্টি ঝড়ছে, আলসে সন্ধ্যা, সঙ্গে সোডিয়াম বাতির রোশনাই, দেখতে ভালোই লাগে। তবে সে বৃষ্টি দেখায় বিরতি টানতে হলো। কিছুটা সময় পরেই বৃষ্টিতে ভিজে গন্তব্য হয়ে উঠল এফডিসি। গত কয়েকদিন ধরেই নির্মাতা মালেক আফসারীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল। 'অন্তর জ্বালা' সিনেমা নিয়ে আলাপ-সালাপ হবে। আসছে ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে ছবিটি। আড্ডার স্থান তখন থেকেই নির্ধারণ করা হলো এফডিসি।
এরইমধ্যে দুইবার সময় নির্ধারণ করেও সময় মেলানো যায়নি। অবশেষে কথার আড্ডায় সামিল হলাম দুজনেই। গত ৯ ডিসেম্বরের কথা। তখন প্রায় সন্ধ্যে সাতটা। প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির একটি কক্ষে বসেই শুরু হলো আলাপচারিতা। তার চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে বাহারি পোশাক। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘বয়স কত তোমার?
আমি বললাম, হবে আর কী, আপনার আন্দাজের সমান! একথা বলতেই হেসে করে উঠলেন নির্মাতা। বললেন, বয়স তো একেবারে কম! সাংবাদিকতা করো কতদিন ধরে? আমি বলি, কয়েক বছর হবে, তবে এর আগে কখনও আপনাকে নিয়ে লেখা হয়নি। আফসারী: হয়নি তো কী হয়েছে, এই যে এখন সময় হয়েছে, তুমিই তো আমাকে খুঁজে বের করেছ, আমি করেছি নাকি? (হাসি)। আমি বললাম: হ্যাঁ ভাই। চলেন তাহলে আপনার সিনেমা নিয়ে আলাপ শুরু করি।
(প্রিয়.কম) আপনার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘এই ঘর এই সংসার’ ‘ঠেকাও মাস্তান’সহ আরও বেশকিছু জনপ্রিয় সিনেমা রয়েছে। যে প্রবল উৎসাহ নিয়ে সিনেমা নির্মাণে এসেছিলেন, সে উৎসাহের আর কতটা বাকি আছে?
মালেক আফসারী: সিনেমাকে আরও উন্নত করতে হবে, দেশকে কিছু দিতে হবে, জাতিকে কিছু দিতে হবে, এরকম চিন্তাভাবনা আমার মধ্যে নাই। কখনও ছিল না। আমার কাছে বর্তমানের বিষয়গুলো ভালো লাগে। যেমন এখন 'অন্তর জ্বালা' রিলিজ হবে। ছবিটি নিয়ে আলোচনাটা এখন যে অবস্থায় আছে সেটি হওয়ার কথা ছিল এই সিনেমায় যদি শাকিব খান থাকতেন। এখন কিন্তু শাকিব না থাকলেও আলোচনার মাত্রা তার থেকে বহু উপরে আছে। কারণ কেউ আশাই করেনি যে জায়েদ খানকে নিয়ে একটি সিনেমা করলে সেটি এমন আলোচনায় আসতে পারে! আমার টার্গেটটা দেখেন, আমি কী জানি না, বুঝি না যে জায়েদ খানের তারকা খ্যাতি সে সময় কেমন ছিল, তারপরেও তাকে কেন নিলাম?
জায়েদকে কিভাবে আর সমৃদ্ধ করা যায়, সে চেষ্টাটাই আমি করেছি। আমার ভেতরে একটা জেদ কাজ করছিল বহুদিন ধরে। সে কথা এতোদিন বলি নাই। তবে আজ বলব, আমার সর্বশেষ দুটি ছবি ‘মনের জ্বালা’ আর ‘ফুল অ্যান্ড ফাইনাল’ করতে গিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে হার্টবিট প্রোডাকশন থেকে। শাকিব খান এখন স্টার। আমি একথা শতভাগ বিশ্বাস করি। ওকে পর্দায় সবাই দেখতে চায়। বোম্বের খানদের চেয়েও অনেক সুন্দর দেখতে শাকিব। কিন্তু সকালে শুটিং থাকলে ও যদি নয়টায়, দশটায় কিংবা এগারটায় আসেন, তাও মানা যায়। কিন্তু না, আপনি সাত-আট ঘণ্টা শুটিংয়ে দেরী করে আসবেন কিন্তু সরি বলবেন না, তা মেনে নেওয়া যায় না!
এরপর চিন্তা করলাম আর ছবি বানাব না। তখন হার্টবিট প্রোডাকশন থেকে ‘খোদার পরে মা’ ছবিটি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। আর আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি শাকিব খানকে নিয়ে আর সিনেমা বানাব না। আর যদি সিনেমা বানাইও এমন কাউকে নিয়ে বানাব যাতে শাকিবের একটা শিক্ষা হয়। ওকে বুঝিয়ে দিতে চাই, সিনেমা ডিরেক্টর মিডিয়া। অন্য কিছু না। ওই জেদ থেকে মাথায় আসে, এমন একটা কিছু করব, এমন একটা চমক আনব যেটা দিয়ে মানুষ যেন মনে করে, পরিচালকই অল ইন অল। এটা বুঝাবার জন্যই ‘অন্তর জ্বালা’ বানানো।
(প্রিয়.কম) সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে আপনার জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে, অনেক কিছুই ঘটেছে। তবে আপনার স্বপ্ন, তাড়না এখনো আগের মতোই আছে?
মালেক আফসারী: এই মুহূর্তে আমি সিনেমা বানাচ্ছি আমার সংসার চালানোর জন্য। আমার সন্তানদের জন্য কিছু টাকা জমানোর জন্য। পরিবারকে ভালো রাখার জন্য। এছাড়া আমার কোন স্বপ্ন নাই। আমার এটা কর্ম। আমি একজন সম্পূর্ণ পেশাদার পরিচালক। আমাকে যখনই সাইনিং মানি দেওয়া হয় তখনই আমার মধ্যে একটা ইমোশন কাজ করতে থাকে। ভেতরের মেশিন চালু হয়ে যায়। কখন কী করতে হবে তার একটা পরিকল্পনা মাথায় ঘুরতে থাকে। আমি কাজ করি শুধু আমার পরিবারের জন্য। আমাকে যদি কোন চ্যানেল থেকে বলা হয় আপনি আমার অফিসে এসে বসবেন। নাটক পরিচালনা করবেন। যদি দেখি সিনেমা থেকে সেখানে দশ টাকা বেশি পাই, আমি সিনেমা ছেড়ে দেবো। আমার মধ্যে কোন ইমোশন কাজ করে না।
(প্রিয়.কম) কিন্তু এটাও ঠিক যে আপনার পরিচালিত সর্বশেষ ছবিতে (ফুল অ্যান্ড ফাইনাল) সে অর্থে আপনার মুন্সিয়ানা খুঁজে পাওয়া যায়নি?
মালেক আফসারী: হ্যাঁ সত্যি। এই প্রশ্নরটার উত্তরও খুব সহজ। হার্ডবিট প্রোডাকশন থেকে ‘খোদার পরে মা’ সিনেমাটি আমি যখন ছেড়ে দিয়ে আসলাম, তখন প্রায় তাদের ২২ লাখ টাকা অলরেডি খরচ হয়ে গিয়েছে। তখন তাপসী ম্যাডাম (তাপসী ঠাকুর) খুব কষ্ট পেয়েছে। তাকে আমি বোনের মত জানি। তিনি হঠাৎ আমাকে ফোন দিলেন। আমার আগের ছবিটা তো আপনি করলেন না। তবে আমাকে এখন একটা ছবি করে দিতে হবে। আসেন আমার অফিসে। তার ডাকে আমি সাড়া দেবো এটাই স্বাভাবিক। আমি গেলাম, গিয়ে দেখি তাদের সিনেমার চিত্রনাট্য রেডি। শাকিব তো আছেই। পরে বিষয়টা নিয়ে আমরা কথা বললাম। আমি গল্প পড়ে বললাম বিষয়টা কি আরেকটু পরিবর্তন করা যায়। তখন তাপসী ম্যাডাম বলল, সময় নেই।
শুটিংয়ের বাকি আর মাত্র পনের দিন। তখন আমি একটু পয়সা হাঁকালাম। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। বিষয়টা হলো খেলোয়াররা ম্যাচ খেলতে যায় না। আমি ভাবলাম ম্যাচটা খেলি। খারাপ না। তবে ব্যবসা যে ‘মনের জ্বালা’ মতো করবে না, তা আমি জানতাম। কিন্তু ছবিটা আমার নামে, ধামে, ভারে কেটে যাবে। তার ব্যবসায়ের টাকা উঠে যাবে। এটা বুঝতে পারছি। তবে আমার পছন্দের গল্প হলে তিনি ঠকতেন না। আমি শুধু ম্যাচ খেলেতে গিয়েছি।
(প্রিয়.কম) দুটো শব্দ বলছি, 'অন্তর জ্বালা'। ব্যাখ্যা করুন?
মালেক আফসারী: আমি আমার যে কোন সিনেমার শুটিংয়ের আগে নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে অনেক আড্ডা মারি। কারণ তাদের সাথে আমার সম্পর্কের একটা সহজ পরিবেশ তৈরি করার জন্য। আড্ডার ছলে সেদিন গল্পটা একটু বললাম। তবে নাম কী হতে পারে এই প্রসঙ্গে তখন ছবির নাম মনোনীত হলো 'অন্তর জ্বালা'। আমারও নামটা পছন্দ হয়ে গেল। মান্নার এক ভক্তের গল্প। এখন ব্যাখ্যা দেবো না। মুক্তির আগে এটা ব্যাখ্যা না দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার পর যখন সবাই বের হবে, ভালো, মন্দ মতামত দেবে। তখনই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
(প্রিয়.কম) আচ্ছা, তবে এই সিনেমাটি নির্মাণের আইডিয়াটা এলো কীভাবে?
মালেক আফসারী: মান্নাকে নিয়ে আমি সাতটি ছবি বানিয়েছি। যখন আট নাম্বার ছবি রেডি করলাম অপু বিশ্বাস আর মান্না। শাকিব তখন সিঙ্গাপুর। চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন। অপুকে সাইনিং মানিও দিলাম। সে এক বিশাল কাহিনী। ঠিক তার দুইদিন পর শুনলাম। মান্না নেই! মারা গেছে! সেই যে হঠাৎ চলে যাওয়া। যাই হোক পিরোজপুরে এক মান্নার ভক্তের ঘটে যাওয়া জীবনের ঘটনার উপর ভিত্তি করেই মূলত নির্মাণ করা হয়েছে ‘অন্তর জ্বালা’।
(প্রিয়.কম) ২০১৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে ‘অন্তর জ্বালা’ সিনেমার মহরতের সময় বলেছিলেন, ‘এই সিনেমাটি একটু আলাদা। এটা আপনার দেখা বাস্তব একটা কাহিনি নিয়ে তৈরী হচ্ছে। তখন দাবি করেছেন, এই সিনেমার গল্প সম্পূর্ণ মৌলিক’। কিন্তু মুক্তির আগেই তো নকলের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে তো এখন সমালোচনাও হচ্ছে?
মালেক আফসারী: যে গানটির সঙ্গে একটু মিলের অভিযোগ উঠেছে সেখানে তো একটু মিল না, আমি বলব, অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। আমি এখনও দাবি করছি এটা একজন মান্নার ভক্তের গল্প। ছবি গল্প কিন্তু এখনও কোথাও প্রকাশ হয়নি। আর বলাও নিষেধ। মৌলিক গল্পের ব্যাপারে আমার বিরাট একটা আপত্তি আছে। মৌলিক গল্প কাকে বলে তা আমি জানি না। ধরেন একটি গল্প বা উপন্যাস থেকে একটি সিনেমা বানালাম। সেটি চলল না। তাহলে সে সিনেমা আমি কেন বানাব?
প্রযোজকের টাকা নিয়ে জুয়া খেলার স্বভাব আমার নেই। আমি যা কিছু দেখছি সারা জীবনে সেটা পর্দায়, খালি চোখে, টিভিতে, মোবাইলে- সেটা আমি সিনেমার ভেতরে দিয়ে দিই। ৪০ কিংবা ৫০ লাখ টাকার প্রযোজক আমার কাছেই আসতে পারে না। মিনিমাম আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা নিয়ে আমার কাছে আসতে হবে সিনেমা বানানোর জন্য। কারণ টাকা ফেরত আনার গ্যারান্টি আমার। সেটা করতে গিয়ে যা কিছু করার সেটা আমি করব। আমার সব সময় পেশাদার লোক পছন্দ।
(প্রিয়.কম) আপনি একটি বক্তব্য দেখলাম-‘আমি মৌলিক ছবি বানাই না। প্রযোজকের টাকা দিয়ে ছিনিমিনি খেলার বদভ্যাস আমার নাই। আমি বুদ্ধিজীবী নই। আমি শুধু একজন পেশাদার পরিচালক।’ আপনার এ বক্তব্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। আসলে বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলবেন কী?
মালেক আফসারী: আমার প্রথম কাজ হচ্ছে প্রযোজককে রক্ষা করা। সিনেমা হল রক্ষা করা। সিনেমা নগদ পয়সার ব্যবসা। এখানে কোন বাকি চলে না। এটা তো ইন্ডাস্ট্রি। এখানে আমি প্রোডাক্ট দিতে চাই। তবে এমন কোন প্রোডাক্ট দিতে চাই না যা পাবলিক দেখবে না। পাবলিককে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। কারণ তাদের ভোটেই তো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এদের হাততালি, শিস আমি কেন মিস করব! যারা নাইট ক্লাবে যেতে পারে না, আমি তাদের জন্যই তো নাইট শো বানাই। এটাই আমার কাজ। আমি মানুষকে আনন্দ দিতে চাই। যেটা নকলের কথা বললেন, আমার সব ছবিই নকল। আমি কোথাও না কোথাও এই ঘটনাগুলো দেখছি।
(প্রিয়.কম) তবে সিনেমা কীভাবে আপনার দর্শনবোধকে প্রভাবিত করে?
মালেক আফসারী: শুরু থেকেই আমার সবকিছু পরিবারকে কেন্দ্র করে। একথা আমি আগেও বলেছি। আমি অনেক লেখাপড়া করলে হয়তো ফিল্মে আসতাম না। আমার যে লেখাপড়ার মান, তা তো আমি জানি। আমি তো নকল করে পাস করেছি। আর কি করেছি তা আমি জানি। আমি ওরকম ভালো ছাত্র ছিলাম না। তাই ভালো চাকরিও পেতাম না। আমি স্কুল পালিয়ে সিনেমাই দেখতাম। আমার স্বপ্ন, ধ্যান-ধারণা, কীভাবে সিনেমায় আসব।
ঘটনাক্রমে আমি নায়িকা সুচরিতার সঙ্গে একটি সিনেমায় অভিনয় করলাম। তখন ও আমাকে বলল, ‘ওই তোকে তো চোরের মত লাগে।’ আমি তখন একটু লজ্জা পাইছি। আমি তখনই ভাবছি আমি আর অভিনয় করব না। টেকনিশিয়ান হবো। যদিও অভিনয়ের ক্ষুধা পেটে। নাটকে ঢুকে গেলাম। সেখানে তো চেহারা লাগে না। তারপর আবারও সিনেমায় ঢুকে গেলাম। তখন পেশা হিসেবেই বেছে নিয়েছি।
এ পেশাটাই আমাকে টানছে। আমি নামাজ পড়লেও বলি আল্লাহ আমাকে সিনেমায় ঢুকিয়ে দিও! এরকম পাগল। সিনেমায় পোকা ছিল মাথায়। আমি এফডিসির গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঢোকার জন্য। কাদের নামে তখন একজন দারোয়ান ছিল। তাকে আমি টাকা, সিগারেট দিতাম। বিনিময়ে ভেতরে শুটিং দেখার জন্য ঢুকতে দিত। অনেক ত্যাগ করেছি এই সিনেমার জন্য। সমকামীদের খপ্পরেও পড়েছিলাম।
(প্রিয়.কম) 'অন্তর জ্বালা' ছবিটি অতীতের বাংলা সিনেমার সমস্ত রেকর্ড ভাঙবে বলে আপনি মনে করেন, কী আছে এই ছবিতে?
মালেক আফসারী: আপনাকে একটা জাহাজের গল্প বলি, তাহলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। একটা জাহাজ হাজীদের নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিল। এরইমধ্যে ঝড় উঠে। সবাই বুঝতে পারছে একটু পরে জাহাজ ডুবে সবাই মারা যাবে। হাজীদের মধ্যে একজন ছিল মহল্লার হালকা-পাতলা পীর টাইপের একজন। তিনি বললেন, কেউ কাঁদবেন না, সবাই আল্লাহকে ডাকেন, আমি বলছি এই জাহাজ ডুববে না। এরপর আরও দুই-তিন ঘণ্টা ঝড় চলল। কিন্তু জাহাজটা ডুবল না। পাড়ে ভিড়েছে। তখন তো বুঝেনই বিষয়টা। তারপর তার ব্যবসা বাণিজ্য এমন বাড়ল! অনেক টাকার মালিক হয়ে গেল। সবাই ভাবল, তার কথায় কি যেন হয়! কিন্তু শেষ জীবনে এই ঘটনাটা আবার সেই পীর টাইপের লোকটি বলে, আমি জানি সবাই মরে গেলে আমিও মরে যাব। কিন্তু একটা কথা বলে দেখি, কি হয়!
(প্রিয়.কম) তাহলে কী ধরে নিবো সিনেমাটি হিট করার জন্যই এ কথাগুলো বলা?
মালেক আফসারী: যেভাবেই হোক ছবিটাকে আমি হিট করাতে চাই। সেটা মিথ্যা কথা বলে হোক আর সত্য কথা বলে হোক। পাবলিক যখন টিকেট কেটে সিনেমাটা দেখবে, খারাপ হলে আমার মাকে গালি দেবে। আর ভালো হলে বলবে, আরে এ তো বম্বের ডিরেক্টর! এজন্য আমি জানি কোনটা হাত তালি দেবে কোনটায় দর্শক কাঁদবে। এই ছবির ফটোগ্রাফি, পোস্ট প্রোডাকশন সব বাংলাদেশের।
এই ছবির প্রত্যেকটি আর্টিষ্ট দুর্দান্ত অভিনয় করেছে। প্রযোজক স্বাধীনতা, টাকা, পুরো পিরোজপুর, র্যাবসহ সবই আমারে দিয়েছে। আমি যদি ওই মানের ছবি দিতে না পারি, তাহলে আমি কীসের পরিচালক! আমি জীবনে ২৩ বার কসম কেটেছি সিনেমা ছেড়ে দিব হিট না হলে/ তেইশ বারই সফল হয়েছি! আমার কনফিডেন্স ভালো কারণ আমি কোন মৌলিক ছবি বানাই নি। পাবলিক যা চায়, সেটাই আমি বানিয়েছি।
(প্রিয়.কম) ‘অন্তর জালা’র পোস্টার, টিজার, গান প্রকাশিত হয়েছে, এখন যে সময়টা চলছে, দর্শক তো ঝকঝকে সিনেমা দেখতে চায়। কিন্তু অনেকেই এ সিনেমাটির মানের জায়গাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
মালেক আফসারী: তবে আমার তা মনে হয় না। আমার সিনেমা শতভাগ ঝকঝকে। আপনি বম্বের যে কোন পোস্ট প্রোডাকশনের সঙ্গে এ সিনেমাটির তুলনা করতে পারবেন। অরিজিনাল ডিজিটাল ছবি বলতে যা বোঝায় তা হলো ‘অন্তর জ্বালা’। এর আগে যা হয়েছে তা ৩৫ এর স্টাইলের ছবি। এটা ডিজিটাল স্টাইলের ছবি।
(প্রিয়.কম) আপনার সিনেমার মূল পাত্র-পাত্রী (জায়েদ খান এবং পরীমনি) তো দর্শকদের বিচারে এখনও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। আর তাদের তো থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ডও নেই। মান সম্মত অভিনয়ের একটি প্রসঙ্গ চলে আসে। সেদিক থেকে আপনার দুই মূল পাত্র-পাত্রীর অভিনয় নিয়ে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?
মালেক আফসারী: সিনেমার আর্টিস্ট যারা রয়েছেন তাদের নব্বই ভাগেরই মঞ্চের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। সিনেমা তো ক্যামেরার কাজ। এখানে মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে এটা তেমন কেনো কথা না। ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া বহু বড় বড় স্টারের জন্ম হয়েছে। মঞ্চ থেকে অভিনয় শিখে আসতে হবে বিষয়টা এমন না। পরিচালক যদি ভালো করে ব্রিফ্রিং দিতে পারে রোবট ছাড়া রক্ত মাংসের যে কোন কেউ ভালো করেই অভিনয় করতে পারে। অভিনয় কারও শিখে আসতে হবে বিষয়টা তেমন না। সিনেমায় ক্যামেরার জাদু জানতে হবে পরিচালককে।
(প্রিয়.কম) কেন তাদের আপনি এই সিনেমাতে নিলেন?
মালেক আফসারী: ওই যে সুপারস্টারকে নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা। সরি বলে না। তখন থেকেই জেদ ছিল ল্যাংড়া ঘোড়া নিয়ে বাজি মারব এই রেসের ময়দানে। তাহলেই না আমি পরিচালক। এই জেদ মেটানোর জন্য। কিন্তু আমি অন্য কাউকে নিয়া কাজ করতাম না।
(প্রিয়.কম) আরেকটা বিষয়, সাউথ ইন্ডিয়া থেকে কপিরাইট এনে কলকাতায় রিমেক হয়। দর্শকরা সিনেমা হলে বসে এসব ছবি দেখে তৃপ্ত হয় কিংবা প্রত্যাখ্যান করে। আমাদের দর্শকরা ইউটিউব চ্যানেলে তেলেগু-মালায়ালাম ছবি উপভোগ করে। আর সেই সব ছবি যদি কোন নির্মাতা নকল করে প্রত্যাশা করেন, সিনেমা হলে দর্শকদের ঢল নামবে। এটা কী ঠিক মনে করেন?
মালেক আফসারী: হ্যাঁ, ভালো জিনিসটাই তো বারবার রিমেক হয়। আপনি দেখেন না, সালমান টিকে আছেন সাউথের ছবি রিমেক করে। কলকাতা ইন্ডাস্ট্রি টিকে আছে সাউথের উপর। আমাদের সুপারস্টারের যে কটা ছবি হিট সবগুলোই তো সাউথের ছবির নকল। তাইলে আপনি কেন বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। আমার ‘এই ঘর এই সংসার’ ও ‘ঘরের বউ’ কী কলকাতায় রিমেক হয় নাই! ভালো জিনিস বাররবার হবে। প্রযোজক তার টাকাকে সেভ করতে চায়। আর সেভ না করতে পারলে আপনি ফ্লপ ডিরেক্টর। আর ফ্লপ ডিরেক্টরকে কেউ সালামও দিতে চায় না। এখানে যে সূর্য জ্বল জ্বল করে তার মূল্য আছে।
(প্রিয়.কম) আচ্ছা, একটা সোজাসাপ্টা কথা বলেন তো। যদি উল্টো হয়- এই ছবি মুক্তির পর নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ল আপনার ক্যারিয়ারে?
মালেক আফসারী: আপনি যখন রোনালদোকে নিয়ে মাঠে খেলতে যাবেন ও কয়টা গোল করল সেটা বিষয় নয়। ও মাঠে কতক্ষণ থাকল সেটাই বিষয়। ওর দাম কমে না। আমি যা যা বলছি পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে সিনেমাটি দেখলে শতভাগ না দুইশত ভাগ পয়সা উশুল হবে দর্শকদের। তাদের মন ভরে যাবে।
(প্রিয়.কম) ইন্ডাস্ট্রিতে তো এখন প্রযোজকদের মধ্যে একটা ইনসিকিউরিটি কাজ করে। মানে শুরুতেই সিনেমা থেকে অর্থ হারানোর ভয়?
মালেক আফসারী: এমনটা হওয়ারই কথা। একটি ছবি শেষ না করেই আরেকটি ছবির শুটিং শুরু করেন নায়ক-নায়িকারা। প্রযোজককে বসিয়ে রাখে। খরচ বাড়িয়ে দেয়। ওইদিকে প্রযোজক কিন্তু আসছে। তবে ফিল্ম পলিটিক্সের নানা মারপ্যাঁচে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ধরে রাখতে আমরা পারছি না। একটা সময় গিয়ে দেখা যায়, প্রযোজক পরিচালকের কথা না শুনে নায়কের কথাই শুনে। এখানে যারা ব্যবসা করতে আসে তারা টিকে। আর যারা নখরামি করতে আসে তারা টিকে না। কখনও টিকেও নাই।
(প্রিয়.কম) বর্তমান সময়ে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাণিজ্যিক ছবির নায়িকাদের উপর এখন প্রযোজকদের আস্থা কমে যাচ্ছে। কারণ কী বলে মনে করেন?
মালেক আফসারী: এখন যারা সিনেমা প্রযোজনা করতে আসছেন তারা নায়িকার প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন। হিরোর বুকে পড়লেও মাইন্ড করে প্রযোজক। পারলে দূরে দূরে রেখে শুটিং করাতে চায়! নায়িকাকে ভালোবেসেই সে সিনেমা নির্মাণ করতে আসছে। হয়তো তিন-চারটা না হয় একটা সিনেমা বানাবে। এখানে তো প্রযোজক নিজেই আর্টিষ্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে। সংকট তো পড়বেই। কোন প্রযোজক আবার বিয়ে না করলেও নিজের অধীনে রাখতে চাচ্ছে। এরপর এমনও দেখা গেছে এমন ধরনের ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে আলাদা করে বিয়ে করে ফেলছে। রূপালি পর্দার মেয়ে তার সঙ্গে ঘুরবে, সেলফি দেবে। কিন্তু পর্দায় আর এরপর টাকা আসে না।
(প্রিয়.কম) অনেকেই বলেন, আমার সিনেমায় এখন তো বহু সমস্যা, তবে রোগের আসল দাওয়াই নাই?
মালেক আফসারী: রোগ সারাবার একটা জায়গা আছে। প্রথম কথা হচ্ছে মৌলিক ছবি করা বন্ধ করতে হবে। প্রযোজককে ডুবানো বন্ধ করতে হবে। যদিও ব্যতিক্রম আছে। দুই-একটা ছবি হিট হয়েছে। মানে নিজের মত করে একটা হিট প্রোডাক্ট বানাতে হবে। ধরেন একটি ক্যানসারের একটি ঔষধের দাম ২৫ লাখ টাকা ঠিকই একটি ঔষধ অন্য একটি দেশ বানিয়েছে, উপকার একই দাম ২৫ হাজার টাকা। আপনি নিশ্চয়ই ২৫ হাজার টাকারটা কিনবেন।
কারণ আগে জীবন বাঁচাতে হবে। এটাকে কী আপনি নকল বলবেন! এটা বাঁচার ঔষধ। প্রতিভা বিকাশ করতে গেলে এই ইন্ডাস্ট্রি টিকবে না। হুমায়ূন স্যারের মতো লোকের ছবি এই দেশে চলছে ময়ূরীর গান দিয়ে। তার মতো লোককে যদি ময়ূরীর গান দিয়ে চিনাতে হয়, তাহলে কেনো আমি সিনেমা বানাতে যাব? আমি সাহিত্যই রচনা করব। আর একটা বিষয় আমি মনে করি, সিনেমা ধ্বংস হওয়ার জন্য সেন্সর বোর্ডই দায়ী।
(প্রিয়.কম) কেন বলেন তো?
মালেক আফসারী: এখানে যে এম এ পাশ আবার যে যে ম্যাট্রিক পাশ সেও একই লেভেলের! আপনি নাটক বানান আর সিনেমা বানান সবখানেই একই সার্টিফিকেট। ৪০ লাখ টাকা দিয়ে বানালে যে সার্টিফিকেট আর ৫ কোটি টাকা দিয়ে বানালেও একই সার্টিফিকেট। একটা গ্রেড সিস্টেম করে দেওয়া উচিত। যদিও ওখানে তো সব আত্মীয় করনের মধ্য দিয়েই লোক নিয়োগ হচ্ছে। সেখানে এমন লোকও আছে যে গত ত্রিশ বছরে একটি সিনেমাও বানায়নি। তাহলে কীভাবে হবে? যোগ্য লোকগুলোর সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।
(প্রিয়.কম) একটা ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই, এই মুহূর্তে ইন্ডাস্ট্রির কার সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করা প্রয়োজন?
মালেক আফসারী: আপনি বিশ্বাস করেন, এমন লোক তো আমি নিজেই। কত ঘটনা দেখলাম এই সিনেমার জীবনে, আর কত কিছু দেখতে হবে! এখন তো মনে হয়, আমারই সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করা উচিত।
(প্রিয়.কম) প্রিয়কে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মালেক আফসারী: প্রিয়কেও।
প্রিয় বিনোদন/গোরা
- ট্যাগ:
- বিনোদন
- সিনেমা
- সাক্ষাৎকার
- মালেক আফসারী
- ঢাকা