কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে খুব কমই এমন সময় এসেছে। ছবি: এএফপি

ঘরের মাঠে রাজা, বাইরের মাঠে প্রজা!

সামিউল ইসলাম শোভন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৪৭
আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৪৭

(প্রিয়.কম) ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ নিয়ে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আলোচনা করার আসলেই কিছু আছে? হয়তো না। এখন পর্যন্ত সিরিজের সবগুলো ম্যাচে যেভাবে হেরেছে বাংলাদেশ, তা যেন দেশের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা আতশ কাচের মতো স্বচ্ছ করে দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতেও যখন ১০ উইকেট কিংবা ২০০ রানের ব্যবধানে হারতে হয়, তখন মনে হতেই পারে বাংলাদেশ ঘরের মাঠে যেমন রাজা বিদেশের মাটিতে ‘শ্রমিক শ্রেণির প্রজা’!

যারা উপমহাদেশের ক্রিকেটের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তারা হয়তো অনেকেই বলবেন এমনটাই হওয়া উচিত। অনেকেই বলবেন, ভারত কিংবা পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কাও ঘরের মাঠে ভাল করে বাইরে গিয়ে নিজেদের নামের সাথে অবিচার করে। তাই বলে বাংলাদেশের মতো এভাবে? একি অসহায়ত্ব? উত্তরটা জানা নেই। কিন্তু হ্যাঁ, লাল-সবুজ জার্সিতে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রত্যেকটি ওয়ানডেতে মাশরাফি-সাকিবদের শরীরি ভাষাটা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সমস্যাটা মাঠে নয়, মনে। 

অর্থাৎ, মানসিকভাবে একেবারেই ভাল নেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। দুই টেস্টে কোচের ‘বাড়াবাড়ি’ হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল অনেক। এ নিয়ে অধিনায়ক খোলামেলা কথা বললেন। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের খবরও হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশ পর্যন্ত উড়ে এসেছিল হাওয়ার গতিতে। তা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সে কারণেই কিনা, গণমাধ্যমকে তারা বার্তা দিল টিম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ না করতে! কিন্তু ওয়ানডেতে কি হল? ড্রেসিংরুম পর্যন্ত না যাওয়া হোক, মাঠই যেন বাংলাদেশকে অভিশাপ দিল। ব্যাটিং সহায়ক উইকেট বাংলাদেশের জন্য হয়ে গেল বধ্যভূমি। বোলিং সহায়ক উইকেট বাংলাদেশের বোলারদের জন্য রূপ নিল ব্যাটিংস্বর্গে! এ যেন ভূতুড়ে কাণ্ড। 

দল কিংবা দলের বাইরের ক্রিকেটাররাও বুঝে উঠতে পারছেন না কী হল। সাবেক জাতীয় দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল প্রিয়.কম কে বললেন, ‘কিছুই বুঝলাম না আসলে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তামিম ইনজুরিতে ছিল। যেটা খেলেছে সেটা তার মতো হয়নি। কিন্তু সে না থাকলে ওপেনার হিসেবে যে দুই ব্যাটসম্যানই নামুক, কেউ যে সুবিধা করতে পারছে না!’

অপরিচিত কন্ডিশন বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু ২০১৫ সাল ও ২০১৭ সাল এসব কন্ডিশনে বেশ নিয়মিতই খেলেছে বাংলাদেশ। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে শুরু। সেখান থেকে ২০১৬ সালে বিদেশে সফর করেনি দল। এরপর ২০১৭ সালের শুরুতেই গেল নিউজিল্যান্ড সফরে। পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। অর্থাৎ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফর বাদ দিলে সব সফরই ছিল উপমহাদেশের বাইরে। শুধু প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সফরটা বাদ দিলে বাকিগুলোতে ম্যাচ হারলেও এমন অসহায় হতে হয়নি ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ের সাত নম্বরে থাকা দলটিকে।

ওয়ানডে সিরিজে আশরাফুলের আক্ষেপ বোলারদের নিয়ে। বললেন, ‘আমি বুঝিনি এতটা খারাপ করব আমরা। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে বাউন্সি উইকেটে ব্যাট করাটা কঠিন হয়ে যায় আমাদের জন্য। তাহলে বোলারদের তো ভাল করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা তো ওপেনিং পার্টনারশিপই ভাঙতে পারলাম না! ওপেনিং থেকে যদি ১৫০-২০০ রানের জুটি আসে তাহলে সেই ম্যাচ বের করে আনতে স্বাভাবিকভাবেই কঠিন হয়ে যায়। এই সিরিজটা আমাদের জন্য কেমন যেন হয়ে গেল। অথচ এমন কন্ডিশনে আমরা এত খারাপ খেলিনি সাম্প্রতিক সময়ে।’

পরিসংখ্যানের বিচারে বাংলাদেশের সাফল্য অন্যান্য টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মতই ঘরের মাটিতে বেশি। ঘরের মাঠে ১৫৮ ম্যাচে মাশরাফিদের জয় ৬৪ ম্যাচে, হার ৯২ ম্যাচে। ফলাফল আসেনি মাত্র দুটি ম্যাচে। ব্যর্থতার হার বিদেশের মাটিতে বেশি হলেও বিশ্বকাপ কিংবা অন্যান্য টুর্নামেন্টের বদৌলতে বিদেশেই বেশি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ! পরিসংখ্যান বলছে, ১৭৭ ম্যাচে বাংলাদেশের হার ১৩১ ম্যাচে, জয় ৪১ ম্যাচে। ফলাফল হয়নি পাঁচ ম্যাচে। অর্থাৎ, বিদেশের মাটিতে খেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কম নয়। ২০১৪ পরবর্তী সময়ে একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন পারফরম্যান্স মুদ্রার ওপিঠই দেখিয়েছে। 

যে মাশরাফি বিন মুর্তজার হাত ধরে রঙিন পোশাকে উপমহাদেশে ক্রিকেট পরাশক্তি হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বাংলাদেশ, সেই মাশরাফিও সিরিজ শেষে জানালেন দল নিয়ে নিজের হতাশার কথা। জানালেন, এভাবে চলতে থাকলে অধপতনের দিকে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় ব্যাটিং-বোলিং কোনটিতেই আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল না। গেল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকেই ব্যাটসম্যান-বোলাররা দায়িত্ব নিয়ে খেলছে না। কেন এমন হচ্ছে তা জানা প্রয়োজন। দরকার হলে ক্রিকেটারদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করতে হবে। এটা লম্বা সময়ের কাজ হলেও শিগগিরই ঠিক করতে হবে। সামনেই বিশ্বকাপ। এমন পারফরম্যান্স বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য বিপদ সংকেত।’ 

বাংলাদেশের এমন অবস্থার মধ্যে কোচ কিংবা টিম ম্যানেজম্যান্টের দায় কি আসলেই আছে? নাকি ঘরের মাঠে নিজেদের উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের রশ্মি মেঘের আড়ালে হারিয়ে ফেলেছে সাব্বির-তাসকিনরা? 

এই মুহূর্তে জাতীয় দলের বাইরে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রিকেটারের মতে, দল আসলে মানসিকভাবে দূর্বল অবস্থায় আছে। কোচের অনেক সিদ্ধান্তও সামনে থেকে দেখে সমর্থকদের কাছে সাংর্ঘষিক মনে হতে পারে। তিনি বলেন, ‘কোচ চেষ্টা করেন দলকে দিয়ে পারফরম্যান্স করাতে। সেটা দলের বাইরে থেকে ক্রিকেটার আনা হোক কিংবা পুরনো ক্রিকেটার দিয়ে। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে ভাবেন না, তিনি ভাবেন দলকে কীভাবে পারফর্ম করানো যায়।’

শুধু তাই নয়, মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনকে সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারেও খানিকটা দ্বিমত পোষণ করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘ছেলেটার সামনে দারুণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। কিন্তু তাকে এভাবে নিয়ে গিয়ে লাভ তো হলই না, তার ক্যারিয়ারও হুমকির মুখে পড়ল। ইতিহাস দেখলে টের পাওয়া যাবে ক্যারিয়ারের শুরুতে কেউ ভাল না করলে জাতীয় দলে তার জায়গাটা থাকে না। সাইফুদ্দিনকে যদি এখন বের করে দেওয়া হয়, ৩-৫ বছর পর যখন পরিণত হয়ে ফিরবে তখন আর তাকে নেবে না। কিন্তু তখনই ও হয়তো ভাল খেলবে।’

ওয়ানডে সিরিজ শেষ। সামনে এখন দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে এই ফরম্যাটে পেরে ওঠা একরকম ঠেলা জাল দিয়ে তিমি মাছ ধরার সমান। তারপরও বাংলাদেশ অতীতে অনেক কিছুই করে দেখিয়েছে, যা আর কেউ পারেনি। তাই আশা করাই যায়। কিন্তু দিন শেষে এটা সত্যি, এই একটি সফর দিয়েই বিশ্ব ক্রিকেট টের পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবস্থা সত্যিকার অর্থে ‘দ্য পারভার্ট গাইডস অব ইডিলজি’র মতো। 

যেখানে রঙিন চশমা পরলে সত্যিটা প্রকাশ পেত, আর এখানে চশমাটা খুলতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাইপলাইন তথা ক্রিকেটীয় ভিতের অবস্থা টের পাওয়া গেল। 

প্রিয় স্পোর্টস/শান্ত মাহমুদ