কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

অসংখ্য ভাস্কর্য খচিত মন্দির খাজুরাহো। ছবি- সংগৃহীত

কামসূত্র খচিত রহস্যময় মন্দির খাজুরাহো!

আফসানা সুমী
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:৩৮
আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:৩৮

(প্রিয়.কম) খাজুরাহো মূলত একটি গ্রামের নাম। গ্রামে আছে অসংখ্য মন্দির যা একবাক্যে খাজুরাহো মন্দির বলে খ্যাত। ভারতের মধ্যপ্রদেশের চত্তরপুর জেলার এই মন্দিরগুলোর খ্যাতির মূল কারণ মন্দিরের গায়ে খচিত ভাস্কর্যগুলো। শিল্পের বিচারে নিখুঁত এই ভাস্কর্যগুলোর তাৎপর্য অনেক। কিন্তু সাধারণ চোখে এগুলো যেন নিন্দার বিষয়, লজ্জার বিষয়। তাহলে নিন্দিত, লজ্জাকর একটা জায়গায় পর্যটকরা কেন যায়? যায় কারণ অনেকেই ভাস্কর্যগুলোর শিল্পবোধকে শ্রদ্ধা করে আর অনেকে নিছক মজা নিতে ঘুরে আসে।

এত যে কথা এই ভাস্কর্য নিয়ে আসলে কি খচিত করা আছে খাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে? মন্দিরের দেয়ালে খচিত আছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, শিব-পার্বতীর বিয়ে, পূজার দৃশ্য, নাচের দৃশ্য, অপ্সরাদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, নাচের প্রস্তুতি, যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি, সে সময়ের জীবনযাপনের চিত্র, সাধারণ মানুষ, কৃষক, কুমারের জীবনধারা, বিভিন্ন পশু-পাখি, শিল্প-সঙ্গিত চর্চার চিত্র। এতসব শিল্পকলার ১০ ভাগ জুড়ে রয়েছে কামসূত্রের নানান ভঙ্গিমার চিত্র। এখানে কোথাও এক পুরুষের সাথে একাধিক নারীর মিলন, কোথাও নারীদের সমকামিতা আবার কোথাও পশুর সাথে দেবতার মিলন হতে দেখা যাচ্ছে।

মিলনের দৃশ্য আমাদের কাছে একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। মন্দির মানেই ভক্তির জায়গা। তাই ধর্মীয় একটি স্থানে এমন ভাস্কর্যের অবস্থান নিন্দনীয় মনে করেন অনেকেই। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ বলছে ভিন্ন কথা। ৯৫০ থেকে ১০৫০ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এই মন্দিরগুলো। খাজুরাহো ছিল ৮৫টি ভিন্ন ভিন্ন মন্দিরের আবাস। নানান সময়ে ধ্বংসের পর আজও টিকে আছে মাত্র ২০ টি মন্দির। মূলত মুসলিম শাসনামলে ধ্বংস করে ফেলা হয় অনেক মন্দির।

খাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে খচিত মিলনরত এই ভাস্কর্যগুলো বলে সে সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের কথা, চর্চার কথা। যৌনতা সে সময় কোনো অপবিত্র বা লজ্জার বিষয় ছিল না। যৌনাঙ্গকে বিষে করে পুরুষ যৌনাঙ্গকে বিশেষ ক্ষমতাধর বলে বিবেচনা করা হত। যেহেতু যৌনক্রিয়া থেকেই বংশ বিস্তার হয় এবং বিশ্বকে পরিচালিত করে যে শক্তি সেই মানব পৃথিবীতে আসে তাই এই প্রক্রিয়া ছিল পবিত্র, ঐশ্বরিক, পূজনীয়। 

খাজুরাহোখাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে খচিত কামসূত্রের বিভিন্ন আসন। ছবি- সংগৃহীত

শিব, বিষ্ণু, ব্রাহ্ম ও জৈন ধর্মের প্রতি উৎসর্গকৃত মন্দিরগুলো যে সময়ে নির্মিত হয় সে সময়কে ভারতবর্ষের সোনালী সময় বলা হয়। সোনার শহর বলে খ্যাত ছিল ভারত। প্রচুর ভাস্কর্য, শিল্প স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে সে সময়। মন্দিরগুলো ইন্দো-আর্য স্থাপত্য রীতির। খাজুরাহো গ্রামের পূর্বদিকের মন্দিরগুলো ব্রাহ্মণ্য ও জৈন মন্দির। পশ্চিমে রয়েছে যোগিনী, কেন্দ্রীয় মহাদেব, দেবী জগদম্বে, চিত্রগুপ্ত বিশ্বনাথ এবং নন্দীর মন্দির। দক্ষিণে আছে দুলাদেও মন্দির ও চতুর্ভুজ মন্দির। এছাড়াও আছে পার্বতী মন্দির, লক্ষণ মন্দির। প্রত্যেক মন্দিরের কেন্দ্রে আছে একটি করে দেবতার মূর্তি। তবে মন্দিরগুলোকে অন্যসব মন্দির থেকে পৃথক করেছে মানব্জাতির কামনার প্রতি এর উদার দৃষ্টিভঙ্গি।

নারী-পুরুষের প্রেম একটি চিরন্তন সত্য বিষয়। সকল প্রানীগোত্রের মাঝেই শারীরিক ক্রিয়া বিদ্যমান। সহজ-স্বাভাবিক একটি ক্রিয়া যা আমরা সবাই জানি তবু না জানার ভান করি। আদিযুগের মতো বিষয়টি স্বাভাবিক এবং স্বর্গীয় মাত্রাইয় বহাল থাকলে আজ হয়ত হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনা আর ঘটত না। 

খাজুরাহো তৈরির পেছনের গল্প জানা যায় না। তবে প্রচলিত দুইটি মিথকে খাজুরাহো গ্রামের অনেকেই সত্য বলে বিশ্বাস করেন। একটি মিথে বলা হয়- বেনারসের এক ব্রাহ্মণ কন্যা ছিল যে অল্প বয়সেই বিধবা হয়। তার নাম ছিল হেম্বতী। হেম্বতীর রূপ লাবণ্য ছিল অতুলনীয়। এক জোতস্নারাতে স্নানরত অবস্থায় তাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যান চন্দ্রদেব। তিনি মর্ত্যে নেমে আসেন এবং হেম্বতীর সাথে মিলিত হন। পরে দু'জনেই তাদের ভুল বুঝতে পারেন। হেম্বতী গৃহ ত্যাগ করে চলে আসেন খাজুরাহোতে। এখানে তিনি পূত্র সন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখেন চন্দ্রবর্মণ। চন্দ্রদেবের আশির্বাদে চন্দ্রবর্মণ সাহসী এবং বলবান পুরুষ হয়ে ওঠেন এবং খাজুরাহো অঞ্চলের রাজা হন। পিতার আদেশে তিনি নির্মাণ করেন ৮৫টি মন্দির। বলা হয় চন্দ্রদেব আর হেম্বতীর প্রণয়ের গল্পই খচিত মন্দিরে মন্দিরে। এভাবেই তাদের পাপ মোচন ঘটে।

আরেকটি মিথ ছিল এমন যে, কলিঞ্জর রাজ্যের রাজব্রাহ্মণ মনিরামের কন্যা ছিলেন হেম্বতী। মনিরাম একবার ভুলবশত রাজাকে অমাবস্যার রাতকে পূর্ণিমার রাত বলে ব্যাখ্যা করেন। হেম্বতী রাজার ক্রোধানল থেকে বাবাকে বাঁচাতে চন্দদেবের আরাধনায় বসেন। চন্দ্রদের হেম্বতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে প্রণয়াবদ্ধ হন। হেম্বতী পরবর্তীতে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। বিষয়টি জানার পর মনিরাম নিজেকে অভিশাপ দিয়ে পাথরে পরিণত করেন। হেম্বতীর সন্তান চন্দ্রতেয় পিতার আশির্বাদে চান্দেলা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পিতার আদেশে খাজুরাহো গ্রামের মন্দির নির্মাণ করেন। 

মণিরামের পাথর হয়ে যাওয়ার গল্প থেকেই আজও বিশ্বাস করা হয় এই মন্দিরে সন্ধ্যার পর প্রবেশ করলে যে কেউ পরিণত হবে পাথরে। তাই স্থানীয়রা পর্যটকদের নিষেধ করেন সন্ধ্যার পর খাজুরাহো অঞ্চলের মন্দিরে যেতে! তবে কুখ্যাতি যাই হোক না কেন প্রেমের মন্দির বা টেম্পল অব লাভ হিসেবে অনেক প্রেমিক হৃদয়ের মন ছুঁয়ে যায় খাজুরাহো। 

তথ্যসূত্র: খাজুরাহো

সম্পাদনা: ড. জিনিয়া রহমান।

ভ্রমণ সম্পর্কিত আরও জানতে চোখ রাখুন আমাদের প্রিয় ট্রাভেলের ফেসবুক পাতায়। ভ্রমণ নিয়ে আপনার যেকোনো অভিজ্ঞতা, টিপস কিংবা লেখা পোস্ট করুন আমাদের সাইটে । আপনাদের মতামত জানাতে ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।