বিভিন্ন কারণে এসব শিশু পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। ছবিটি কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে ফোকাস বাংলার তোলা
হারিয়ে যাওয়া ৭০০ রোহিঙ্গা শিশুর বাবা-মাকে খুঁজে দিলো কামাল
আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭, ২২:১২
(প্রিয়.কম) ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর এখন পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে আসতে গিয়ে অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন তাদের প্রিয়জন থেকে। ওইসব শিশু ও মানুষদের স্ব-উদ্যোগে সহায়তা করছেন কামাল হোসেন নামে আরেকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। যিনি নিজেই প্রায় কুড়ি বছর ধরে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা।
কামাল ২৭ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাতশো পরিবারকে তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে পুনরায় মিলিত হতে সহায়তা করেছেন। কামাল হোসেন বলেন, তিনি যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তার বয়স ছিল নয় বছর। ১৯৯৮ সালে তিনি মিয়ানমার থেকে শরণার্থী হয়ে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি বাবা-মাকে না জানিয়ে একাই এসেছিলেন এবং ক্যাম্পে থাকার জন্য নথিবদ্ধ হয়েছিলেন।
প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা শিশুদের বড় সমস্যা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। ছবি: ফোকাস বাংলা
আন্তর্জাতিক একটি ত্রাণ সংস্থায় গার্ডের কাজ করেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, এত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। এরা আসছে- কিন্তু গ্রাম চিনে না - পথঘাট চিনে না। তারা কখনো বাংলাদেশে আসে নাই। এদিক ওদিক যেতে গিয়ে অনেক বাচ্চারা তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে, কারো বা আত্মীয় স্বজন হারিয়ে যাচ্ছে। খুঁজে পাচ্ছে না।
কামাল হোসেন বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল বাংলাদেশে ঢোকার পর এক নারী আমার গেটের সামনে আসি কান্নাকাটি করছে। আমি জিজ্ঞেস করার পর উনি বললেন, আমার একটা ছেলে আজকে দুদিন ধরে হারিয়ে গেছে, আমি খুঁজে পাচ্ছি না। সারাদিন ডিউটি করার সময় আমি চিন্তা করি, আমার মনে হলো অনেক মানুষ রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিচ্ছে, টাকাপয়সা, জিনিসপত্র দিচ্ছে, আমার তো ওই ধরনের কোনো সম্পদ নেই। আমি তো কিছু করতে পারছি না। তাহলে আমি যদি মাইকিং করে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোর মা-বাবাকে খুঁজে দিতে পারি, তাহলে যারা ত্রাণ দিচ্ছে, ওদের মতো ওই ধরনের সোয়াবগুলোও আমি পাব।’
এর পর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর কামাল হারিয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে আবার মিলিয়ে দেবার কাজ প্রথম শুরু করেন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশই শিশু। ছবি: প্রিয়.কম
কামাল হোসেন বলেন, তার নিজের পকেট থেকে তার বেতনের ৩০০০ টাকা দিয়ে তিনি চার দিনের জন্য একটা মাইক ভাড়া করেছিলেন মাইকিং করার জন্যে।
‘চার দিন পর যখন সময় চলে গেসে, আমি মাইক ফেরত দেবার জন্য যাচ্ছি, তখন ইউএনএইচসিআর আমার সঙ্গে কথা বলল, বলল আপনি তো নিজের টাকা খরচ করি মাইকিংটা করছেন। এখন আপনার তো সময় চলে গেছে, আপনি তো মাইকগুলো ব্যাক দিতে চান। তালে আমরা মাইকগুলোর ভাড়া দেব, কিন্তু আপনি একটু হেল্প করতে পাবেন কি না’, বলেন তিনি।
রাজি হয়ে গেলেন কামাল হোসেন। তিনি একটি সাইন বোর্ড তৈরি করে টাঙালেন হারানো পরিবারদের মিলিয়ে দেবার জন্য। সেখান থেকেই তিনি শুরু করলেন মাইকিং করতে। কামাল জানান, কোনো ছেলে হারিয়ে গেলে তিনি তাকে তার গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করেন, তার নাম, তার আব্বা-আম্মার নাম, তার বয়স এসব নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তারপর মাইকিং করতে থাকেন।
এভাবে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে মাইকিং করে এ পর্যন্ত ৭৩৭ জন হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে তিনি বাবা-মার হাতে তুলে দিয়েছেন কামাল হোসেন।
শুধু হারিয়ে যাওয়া নয়, বিভিন্ন কারণে এসব শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ছবি: ফোকাস বাংলা
কামাল হোসেন বলেন, কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের পর তবেই তিনি বাচ্চাদের ফিরিয়ে দেন সঠিক বাবা-মায়ের কাছে। যখন একটা ছেলে হারিয়ে যায়, তখন মাইকিং করার পরে আব্বা আম্মা যখন ফিরে আসে, তখন তাদের কত আনন্দ হয়, ওই সময় আমারও আনন্দ লাগে। হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটাকে সঠিক বাবা মায়ের কাছে যে ফিরিয়ে দিতে পারছেন এটা তার জন্য একটা বিরাট আনন্দের অনুভূতি।
কামাল জানান, তিনি যখন খুবই ছোট তখন নাসাকা বাহিনী তাকে দিয়ে কুলির কাজ করানোর চেষ্টা করলে তিনি পালিয়ে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে। এর কয়েক বছর পর তার বাবা-মা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও বহুদিন বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি। তিনি মানুষ হয়েছিলেন আরেকজনের আশ্রয়ে। পরে বাবা-মাকে খুঁজে পান কামাল। তাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্ট তিনি জানেন। আর ব্যক্তিগত সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এখন হারিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন কামাল হোসেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
প্রিয় সংবাদ/শান্ত