কোলাজ ছবি: প্রিয়.কম
সমস্যাহীন নাগরিকতায় শান্তিময় বসবাস
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:১০
আমাদের দেশ, আমাদের নাগরিকতা বর্তমানে সব সমস্যামুক্ত। আভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক সব ক্ষেত্রেই আমরা সর্ব সমস্যার ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না, সামাজিকমাধ্যমগুলোর দিকে তাকান, এমন কী গণমাধ্যমেও, ‘বার্নিং’ সমস্যা একটাই, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কেন ‘এভ্রিল’ বাদ পড়ল। এটা কী সমস্যামুক্ত দেশের লক্ষণ নয়? ‘অসুন্দর’ কোনো সমস্যা যখন না থাকে তখনই মানুষ ‘সুন্দর’ জনিত সমস্যায় ভোগে। ‘বিনোদন’ই তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এভ্রিলের মুকুটচ্যুতি, অপুর সংসার, ড. মাহফুজের সঙ্গীত, এসবই আমাদের মতোন ‘সমস্যাহীন’ জাতির সামনে এখন প্রধানতম সমস্যাসমূহ।
কেউ একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা, প্রধান বিচারপতির অসুস্থতাজনিত ছুটি বিতর্ক, ভারত থেকে নতুন ঋণ নেওয়া, রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন-ভারতের বাংলাদেশের বিপরীতে অবস্থান, মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, এসব মূলত কোনো সমস্যা নয়, প্রধান সমস্যা হলো ‘এভ্রিলের মুকুটচ্যুতি’। ব্যতিক্রম বাদে বিশ্বের সকল প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কিছু একটা হলেই গণেশ উল্টে যাবে।’ ভদ্রলোকের এই আক্ষেপ হয়তো তেমন কাউকে ছুঁয়ে যাবে না, হয়তো এ আক্ষেপ শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়েই থাকবে। অবশ্য এমন ক্ষণে যে দেশের বুদ্ধিজীবী(?)গণও ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’ নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেন তখন ‘নিঃশ্বাস’ তো ‘দীর্ঘ’ হওয়ারই কথা।
আমরা এখন আক্রান্ত, দেশ আক্রান্ত। মিয়ানমার থেকে একটি পুরো জাতিকে ‘রুট আউট’ করার প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, অস্বীকার করা হচ্ছে তাদের জাতিসত্তাকে, বলা হচ্ছে তারা বাংলাদেশের মানুষ। প্রত্যক্ষ না হলেও এটা একটা পরোক্ষ যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে আমরা নিশ্চিতভাবে কঠিন সমস্যাক্রান্ত। আর এ সমস্যার উত্তরণ, এ যুদ্ধ বিজয়ের প্রধানতম পথ হলো কূটনীতি। কিন্তু সেই কূটনীতিতেই আমরা কতটা সফল। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুচি’র এক মন্ত্রী এসেছিলেন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। যতটুকু জানা গেছে, সে আলোচনায় সমস্যা সমাধানে ১৯৯২ এর চুক্তি অনুসরণের কথা হয়েছে। সমালোচনাও হয়েছে এমন কথার। বলা হয়েছে, ৯২-এর চুক্তি ছিল কৌশলগতভাবে একটি ভুল চুক্তি। এ চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করে তাদের ফেরত নেয়ার কথা ছিল। যেহেতু রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবেই অস্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার, সুতরাং ৯২ এর চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরানো সম্ভব হবে না বলেও আক্ষেপ করেছেন অনেকে। তদ্সঙ্গে ৯২-এ অধিষ্ঠিত সরকারকে তুলোধুনো করেছেন, ভুল চুক্তি করার কারণে। কিন্তু মজার বিষয় হলো ১৯৭৮-এ রোহিঙ্গা বিষয়ে তৎকালীন বার্মার সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয়েছিল। সে চুক্তি অনুযায়ী কোনো যাচাইবাছাই ছাড়াই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরেছিলেন। ৯২-এর চুক্তি যদি ভুল হয়ে থাকে তবে তো ৭৮-এর চুক্তি সম্মুখেই ছিল সেই চুক্তিও ফলো করা যেত, না কী যেত না? যারা আক্ষেপ করলেন ৯২-এর চুক্তি ভুল বলে, তারাও তো ৭৮-কে সামনে আনলেন না!
আমাদের বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কিছুদিন ধরেই তুমুল বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ক রায়ের পরে। সেই বিতর্কটা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে প্রধান বিচারপতির ছুটি বিষয়ক বিতর্ক। আর তারই নানা দৃশ্যক্রম আমরা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি। প্রধান বিচারপতির অসুস্থতাজনিত ছুটির কথা জানালেন আইনমন্ত্রী, সাংবাদিকদের ছুটির দরখাস্তও দেখালেন। এত কিছুর কী প্রয়োজন ছিল, যদি বিভ্রান্তিই থাকে তাহলে যার ছুটি দরকার তিনিই প্রকাশ্যে জানিয়ে দিতেন। দরখাস্ত প্রদর্শনের পর আবার কথা উঠেছে স্বাক্ষর বিষয়ক জটিলতা নিয়ে। প্রধান বিচারপতির দুরকমের স্বাক্ষর ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এখানেও বিভ্রান্তি। এমন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিও একটা সমস্যা।
একটা গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিল অনেকটা এরকম ‘চালের দাম কমেছে কাগজে কলমে’, অর্থাৎ বাজারে কমেনি। চালের দাম ইতিহাস গড়েছে। কারণও ছিল, হাওর বিপর্যয়, অতিবৃষ্টি, চাল প্রধান অঞ্চলগুলোতে বন্যা, তাও আবার দু’মৌসুমেই, সুতরাং দাম বৃদ্ধিতে ইতিহাস গড়াই কথা। অবশ্য সমস্যা সমাধানে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সরকার চাল ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কিছু বিধিবিধান জারি করেছে। যেমন চাল মজুদ না করার নির্দেশ জারি হয়েছে। চাল ব্যবসায়ীদের চাল মজুদের জন্য শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। গুদামে গুদামে অভিযান চলেছে। দাম কমানোর প্রক্রিয়ায় ঘৃণিত রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকেও চাল আমদানি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে ভারত থেকেও চাল আমদানির কথা চলছে। কিন্তু অবাক হবার বিষয় এতসব কর্মযজ্ঞের প্রভাব কিন্তু বাজারে খুব একটা পড়েনি, কমেনি চালের দাম।
অবশ্য চালের দাম-টাম এগুলোও কোনো সমস্যা না। আমাদের প্রধানতম আলোচিত সমস্যা হলো, ‘এভ্রিল কেন মুকুট হারায়’, ‘ড. মাহফুজ কেন গান গায়’ ‘অপুর সংসার কেন ভাঙে’। প্রশ্নবোধক এসব শব্দ সমষ্টি শুনে মনে হয় না, এগুলো কোনোও বাংলা সিনেমার নাম। বাংলা সিনেমা বলে অবহেলা করবেন না। আমরা আমজনতা এখন সিনেমা হলেই আছি। আমাদের সামনে মেগা বায়োস্কোপ চলছে, পর্দায় দৃশ্যায়িত হচ্ছে অদ্ভুত কিছিমের নানা কেচ্ছা-কাহিনী। আর আমরা সেই বায়োস্কোপের নিমগ্ন দর্শক, যারা নিশ্চুপ মুগ্ধতায় শুধু দেখছি আর দেখছি।
ফুটনোট: শেষে একটি গল্প বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। গল্পটি পুরানো এবং সবার শ্রুত। তবুও ‘থিম’টা আমাদের সাম্প্রতিকতায় মিলে যায়।
দারোগা বলছেন, চোর সব নিয়ে গেল আপনি দেখলেন, কিছু বললেন না কেন?
গৃহস্থের সোজা জবাব, প্রথমে ঢুকল, জিনিসপত্তর নিলো, পরনের ধুতিটাও খুলল, তখনও আমি ভাবছি দেখি ব্যাটা কী করে।
তারপর?
তারপর তো সব নিয়ে চলেই গেল।
ভেবে দেখবেন ধুতিটাও গেল কিন্তু।
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]