কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিতদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ছবি: ফোকাস বাংলা

পোপের সফর, জবাবদিহিতা এবং আমাদের গণমাধ্যম

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:০৩
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:০৩

খ্যাত লেখক মঈনুল আহসান সাবের ফেসবুকে লিখলেন, “পোপের মুখে ‘রোহিঙ্গা’ উচ্চারিত হওয়ামাত্র মানবজাতি বিশাল অভিশাপ থেকে মুক্তি পেল।” আমাদের কোনো কোনো গণমাধ্যমের দীনতা নতুন নয়। বাংলাদেশে ‘ফকরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের’ শাসনামল থেকে এই দীনতা ‘হ্যাংলামো’তে রূপ নিয়েছে। কথাটা শুনতে হয়তো কানে লাগে, বিশেষ করে যারা গণমাধ্যমের সাথে জড়িত তাদের কাছে এবং আমার নিজের কাছেও। গণমাধ্যমের একজন নগন্য কর্মী হলেও পুরো মাধ্যমটাই যখন জবাবদিহির কাঠগড়ায় উঠে তখন জবাবটা নিজের মধ্যেও তৈরি হয়। কিন্তু মুশকিল হলো জবাব তৈরির বিষয়ে এবং ‘দিহিতার’ প্রশ্নে। 

কী জবাব দেবো, হয়তো মাধ্যমের মধ্যমনিদের কাছে কোনো জবাব রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতন স্রেফ কর্মী বা কামলা যাই বলেন তাদের কাছে এর কোনোও জবাব নেই। অথচ কষ্টের বিষয় হলো, এর সম্মুখীন আমাদেরই বেশি হতে হয়, যেহেতু আমাদের চলাচল আমজনতার সাথে, চায়ের দোকানি থেকে শুরু করে আদার বেপারি পর্যন্ত। বলতে পারেন জাহাজের বেপারি কই গেল। আমাদের দৌড় ভাই আদা পর্যন্তই, জাহাজের খবর রাখার আবশ্যকতা নেই। জাহাজের এমন বেপারিদের গায়ে ‘পাঁচ টাকা’ মূল্য বৃদ্ধির আঁচ লাগে না, হাজার কোটি লোপাটেও তাদের কোনো ‘রা’ নেই। তাদের কোনো ‘দিহি’ নেই, তাই কোনো ‘জবাব’ও নেই।  

যা বলছিলাম, জবাবদিহিতা ‘মধ্যমনিরা’ না করলেও আমাদের করতেই হয়। সেদিন চা খাচ্ছিলাম রোড ডিভাইডারে। চায়ের দোকানি জিজ্ঞেস করল ‘পোপে ক্যাঠা’? 

বললাম, আমাগো যিমুন মদিনার মসজিদের ঈমাম আছেন, তিমুন খ্রিস্টানগর পোপ।

-হ্যায় রোহিঙ্গাগর কী করবো? 

-তাগো দেখতে আইছে। 

-হ্যায় কী সাহায্য দিব, হ্যার কতায় কী সুচি রোহিঙ্গাগর ফিরত লইবো? 

জবাবদিহিতার লেভেলটা দেখলেন? মাধ্যমের হয়ে তো বটেই, পোপের হয়েও আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। আর আমাদের মধ্যমনিরা থাকেন পোপের মুখ থেকে কখন ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিঃসৃত হবে তার প্রতীক্ষায়! 

পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পোপের সফর খুব একটা অর্থবহ হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে? এমন প্রশ্নটি আমাদের মাধ্যমের মধ্যমনিরা কখনও করেছেন। ঝাঁকের কই ঝাঁকে মেশার আগে অন্তত কেন ঝাঁকে মিশছেন এমন প্রশ্নটা তো মাথায় থাকতে হবে। 

অনেকেই বিগলিত দেখলাম পোপের সফরে। একজন ধর্মীয় নেতা এবং সে যদি মানবতাবাদী হন তাহলে মানুষের দুঃখে তিনি দুঃখিত হবেন, এটা নিতান্তই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমাদের কতিপয় সেক্যুলাররা যাদের ব্যঙ্গ করে ‘হুজুর’ ডাকেন, এমন অসংখ্য হুজুরেরা দিনের পর দিন রোহিঙ্গাদের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের ঘর নির্মাণ, খাবারের সংস্থান, নানা কিছুর জন্য ক্রাইসিসের শুরু থেকেই শ্রম ও অর্থ দিচ্ছেন। কিন্তু কই তাদের নিয়ে তো মিডিয়ায় কোনো মাতামাতি নেই! বরং সুযোগ পেলেই কোনো কোনো মিডিয়া বা মিডিয়ার কোনো মধ্যমনি মানুষের সেবারত এহেন হুজুরদের কার্যক্রম নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন ও করেছেন।   

‘ঘরের চেয়ে পরের বউ না কী সুন্দর’, আলোচনার সাথে এমন প্রবাদটি হালকা মনে হলেও প্রবাদের ‘মোরাল’টি কিন্তু যথার্থ। যারা ঘরের মানুষের কাজকে ভালো চোখে দেখেন না বা দেখতে চান না, তারা যখন পরের কাজের প্রশংসা করেন তখন তাতে একটা ‘কিন্তু’ এসে দাঁড়ায়। এই ‘কিন্তু’টা নানাভাবে বিশ্লেষিত হতে পারে, উত্থাপিত হতে পারে। যেমন মঈনুল আহসান সাবের করেছেন। 

দুই.

‘রোহিঙ্গা’ একটি ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত শব্দ, স্বীকৃত সম্প্রদায়। যাদের এক সময় একটি স্বাধীন দেশ ছিল, তারা ছিলেন জাতিরাষ্ট্রের অর্ন্তভুক্ত। কিন্তু তাদের দেশ কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে। আর যারা হরণ করেছে তারাই এখন রোহিঙ্গাদের সম্প্রদায়গত স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করছে, তাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা করছে। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিতে আপত্তি জানানো তারই একটি প্রয়াস। আর এই প্রয়াসের সাথে যুক্তরা ‘এথিনিক ক্লিন্সিং’ এর সমর্থক এবং ‘রোহিঙ্গা’ না বলাটা তারই সমার্থক।

আর এ কারণেই পোপের ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উচ্চারণ অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম এতে বোঝাতে চায় যে, পোপ মানবতার পক্ষে, তিনি রোহিঙ্গাদের ব্যথায় সমব্যথী। একজন মানবতাবাদীর ক্ষেত্রে বিষয়টি বোঝাতে হবে কেন, প্রশ্নটা এখানেই। ‘রোহিঙ্গা’ কোনো ধর্ম নয়, একটি সম্প্রদায়, এক সময়ের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জাতি। একটি সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করা নিয়ে কেন এত কথা উঠবে, কেন এত চিন্তা-ভাবনা করতে হবে! বার্মার ‘মগ’রা তো চাইছেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মানুষ-বিস্মৃত হোক, ‘রোহিঙ্গা’রা নির্মূল হোক। আর এই চাওয়ার বাস্তব রূপ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ। আর সেই হত্যা ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে মানবতাবাদীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতেই তো পোপের আসা। এমন আসায় যদি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি, মজলুম সম্প্রদায়ের পরিচিতিটিই অনুল্লেখ্য থাকে তাহলে কাদের প্রতি এই সমবেদনার সাড়ম্বর আয়োজন?

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিয়ে এমন হ্যাংলামোর কারণ হলো, পোপকে মানবতাবাদী প্রমাণ করা। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বভাবতই মানবতাবাদী, এটা প্রমাণের আয়োজন আর প্রয়োজনে যাই থাকুক অন্তত নিঃস্বার্থ মানবতা নেই। এমনটা করতে পারে পশ্চিমারা। কারণ ধর্ম ও মানবতা বাদেও তাদের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক স্বার্থে পোপের সফরটাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের কিছু গণমাধ্যমের প্রয়োজনটা কী? গ্রামের প্রচলিত প্রবাদে রয়েছে, ‘দুইটা দুধ খায় তিন নম্বরটা দেইখাই লাফায়’, ভারী আলোচনায় এটাও ওজনে হালকা, তবে ‘মোরাল’টা কিন্তু সত্যিই লাফায়। আমাদের আচরণে লাফায়, আমাদের চিন্তায় লাফায়, আমাদের চেতনায় লাফায়, আমাদের হ্যাংলামো তো লাফায়। আর লাফানোটা প্রমাণ করে হয়তো আমরা প্রকৃত বা প্রকৃতিতেই ‘হ্যাংলা’। 

পুনশ্চ: কারও কারও এমন ‘হ্যাংলামো’তে আমাদের সার্বিক ‘হ্যাংলা’ প্রমাণের প্রয়াস কী আমরা মেনে নেব? প্রশ্নটা আত্মমর্যাদার, আত্মপ্রতিষ্ঠার।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]