কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

কোলাজ ছবি

প্রশ্নফাঁস, উইকিলিকস ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:২২
আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:২২

এক.

কাগজে দেখলাম নার্স নিয়োগ পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফাঁসকর্মে জড়িত থাকায় আদালতের নির্দেশে দুজন সিনিয়র নার্সকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। নার্স নিয়োগ পরীক্ষা তো অনেক পরের কথা, আমাদের বাচ্চাদের প্রাথমিক জীবনের প্রথম পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। চলতি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাতে আমার জেলা শেরপুরের নালিতাবাড়ীতেও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। ‘ফাঁসে’র দায়ে এক অনার্সপড়ুয়া যুবককে দু’বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাজাপ্রাপ্ত ওই যুবকের মুঠোফোনের ফেসবুক মেসেঞ্জারে চলতি পরীক্ষার হুবহু প্রশ্ন পাওয়ার কারণেই সাজা, এমনটাই জানিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী বিচারক। 

অর্থাৎ আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন শুরুই হচ্ছে অসদুপায় অবলম্বন করে। প্রাথমিকের সমাপনীতেই সততা সমর্পন করতে হচ্ছে তাদের। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ এমন ভালো হবার আকাঙ্খা, সৎ মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু হয়ে দাঁড়াবার বাসনাটাকে যে বাচ্চা প্রাথমিকেই সমর্পিত করছে, তার কাছ থেকে পরবর্তীতে আমরা কী আশা করতে পারি! বিজ্ঞান বলে, এমন বয়সেই বাচ্চারা মানসিকভাবে নৈতিক বিষয়গুলোকে ধারণ করে। উল্টো দিকে যার শুরুটাই হলো অনৈতিকতায় তার কাছ থেকে সততা আশা করা মানে ‘বাঁশে’র কাছ থেকে ‘রডে’র মান আশা করা। পাঠক আশা করি ভুলে যাননি ‘রডের বদলে বাঁশের’ কাহিনী। 

দুই.

ভারতের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘ধর্ষণ যখন অপ্রতিরোধ্য তখন তাকে উদযাপন করাই ভালো’। এমন চিন্তায় ‘প্রশ্নফাঁসে’র অপর দিকটাও তো আমাদের দেখা প্রয়োজন, না কী? পঞ্চমের পর অষ্টম হালের ‘জেএসসি’, সেটাতেও প্রশ্নফাঁসের কথা উঠেছে। এসএসসিতেও যথারীতি। এইচএসসিতেও একই অবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, মেডিকেল থেকে শুরু করে ব্যাংকের চাকরি, কোথায় নেই প্রশ্নফাঁসের কারবার। কারবারীরা এটাকে রীতিমত শিল্পে পরিণত করেছেন। এর সাথে জড়িত রয়েছে গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত অনেকেই। কর্মকর্তা, শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে ‘জেরক্সে’র দোকানি পর্যন্ত। এমন কী ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা ‘জুকারবার্গ’ও। বিশ্বাস হচ্ছে না, ‘জুকারবার্গ’ দায়ী না হলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে প্রশ্ন পাওয়া যায় কীভাবে! সঙ্গত কারণেই ব্যবসায়ে দ্রুত বর্ধনশীল খাত এই ‘প্রশ্নফাঁসকরণ’। এক্ষেত্রে ‘প্রশ্নফাঁস’কে অতি লাভজনক নতুন খাত হিসেবে আখ্যা দেওয়া ছাড়া আর কোনোও উপায় আছে কী? 

শুধু ব্যবসা নয়, অন্য ক্ষেত্রেও ‘ফাঁস’ বিষয়টির ইতিবাচকতা অস্বীকারের জো নেই। দেখুন না পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস ইত্যাদি সব ‘ফাঁস’ বিষয়ক ব্যাপার-স্যাপার না থাকলে তো অনেক কথাই গোপন থেকে যেত। এদের জন্যই তো, ‘গোপন কথাটি রহে না গোপনে’। এদিকটা ভাবলে ‘ফাঁস’ ব্যাপারটি অবশ্য অতটা খারাপ নয়। ‘উইকিলিকসে’র ‘লিকে’র কারণে ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ’ রীতিমত বিশ্বখ্যাত। ক্রমবর্ধমান ধারায় আশা করা যায় বর্তমান ‘প্রশ্নলিকে’র বিষয়টিও একসময় ‘উইকিলিকসে’র মতন খ্যাত হয়ে উঠবে, হয়তো আমাদের কেউ কেউ হয়ে উঠবেন আরেক ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ’। সুতরাং ‘বি পজেটিভ’। এমন ‘লিক’ বিষয়কে নেতিবাচক ভাবার বিশেষ কারণ নেই। 

এমনিতেই ‘খ্যাত’ হবার বিষয়টি মন্দ নয়। ‘খ্যাতি’তে প্রাথমিক কিছু ঝুঁকি থাকলেও পরেতে লাভ আছে। আখেরে উপরি হিসেবে বংশ পরম্পরায় নামটা থেকে যায়। ‘খ্যাত’ শব্দটির আগে বিশেষণটি কী লাগল তা নিয়ে মাথাব্যাথার কারণ নেই। ‘সু’ লাগুক, ‘কু’ লাগুক ‘খ্যাতি’টা দুটিতেই থেকে যায়। খলিফা ওমরও থেকে যান, হালাকু, চেঙ্গিসরাও থেকে যায়। কথা হলো থেকে যাওয়া নিয়ে। ‘সু’ আর ‘কু’ নিয়ে ভাবে সংশয়বাদীরা। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এমন চিন্তায় সময় নষ্ট করে তারাই। সুতরাং, ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি’, ‘খ্যাতি’ পাবার ও ‘খ্যাত’ হবার কোনো বিকল্প নেই। 

ফুটনোট: আমার জেলায় ‘ফাঁসে’র দায়ে সাজা পাওয়া সেই অনার্সপড়ুয়া যুবকটির জন্য করুণা জাগে। আহারে, ছোট ভাইকে ‘এ প্লাস’ পাবার প্রাণান্ত প্রতিযোগিতায় তার এই আত্মত্যাগ। অথচ এই প্রতিযোগিতার আবহ কী তার সৃষ্টি, ফেসবুকে প্রশ্ন পোস্ট করা কী তার কর্ম? একটি আপাত ব্যর্থ সিস্টেমের ‘স্কেপগোট’ নয় কী ওই যুবক, এমন প্রশ্ন কী জাগে কারও মনে?

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]