কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

একটু ত্রাণ পেতে যেন যুদ্ধ করতে হচ্ছে শরণার্থীদের। ছবি: ফোকাস বাংলা

ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে অদেখা দৃশ্যপট

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:৩৮
আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:৩৮

বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো মিয়ানমার সংলগ্ন অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে নিরাপত্তার বিষয়টি। ফেসবুক থেকে বর্মী মগদের নৃশংসতার ছবি, ভিডিও সরানোর কথা হচ্ছে, এখানে তোলা হচ্ছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট হবার গল্পগাথা। এ সবই গণমাধ্যমের খবর। 

বাংলাদেশের এক দায়িত্বশীলের বরাতে কলকাতার আনন্দ বাজার, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তাসহ নানা বিষয়ে ঝুঁকি’ বলে প্রচার করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানবজমিন সংবাদ করেছে, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে দিল্লির সুরেই সুর মেলাল ঢাকা’। ক্রমশই পত্রপত্রিকায় প্রকাশ্য হতে শুরু করেছেন প্রোপাগান্ডিস্টরা। তারা দেখাতে চেষ্টা করছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে আমাদের দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য সবই বিপন্ন হয়ে পড়বে। এক ডাক্তার মহাশয় একটি পোর্টালে নানা ফোলানো-ফাঁপানো কথার ভেতর দিয়ে জানিয়ে দিলেন, রোহিঙ্গা শিশুরা অসুস্থ, বড়রা এইডসসহ নানান রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্য অনতিদূরেই আমাদের স্বাস্থ্য বিশাল বিপদের সম্মুখীন। আরেক বুদ্ধিজীবী রোহিঙ্গাদের খাওয়াতে গিয়েই আমাদের চাল সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে, এমনটাই বোঝালেন! সর্বোপরি উপরতলার সুরও কেমন যেন বেতালা। 

সাহায্য ও পুনর্বাসনে আমাদের জন্মলগ্নে আমরা যে সহযোগিতা পেয়েছিলাম, তার সঠিক বিলি-বণ্টন হলে তা দিয়েই হয়তো আমরা দাঁড়িয়ে যেতে পারতাম, যেমনটা ভিয়েতনাম পেরেছিল। ৮৮-এর বন্যায় আমরা যে ত্রাণ পেয়েছিলাম, পুনর্বাসন সহায়তা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে অন্তত দেশের দুই তৃতীয়াংশের চেহারাই হয়তো বদলে দেয়া যেত। কিন্তু তা যায়নি। কেন যায়নি তা তর্কের বিষয় হলেও, যায়নি যে সেটা সত্য, যে সত্য এখনও উদাহরণ হিসেবে বর্ণিত হয়। 

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা ৭৮-এ কূটনীতিতে সফল হয়েছিলাম, সফল হয়েছিলাম ৯২-তেও। সেসময়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ নাগরিক হিসেবে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সময়ের বার্মা-মিয়ানমারের সরকারে অধিষ্ঠিতরা। এ নিয়ে একটি খবরও করেছে ‘আমাদের সময় ডটকম’। অথচ গত এক যুগে সমস্যাটিতে তেমন উল্লেখযোগ্য সফলতা আমাদের নেই। কেন নেই, এ বিষয়ে বিতর্ক চলতে পারে, ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু তারপরেও সত্য হলো, সফলতার স্পষ্ট দৃশ্যমানতা নেই। 

মিয়ানমারের প্রশ্নবোধক গণতন্ত্রী, ঘৃণা কুড়ানো শাসক ‘সু চি’ অবশেষে বক্তব্য দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বিষয়ে। তিনি তার বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি অনুল্লেখ রেখে বলেছেন, ‘সীমান্ত অতিক্রম করে বিপুল সংখ্যক মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে এটা শুনে আমরা উদ্বিগ্ন। কেন তারা দেশ ছাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে চাই আমরা।’ তার ভাষায়, ‘মুসলিমদের বিশাল অংশ এখনও রাখাইনেই আছে, তাদের ওপর কোনো নির্যাতন চলেনি।’ অর্থাৎ প্রকারান্তরে কথাটি দাঁড়ায় হলো, যেসব মুসলিমরা ‘টেরোরিস্ট’, তারাই ভয়ে পালিয়েছে, অন্যরা রয়ে গেছে। সু চি জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ ৫ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ কথাটা ভালো মতোন খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন আসল ঘটনা কী, আসলে কী ক্লিয়ার করতে চান সু চি ও তার সেনাবাহিনী। 

নিজ দেশ, নিজ জায়গা, সহায়সম্বল ছেড়ে কেউ অন্য দেশে আসতে চায় না। একজন মানুষ শেষ সময় পর্যন্ত নিজ মাটি আকড়ে থাকতে চায়, কিন্তু রোহিঙ্গারা তা পারেনি। কেন পারেনি তার অসংখ্য প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ক্যামেরাবন্দী হয়ে। লজ্জাহীন বেহায়ারা এসব অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু মানবিক মানুষ নয়। সু চি’র কথার যে স্বল্প সত্যতাও নেই তা আমাদের দেশে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের ঢলই বুঝিয়ে দিয়েছে। থাকার সামান্যতম পরিবেশ থাকলেও, পরদেশে অনিশ্চয়তার, আশ্রিতের জীবন কাটাতে কেউ আসে না। 

অবশ্য উগান্ডা হলে না হয় একটা কথা ছিল, যেখানে শরণার্থীদের স্বাগত জানানো হয়, এক টুকরো জমি দেওয়া হয়, শরণার্থী পরিচয়পত্র দেওয়া হয়, যা দিয়ে তারা চাকরি বা অন্য পেশায় যোগ দিতে পারেন। উগান্ডার ব্যাপারটি জানিয়েছে বিবিসি, আমার আরেক প্রিয়জন ‘ইনবক্সে’ জানিয়েছেন আরেকটি তথ্য। তার কাছ থেকে জানলাম, তাঞ্জানিয়ার ‘জুলিয়াস নায়ার’ ৭২ সালে বুরুন্ডি থেকে আসা শরণার্থীদের বলতেন, ‘রেসিডেন্ট গেস্ট’, বাংলায় ‘আবাসিক অতিথি’। আমরা রোহিঙ্গাদের এমন বাংলায় ডাকতে বলছি না, বলছি না তাদের স্থায়ীভাবে জায়গা দিতে হবে, আমরা শুধু মানবিক হতে বলছি। 

রোহিঙ্গাদের সাহায্য তোলা প্রসঙ্গে একজন বললেন, আমি নিজে কষ্ট করে উপার্জন করেছি, উপার্জিত নিজ দেশের টাকা অন্যদের জন্য কেন খরচ করব? এই প্রশ্নটা স্থুল মাপের হলেও, সেই স্বাস্থ্য সমস্যা, নিরাপত্তা সমস্যা, অর্থনীতি ইত্যাদি সব প্রশ্নের জন্ম কিন্তু একই খোয়ারে। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাহলে বিভিন্ন দেশ থেকে কেন সাহায্য আসছে? ঝট উত্তর, সেইটা তাদের ব্যাপার। মূল উত্তরটাও এরমধ্যেই, এমন স্বার্থপরতায়। যারা সাহিত্য করেন, তারা হয়তো বিষয়টিকে ‘নার্সিসিজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেন। গ্রিক পুরাণের এক চরিত্র ‘নার্সিসাস’, যিনি প্রতিবিম্বিত নিজ রূপ দেখে নিজের প্রেমে পাগল হয়েছিলেন এবং শেষ পরিণতিতে হয়েছিলেন আত্মঘাতী। স্বার্থপরতা সবসময়ই আত্মঘাতী, এ কথা ‘আত্মপ্রেমি’দের বোঝাবে কে?

ফুটনোট: ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে অদেখা দৃশ্যপট, কী হচ্ছে না? জাতিসংঘের অধিবেশনটা শেষ হোক, আরও অনেক অদেখা দৃশ্যপট দেখা যাবে দৃষ্টির সীমানায়। 

 

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]